জহির উদ্দিন বাবর
আলেম ও সাংবাদিক
সম্প্রতি জাতীয় সংসদে দেয়া বামপন্থী নেতা রাশেদ খান মেননের একটি বক্তব্যে ক্ষুব্ধ হয়েছেন কোটি কোটি মানুষ। তিনি মাদরাসা শিক্ষা, আলেম-উলামা, ইসলামি অনুশাসন, সর্বজন শ্রদ্ধেয় আলেম আল্লামা শাহ আহমদ শফী সবার প্রতি নিজের ভেতরে ঘাপটি মেরে থাকা হিংস্রতার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন।
মেনন কওমি মাদরাসা শিক্ষাকে ‘বিষবৃক্ষ’, ইসলামি শাসনব্যবস্থাকে ‘মোল্লাতন্ত্র’ আর আল্লামা শাহ আহমদ শফীকে ‘তেঁতুর হুজুর’ বলার মতো অসম্ভব রকমের দুঃসাহস দেখিয়েছেন। তার এই বক্তব্যের পর থেকেই দেশের আলেম-উলামা ও তৌহিদি জনতা ক্ষোভে ফুঁসছে। গত শুক্রবার রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে মেননের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করেছে লাখো জনতা।
সরকারের সঙ্গে আলেম-উলামার সম্পর্ক যখন অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে ভালো তখন রাশেদ খান মেননের এ ধরনের বক্তব্যের প্রাসঙ্গিকতা খুঁজে পাচ্ছেন না অনেকেই। তবে হিসাব অনেকটা পরিষ্কার, মন্ত্রিসভা থেকে বাদ পড়ার পর থেকেই টালমাটাল অবস্থায় আছেন মেনন। মন্ত্রিত্ব না পেয়ে অনেকে গোপনে গোপনে ফুঁসলেও মেননের কথাবার্তায় তা প্রকাশ পেয়ে যায়।
কোনোভাবেই যখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হননি তখন তিনি বেছে নিয়েছেন একটি সস্তা মাধ্যম। তার ধারণা, এভাবে বক্তব্য দিয়ে আলেম-উলামা ও তৌহিদি জনতাকে ক্ষেপালে প্রধানমন্ত্রী হয়ত ‘পাগল সামলানোর মতো’ তাকে মন্ত্রিত্ব দিয়ে মুখ বন্ধ করতে চাইবেন।
শুধু এ ব্যাপারে নয়, সরকারকে বিব্রত করার মতো আরও বেশ কিছু কথাবার্তা সম্প্রতি মেনন বলেছেন,যা আমরা গণমাধ্যম সূত্রে জানতে পেরেছি। কয়েক দিন আগে বরিশালে একটি অনুষ্ঠানে ‘উপজেলা নির্বাচনে দিনেই ভোট ডাকাতি হবে’ এ জাতীয় মন্তব্য করে তিনি তোলপাড় সৃষ্টি করেন।
কিন্তু কোনো কিছুতেই কাজ হচ্ছে না। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ কিছুটা বিব্রত হলেও মেননদের পাত্তা দিচ্ছে না। মেনন-ইনুদের মন্ত্রিত্ব ফিরে পাওয়ার মতো কোনো আভাস আপাতত দেখা যাচ্ছে না।
রাশেদ খান মেননরা আলেম-উলামা, ইসলামি শিক্ষা-সংস্কৃতি সহ্য করতে পারেন না এটা নতুন কোনো ঘটনা নয়। বরিশালের একটি খান্দানি মুসলিম পরিবারে জন্ম নেয়া মেনন জীবনের বড় অংশটি ব্যয় করেছেন ইসলামের বিরোধিতায়।
নড়বড়ে অস্তিত্বে থাকা একটি দল করেও তিনি বড় নেতা। বিভিন্ন সময় সরাসরি ইসলামি মূল্যবোধের বিরুদ্ধে বক্তব্য দিয়ে তিনি আগেও বিভিন্ন সময় আলোচনায় এসেছেন।
তথাকথিত মুক্ত চিন্তা আর প্রগতিশীলতার নামে মেননের মতো চরিত্রহীন বাম নেতারা সুযোগ পেলেই ইসলামপন্থীদের কষে গালি দেন। শেখ হাসিনার মন্ত্রিসভায় থাকার কারণে মাঝে কয়েক বছর ইনু-মেননদের মুখ কিছুটা বন্ধ ছিল। মন্ত্রিত্ব না পাওয়ার বেদনা আবার পুরোনো সেই চেহারা উন্মোচন করে দিচ্ছে।
যে জাতীয় সংসদে কয়েক মাস আগে কওমি মাদরাসা সনদের স্বীকৃতির বিল পাস হয়েছে সেই সংসদে দাঁড়িয়েই কওমি মাদরাসার বিরুদ্ধে বিষোদগার করলেন মেনন। আলোচিত এই বিলটি পাস হওয়ার সময় সরকার ও বিরোধী দলের সদস্যরা একযোগে কওমি মাদরাসা শিক্ষার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একান্ত ইচ্ছায় এবং তার বিশেষ নির্দেশনায় কওমি শিক্ষার্থীদের দীর্ঘদিনের দাবি বাস্তবায়িত হয়েছে।
সরকারপ্রধান যে সত্যিকার অর্থেই কওমি শিক্ষার্থীদের কল্যাণ চান নানা জটিলতা সত্ত্বেও বিলটি পাস করার দ্বারাই সেটা বোঝা যায়। এজন্য আলেম-উলামা কৃতজ্ঞতাস্বরূপ সম্মিলিতভাবে শুকরিয়া মাহফিলে প্রধানমন্ত্রীকে সংবর্ধনা দিয়েছেন। তাকে ‘কওমি জননী’ পর্যন্ত বলা হয়েছে।
কিন্তু ভাবতে অবাক লাগে, মেননদের মতো শিকড়হীন নেতারা জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে নিজেদের হিংস্র চরিত্রের বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে পারেন কীভাবে! চেয়ারম্যান-মেম্বার হওয়ার মতো যোগ্যতা নেই যে নেতাদের আওয়ামী লীগের কল্যাণে তারা এখন কয়েকবারের এমপি। মাঝে মন্ত্রিত্বের স্বাদও কপালে জুটেছে।
যাদের পায়ের তলায় মাটি নেই সেই নেতারা যখন সংসদে দাঁড়িয়ে জাতির হৃদয়ের স্পন্দন আলেম-উলামার বিরুদ্ধে কথা বলেন তখন ভাবতে অবাক লাগে তারা এই দুঃসাহস কোথায় পান?
এটা অবশ্য সত্য, বিদেশি প্রভুরা তাদের পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে আসছে বহুকাল ধরে। তবে দেশে যাদের শিকড় নেই তারা বিদেশি প্রভুদের ক্রীড়নক হিসেবে যতই লাফালাফি করুক, তাদেরকে এদেশের মাটি ও মানুষ গ্রহণ করবে না।
আলেম-উলামা ও ইসলামবিদ্বেষী বক্তব্য দিয়েই মেনন ক্ষান্ত দেননি, তিনি সুস্পষ্ট কাফের কাদিয়ানিদের পক্ষাবলম্বনও করেছেন। হেফাজতে ইসলামের মহাসচিব আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী আহ্বান জানিয়েছেন, মেননদের জানাজা যেন কোনো আলেম না পড়ান। মুসলিম নামধারী এই আদর্শহীন নেতাদের জন্য এরচেয়ে বড় সতর্কতা আর কিছু হতে পারে না। মেননদের সহযোগী আরও যারা আছেন তারাও সতর্ক না হলে উচিত তাদের জানাজা ও দাফন-কাফন বয়কট করা।
মেননের বক্তব্য নিয়ে যখন চারদিকে নিন্দার ঝড় বইছে তখন জাতীয় সংসদে আরেকজন এমপির বক্তব্য লাখো আলেম-উলামার অন্তর জয় করে নিয়েছে। ঢাকা-৬ আসন থেকে নির্বাচিত জাতীয় পার্টির নেতা কাজী ফিরোজ রশিদ রোববার জাতীয় সংসদে মেননের বক্তব্যের তীব্র সমালোচনা করেছেন। তার বক্তব্যের সেই ভিডিও ক্লিপটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এখন ভাইরাল হয়ে বেড়াচ্ছে।
ফিরোজ রশিদ কওমি মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। কওমি মাদরাসা শিক্ষার্থীদের রক্ত কতটা বিশুদ্ধ সে কথা বলেছেন। তিনি চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলেছেন, কওমি মাদরাসায় মাদকের ছিঁটেফোঁটাও নেই। অথচ অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এ কথা কল্পনাও করা যায় না।
আদর্শ জাতি গঠন করতে হলে কওমি মাদরাসা কতটা দরকারি সেটা তিনি সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। শান্ত পরিবেশকে উস্কানিমূলক বক্তব্য দিয়ে অশান্ত না করতে মেননদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
কাজী ফিরোজ রশিদ এর আগেও জাতীয় সংসদ এবং টেলিভিশন টকশোতে কওমি মাদরাসার পক্ষে বক্তব্য দিয়ে প্রশংসা কুড়িয়েছেন। জাতীয় সংসদের এই বক্তব্যের কারণে তিনি কওমি আলেম-উলামার হৃদয়ের গভীরে স্থান করে নিলেন।
একদিকে রাশেদ খান মেননদের জন্য লাখো হৃদয়ের ভর্ৎসনা, ঘৃণা আর ধিক্কার। অপরদিকে কাজী ফিরোজ রশিদদের জন্য লাখো হৃদয়ের দোয়া, কৃতজ্ঞতা এবং অন্তর নিসৃত ভালোবাসা।
এমপি-মন্ত্রী অনেকেই হন, ক্ষমতা অনেকের ভাগ্যে জুটে। কিন্তু মানুষের হৃদয়ের ভালোবাসা ও দোয়া কতজনের জুটে। আপনি যত ক্ষমতাবানই হোন না কেন, একদিন না একদিন এর পরিসমাপ্তি ঘটবে, তখন কেউ যেন আপনাকে ধিক্কার না দেয়; অপকর্মের কারণে যেন কারও বদদোয়া আপনাকে ভষ্ম না করে দেয়- সেই প্রচেষ্টা থাকা উচিত প্রত্যেক রাজনীতিবিদের।
লেখক : সভাপতি, বাংলাদেশ ইসলামী লেখক ফোরাম
আরএম/