জগলুল হায়দার
ছড়াকার
ক্রাইস্টচার্চের দুইটা মসজিদে শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদি সন্ত্রাসীর (নিউজিল্যান্ড প্রধানমন্ত্রীর অনুভবি আহবানে অর নাম উচ্চারণ থিকা বিরত থাকলাম) সাম্প্রতিক নৃশংস হামলায় পুরা দুনিয়া স্তম্ভিত। শোকার্ত পুরা মুসলিম বিশ্ব। বাংলাদেশও শোকে মুহ্যমান।
বাংলাদেশে শোকের ছায়া আরও গভীর কেননা এই হামলায় নিহত ৪৯ জনের মধ্যে ৫ জনই বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত। যাদের মধ্যে হামলায় সবচাইতে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত আল নূর মসজিদের ইমামও আছেন।
অবশ্য এই হামলার পর বাংলাদেশের জন্য একটা স্বস্তির সংবাদও ছিল। অই মসজিদে জুম্মা পড়তে যাওয়া বাংলাদেশ ক্রিকেট টিমের সদস্যরা অল্পের জন্য প্রাণে বাঁইচা যান। প্রাণে বাঁইচা গেলেও ঘটনার আকস্মিকতা ও ভয়াবহতায় ক্রিকেটাররা মুষড়ে পড়ে। মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়।
সেই বিপর্যস্ততার ছাপ মিডিয়ায় ঘটনা সম্পর্কে মুশফিক, তামিমদের আলাপেই প্রকাশ পাইছে। এই যখন ক্রিকেটারদের অবস্থা তখন একশ্রেণির অতিবিপ্লবী (মূলত প্রতিক্রিয়াশীল) বাংলাদেশ ক্রিকেটের অন্যতম স্তম্ভ মুশফিকুর রহিম এর জার্সি নিয়া আনখা (জামালপুর অঞ্চলের ভাষায় অযথা) বিতর্ক উস্কায়া ক্রিকেটারদের মানসিক বুঝার (বোঝার) উপ্রে শাকের আঁটি চাপায়া দিছে।
ঘটনার শুরু অই নিউজিল্যান্ড থাকতেই। যখন সবাই ক্রিকেটারদের নিরাপদ স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের জন্য অপেক্ষা করতেছিল, বিতর্ককারিরা ক্রিকেটারদের সেই নাজুক সময়েও ছাড় দেয় নাই।
আমি ক্রিকেটার বা তারকা খেলোয়াড়দের মাত্রাতিরক্ত ভক্তি পছন্দ করি না; যা এই দেশে অনেকেই করে। বরং তারকা খেলোয়াড়দেরও অনেকসময় ন্যায্য সমালোচনা (ব্যক্তিগত নয় বরং খেলা বা এই জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে) করি। কিন্তু সেইটা করারও তরিকা আছে। আছে সময়ও।
মুশফিক নিউজিল্যান্ড থাকতেই সোশ্যাল মিডিয়ায় একটা ছবি শেয়ার করেন। ছবিতে দেখা যায় তার জার্সিতে থাকা বাঘের লোগো ট্যাপ দিয়া ঢাকা। আর এতেই কেউ কেউ গেলো... গেলো... রব তুললো।
বাঘের লোগো ঢাকার প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে বলি, এইটা যদি ভুল বা দোষের কিছু হয় তাইলেও এইটা নিয়া এই মুহূর্তে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত মুশফিকের উপ্রে এইভাবে ঝাপায়া পড়া ঠিক হয় নাই।
এইবার আসি লোগো ঢাকার বিতর্কে। আমি মনে করি এতে মুশফিকের কুনো ভুল হয় নাই। ভুল যুদি কিছু হয় তাদেরই হইছে যারা 'চেতনা' কিম্বা অন্যকিছুর নামে মুশফিককে ভুল বুচ্চে।
কিভাবে? প্রথমেই ব্যক্তিগত কয়েকটা অভিজ্ঞতার কথা বলি। আমার বাবা মারা যাবার অনেকদিন পর আমার ছোটভাই আব্বার একটা ছবি বেশ বড় কইরা ফ্রেমে বান্ধায়। তারপর সেইটা আমগো ভৈরবের বাসার ড্রইংরুমের দেয়ালে টানায়।
তো যেইবার এই ছবি টানায় সেইবারই বাবার মৃত্যুবার্ষিকীর আগের শুক্কুরবারে (সচরাচর আমরা তাঁর মৃত্যুর দিনে কুনো অনুষ্ঠান না কইরা অইদিনের আগের জুম্মাবারেই করি এবং এইটা করা হয় আকিদাগত কারণেই) এক দোয়া ও মিলাদের আয়োজন করি বাড়িতে। সেই মিলাদের মূল অনুষ্ঠান অই ড্রইংরুমেই হয়।
তো বাসায় মিলাদ আয়োজন করলে যা হয়, মহিলারা (আম্মা, আমার স্ত্রী, আমার ভাইয়ের স্ত্রী আর বোনদের যারা আসে) ভিতরে তথা কিচেন আর ডাইনিংরুমে ব্যস্ত থাকে। আর পুরুষরা (আমরা ৩ ভাই আর বোন জামাইদের কেউ আসলে) বাইরে ব্যস্ত থাকি।
এই ব্যস্ততার এক ফাঁকে দেখলাম আমার ছোটভাই টাওয়েল দিয়া দেয়ালে ঝুলানো বাবার ছবিটা ঢাইকা দিলো। আমি কিছুটা বুঝতে পারলেও কিলিয়ার হওয়ার জন্য বললাম; আব্বার ছবিটা ঢাকলি ক্যান? ও বললো, ভাইজান মিলাদ হইব তাছাড়া মিলাদের পর এইখানেই মাগরিবের জামাত পরুম, তাই আব্বার ছবি ঢাকছি।
এখন আমি কি ভাবুম যে আমার বাবার প্রতি আমার ভাইয়ের অশ্রদ্ধার নমুনা এইটা? না আমি মোটেও তা ভাবি নাই কারণ আমি জানি আমার ভাইই পরম মমতায় বাবার এই ছবি বান্ধায়া দেয়ালে টানাইছে। তাছাড়া বাবার প্রতি আমার চাইতে তার শ্রদ্ধা কম তো নয়ই বরং বেশি। তাইলে?
তাইলেও যুদি কেউ তেমুন ভাবে; তবে সেটা একবারেই ভুল ভাবনা হইব। আসলে এইটা আমগো আকিদার ব্যাপার। আর কে না জানে আকিদার জাগায় ব্যক্তিগত পছন্দ/অপছন্দের চর্চা করি না আমরা। আসলে সেই সুযুগই (সুযোগই) নাই।
এইবার আসি আরেক ঘটনায়। আমাকে এক ভক্ত (পটুয়াখালীর এক কলেজ অধ্যাপক) একবার পয়লা বৈশাখে একটা টিশার্ট উপহার দেয় যার বুকের ভিতর ছিল রবি ঠাকুরের দারুণ এক ছবি। আমার স্ত্রী খুব ধর্মপ্রাণ। আমি জানি মানুষের ছবিওয়ালা গেঞ্জি তাঁর পছন্দ হওয়ার কথা না। তারপরও উপহার আর রবি ঠাকুর মিলায়া আমি সেইটা পরতাম। তিনি খুব বেশি আপত্তি করেন নাই।
কিন্তু একদিন আমি সেই গেঞ্জি পইড়া নমাজে দাঁড়াইছি প্রায়। এইসময় আমার স্ত্রী বললেন, এই গেঞ্জিটা খুলো। এইটা তিনি সচরাচর ময়লা কাপড়ের ক্ষেত্রে বলেন। তাই বললাম, এই গেঞ্জি তো পাক আছে। আমার কথায় তিনি বললেন, বুকের মধ্যে মানুষের ছবি থাকলে নামাজ হইব না। এই বইলা তিনি অন্য একটা টিশার্ট আমার হাতে তুইলা দিছিলেন।
এখন কি আমি ভাবুম যে সে রবিন্দ্র বিরোধী। মোটেও না। কারণ এর কয়েক বছর পর আমার আরেক জুনিয়র কবি আমারে আরেকটা টিশার্ট উপহার দেন যার বুকে বিদ্রোহী কবিতাসহ নজরুলের ছবি ছিল। এবং আমার গায়ে সেই গেঞ্জি থাকলেও নামাজের আগে তিনি আমারে সেইটা খুইলা অন্য গেঞ্জি পড়ার জন্য দিতেন। এইবার কি ভাববেন তিনি নজরুল বিদ্বেষী। মোটেও না। আসলে তিনি ধর্মনিষ্ঠ। একান্তভাবে আকিদা অনুসারী।
এইবার আসেন প্রেসক্লাবে। সেইটা ১৯৯৬ সালের কথা। তখন তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে আওয়ামীলীগ, জাতীয় পার্টি আর জামাতের যুগপৎ আন্দোলন চলতেেছে। ব্যাপক জনসমর্থনপুষ্ট সেই আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে প্রেসক্লাবে তৈরি হয় জনতার মঞ্চ। সেই জনতার মঞ্চে ছিল বঙ্গবন্ধুর একটা ফেস্টুন সাইজ ছবি।
তো মাগরিবের নামজের সময় মঞ্চেই নেতারা জামাতে নামাজ পড়তেন। কিন্তু আমার প্রায় পষ্টই মনে আছে, সেই জামাতের আগে আগে নেতারা বংবন্ধুর সেই ছবি মঞ্চের এক পাশে সরায়া রাখতেন অথবা উলটা-মুখ কইরা দিতেন।
আপনি কি বলবেন অই নেতাদের বংগবন্ধু প্রেমে ঘাটতি ছিল? মোটেও না। আসলে তাঁরা এইটা করতেন অই আকিদাগত কারণে। এবং জামাত শেষে সেই ছবি যথারীতি আগের মতো কইরা রাখতেন।
এইবার আসেন নয়াপল্টন। এইখানেই বিএনপির প্রধান কার্যালয়। আর এই কার্যালয়ের নিচ তালায় (তলায়) শহীদ জিয়ার এক টিপিক্যাল ভাস্কর্য ছিল। কিন্তু শহীদ জিয়ার জন্ম বা শাহাদাত দিবসে দোয়া আর মিলাদের সময় সেই ভাস্কর্যই এক পাশে সরায়া (অনেকটা সেই আমার বাবার মিলাদে বাবার ছবিই ঢাকার মতো) রাখা হইত।
এইটা কি শহীদ জিয়ার প্রতি প্রেমের ঘাটতি নির্দেশক? মোটেও না। তয় অইভাবেই তা অনেকদিন পইড়া থাকায় এই নিয়া তখন এক শীর্ষ দৈনিকে অনেকটা 'বিএনপি অফিসেই অনাদরে জিয়ার ভাস্কর্য' শিরনামে অনুসন্ধানী রিপোর্ট হইছিল। সেইটা অনেকদিন এক কোনায় রাখার জন্যই। দোয়া বা মিলাদের সময়ের জন্য নয়। (চলবো...)
[বয়ান চলতি কথনরীতিতে লেখা]