নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চে হামলার প্রতিক্রিয়ায় আমেরিকান টিভি চ্যানেল এনবিসি নিউজকে আল জাজিরার ভেটেরান সাংবাদিক মেহেদী হাসান সম্প্রতি এক বক্তব্য দিয়েছেন। তার বক্তব্যের একটি অংশ ব্যাপক ভাইরাল হয়।
সেই বক্তব্যটি নিচে আওয়ার ইসলামের পাঠকদের জন্য অনুবাদ করে দেওয়া হলো। দু-এক জায়গায় ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে, যাতে করে আরো ক্লিয়ারলি বুঝা যায়। অনুবাদ করেছেন ত্বরিকুল ইসলাম
এনবিসি নিউজ: ওই সাদা বন্দুকধারী (নিউজিল্যান্ডে) কি মানসিকভাবে বিকারগ্রস্ত ছিল?
সে আসলে তার ভাবাদর্শ দ্বারা উদ্বুদ্ধ ছিল। মুসলিম কেউ সন্ত্রাসী হলে তার ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা এমনই।
মানসিক অসুস্থতা থেকে নিরাপদ থাকার নিজস্ব একটা ন্যাচারাল প্রটেকশন আমাদের আছেই। আমরা আসলে ভাবাদর্শ বা ইডিওলজি দ্বারা তাড়িত হই। আর ইডিওলজি দ্বারা তাড়িত হওয়া মানেই ‘মানসিক বিকারগ্রস্ত’ হওয়া নয়। তাই, কেউ মানসিক অসুস্থতা থেকেই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করে— ব্যাপারটা নিছক এমন নয়।
কিন্তু আপনি যদি মিডিয়ার কভারেজ দেখেন, তাহলে দেখবেন— ‘টেরোরিজম’ শব্দটা অমুসলিম সন্ত্রাসীদের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয় না। সমস্যাটা হলো এখানে। আমাদেরকে বিশ্বাস করানো হচ্ছে যে, সন্ত্রাসী হামলা কেবল বাদামি বর্ণের দাঁড়িওয়ালা কারো দ্বারাই সংঘটিত হয়ে থাকে। হামলাকারীর মুখে ‘আল্লাহু আকবার’ বা আরবিতে কোনো বাক্য উচ্চারিত হলেই ধরে নিতে হবে সে টেরোরিস্ট!
কিন্তু পরিসংখ্যান বলছে ভিন্ন কথা। এন্টি-ডিফেমেশন লীগ (এডিএল) বলছে, বিগত দশকজুড়ে আমেরিকায় যেসব সন্ত্রাসী নিহত হয়েছে, তাদের চারভাগের তিন ভাগই কট্টর ডানপন্থী শ্বেতাঙ্গ জাতীয়তাবাদী। বাকি এক ভাগ হচ্ছে মুসলিম। এই তথ্যানুসারে আমরা কি বলতে পারি যে, আমেরিকায় সন্ত্রাসী কর্মকান্ড নিয়ে মিডিয়ার ৭৫ শতাংশ কভারেজ ছিল শ্বেতাঙ্গ জাতীয়তাবাদী সন্ত্রাসীদের নিয়ে আর ২৫ শতাংশ কভারেজ ছিল মুসলিম সন্ত্রাসীদের নিয়ে?
(না, আমরা তা বলতে পারছি না। কারণ, মিডিয়া ছিল পক্ষপাতদুষ্ট। হামলাকারী মুসলিম হলেই টেরোরিজম নিয়ে মিডিয়ার কভারেজ থাকতো তুঙ্গে। কিন্তু, হামলাকারী অমুসলিম হলে তাকে নিছক বন্দুকধারী বা মানসিকভাবে অসুস্থ বলে কভারেজ করা হতো- যেন এর সাথে টোরোরিজমের কোনো সম্পর্কই নাই!)
প্রকৃতপক্ষে, জর্জিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটি একটা গবেষণা করেছিল- তাতে দেখা যায়, সন্ত্রাসী হামলার ঘটনাগুলোতে মিডিয়ায় একজন অমুসলিম সন্ত্রাসীর চেয়ে সাড়ে চার গুণ বেশি কভারেজ পায় একজন মুসলিম সন্ত্রাসী। সাড়ে চার গুণ বেশি!!
(এ জায়গায় উপস্থাপিকা স্মরণ করিয়ে দিলেন, আচ্ছা, লাস ভেগাসে হামলাকারীর কথা চিন্তা করুন তো! যে শত শত মানুষকে গুলি করে হত্যা করেছিল।)
(মেহেদী হাসান বললেন) এমনকি তাকে ভুলে যাওয়া হয়েছে। তার ব্যাপারে মিডিয়ায় আর কোনো উচ্চবাচ্য নেই। কেউই তাকে নিয়ে কিছু বলছে না। এটা হ্যাশট্যাগ মিডিয়া তথা সোশাল মিডিয়ার ব্যর্থতা!
অথচ আরেকটা পরিসংখ্যানের কথা বলি, জর্জিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটির গবেষণাটি যারা করেছিল, তারা দেখে যে, একজন মুসলিম সন্ত্রাসী যে-পরিমাণ মিডিয়া-কভারেজ পায়, একজন অমুসলিম সন্ত্রাসী সে পরিমাণ মিডিয়া-কভারেজ পায়— যখন সে একজন মুসলিম সন্ত্রাসীর চেয়েও গড়ে ৭ জন বেশি মানুষকে হত্যা করে।
এ জায়গায় মেহেদী হাসান একটু হেসে ভাইরাল হওয়া একটা টুইট স্মরণ করলেন, “টেরোরিজম হলো এমন একটা জায়গা, যেখানে শ্বেতাঙ্গরা কাজ করে বেশি, কিন্তু ক্রেডিট পায় না।” এটাই হচ্ছে প্রবলেম। এর ফলে বর্ণবাদ ও ইসলামভীতি বিস্তৃত হচ্ছে। অভিবাসী সম্প্রদায়ের ওপর সব দায় চাপানো হচ্ছে। তাদেরকে হুমকি হিসেবে দেখানো হচ্ছে। ভাবটা এমন যে, যেন শ্বেতাঙ্গদের মধ্য থেকে কোনো হুমকি বা সমস্যা নাই।
অথচ অনেক নজির আছে, যেমন: ডিল্যান রুফ নামে এক শ্বেতাঙ্গ হামলাকারী ৯ জন কৃষ্ণাঙ্গকে গুলি করে হত্যা করেছে। অথচ জেলে সে বার্গার ও ফ্রাই খেতে চেয়েছে, তাকে তা দেওয়া হয়েছে। এমনকি তাকে সন্ত্রাসী বলা তো দূরের কথা, তার বিরুদ্ধে টেরোরিজমের চার্জও গঠন করা হয়নি।
এলেক্স ফিল্ডস নামে আরেকজন শ্বেতাঙ্গ বন্দুকধারীর ক্ষেত্রেও টেরোরিজমের কোনো চার্জ গঠন করা হয়নি।
গত বছর ইহুদিদের এক মন্দিরে প্রার্থনারত ১১ জন ইহুদিকে গুলি করে হত্যা করেছিল রবার্টস বোয়ারস নামে আরেক উগ্র জাতীয়তাবাদী শ্বেতাঙ্গ। তার ব্যাপারে মিডিয়ার হেডলাইনে ব্যবহৃত একমাত্র শব্দটি ছিল: ‘বন্দুকধারী’! ‘বন্দুকধারী’! কিন্তু ‘সন্ত্রাসী’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়নি।
আর দেখুন, শুরু থেকে ‘ওয়ার অন টেরোর’-এর ডিসকোর্সটি নিয়ে আমার আপত্তি আছে। কিন্তু ভারসাম্যপূর্ণ হওয়া উচিত আমাদের।
আরআর