পলাশ রহমান
একাদশ জাতীয় নির্বাচনের মধ্য দিয়ে দেশের রাজনৈতিক অচলাবস্থার অবসান হতে পারতো, কিন্তু হয়নি। দেশে রাজনীতির স্বাভাবিক ধারা ফিরে আসেনি। নির্বাচনের পরে বিরোধী দলগুলো কোনো কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামেনি। নামার চেষ্টা করতেও দেখা যায়নি।
নির্বাচনী অনিয়মের বিরুদ্ধে কেউ একটা মিছিল কর্মসূচিও ঘোষনা করেনি। সব কিছু কেমন যেনো স্থবির হয়ে আছে। এমনকি সরকার দলেও বিজয়ের উল্লাস নেই। সোহরাওয়ার্দীতে আনুষ্ঠানিকতার বাইরে তাদের মধ্যেও কোনো ‘প্রাণ’ নেই। হয়তো এমন ‘আত্মবিদাড়িত বিজয়’ দলটির সচেতন মহল প্রত্যাশা করেনি।
জাতীয় নির্বাচনের ধকল কাটতে না কাটতেই ইলেকশন কমিশন ঘোষণা করেছে ফেব্রুয়ারির শেষে ঢাকা উত্তরের সিটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। মার্চ মাস থেকে শুরু হবে উপজেলা নির্বাচন।
৪৯২টি উপজেলা পরিষদের মধ্যে ৫ ধাপে ৪৬০টিতে নির্বাচন করার প্রাথমিক পরিকল্পনা জানানো হয়েছে। বিএনপি আনুষ্ঠানিক ভাবে বলে দিয়েছে, দলীয় সরকারের অধীনে আর কোনো নির্বাচনে তারা অংশগ্রহণ করবে না।
কিন্তু দেশের ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো কী ভাবছে? তারা কী এ সরকারের অধীনে উপজেলা পরিষদ নির্বাচন এবং ঢাকার সিটি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে? নাকি বিএনপিকে অনুসরণ করে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াবে?
ইসলামি আন্দোলনের আমির সৈয়দ রেজাউল করিম উপজেলা নির্বাচনে অংশগ্রহণের প্রশ্নে সরাসরি কিছু না বললেও সাম্প্রতিক এক বিবৃতিতে জানিয়েছেন, বর্তমান সরকার এবং তার অনুগত নির্বাচন কমিশনের অধীনে দেশে কোনো গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সম্ভব নয়।
এদিকে আমিরের রাজনৈতিক উপদেষ্টা অধ্যাপক আশরাফ আলী আকন প্রথম আলোকে বলেছেন, এ সরকারের অধীনে সকল নির্বাচন ইসলামি আন্দোলন প্রত্যাখান করতে চায়।
রাজনীতি বিশ্লেষকরা মনে করেন, দেশের ইসলামপন্থী রাজনীতি এবং বিএনপি আওয়ামী লীগের রাজনীতির ধারা এক রকম নয়। ইসলামপন্থীদের স্বতন্ত্র দক্ষতা যোগ্যতা এখন পর্যন্ত জনগণের কাছে প্রমাণিত নয়।
সুতরাং ইসলামপন্থী বিরোধী দলগুলো যদি বড় বিরোধী দল হিসাবে বিএনপিকে অনুসরণ করে রাজনীতি করতে চায় তবে জনগণের কাছে তাদের রাজনৈতিক গ্রহণযোগ্যতা অপ্রমাণিতই থেকে যাবে।
বিশেষ করে ইসলামপন্থী যে দলগুলো দীর্ঘ দিন বিএনপির সাথে জোট রাজনীতি করেছে, আওয়ামী লীগের সাথে নির্বাচনি রাজনীতি করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে, তাদের মতো নিজস্ব গন্ডিতেই থেকে যেতে হবে আরো লম্বা সময়।
একাদশ জাতীয় নির্বাচনে এককভাবে অংশগ্রহণ করে ইসলামি আন্দোলন যে পরিচিতি লাভ করেছে, নেতাকর্মীরা গণমুখী রাজনীতির যে সন্ধান পেয়েছে তা ধরে রাখতে হলে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে হবে।
দলকে তৃণমূল থেকে শক্তিশালী এবং নির্বাচনের জন্য যোগ্যমানের নেতাকর্মী তৈরী করতে হলে ইউনিয়ন পরিষদ বা স্থানীয় সরকার পর্যায়ের নির্বাচন বর্জন কোনো ভাবেই সুফল দেবে না।
দলীয় সরকারের অধিনে বা বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অধিনে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হবে না ধরে নিয়েই ইসলামপন্থীদের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা উচিৎ। এক্ষেত্রে মনে রাখা দরকার জাতীয় নির্বাচন বর্জন আর স্থানীয় নির্বাচন বর্জন এক কথা নয়। বিশেষ করে ইসলামপন্থী দলগুলোর জন্য আকাশ-জমিন ব্যবধানের বার্তাবহন করে।
বিএনপির সাথে যদি দেশের ইসলামপন্থী দলগুলোও ইউনিয়ন পরিষদ এবং সিটি নির্বাচন বর্জন করে তবে আওয়ামী লীগকে ওয়াকওভার দেয়া হবে। যেমন দেয়া হয়েছিল দশম জাতীয় নির্বাচনে।
ওই সময়ে আওয়ামী লীগকে ওয়াকওভার করে খুব বেশি লাভ হয়নি, বরং একাদশ জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অধীনে অংশগ্রহণ করে প্রমাণ করতে হয়েছে, দলীয় সরকারের অধীনে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে সম্ভব নয়। এতে আওয়ামী লীগের অগণতান্ত্রিক মনোবল বৃদ্ধি পেয়েছে। শক্তি খাটিয়ে ক্ষমতায় টিকে থাকার ভীতি মজবুত হয়েছে।
একাদশ জাতীয় নির্বাচন যেমনই হোক- ইসলামি আন্দোলনের নেতাকর্মীরা এ নির্বাচনের মধ্য দিয়েই গণমুখি রাজনীতির মহাসড়ক চিনেছে। নেতাকর্মীদের মধ্যে রাজনৈতিক তৎপরতা বৃদ্ধি পেয়েছে। গ্রাম ইউনিয়ন পর্যায়ে সাংগঠনিক কাঠামো তৈরি হয়েছে।
এখন যদি ইসলামি আন্দোলন ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ায় নেতাকর্মীরা আগের মতোই বেকার হয়ে পড়বে। একাদশ জাতীয় নির্বাচনের অর্জন ধরে রাখা সম্ভব হবে না।
কেউ কেউ বলতে পারেন- দল গোছানো বা দলীয় কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে পারলে নেতাকর্মী ঝিমিয়ে পড়বে না, বেকার হবে না। কিন্তু দলীয় ওইসব কার্যক্রম একটা শ্রেণীবদ্ধ, গন্ডিবদ্ধ হয়ে পড়বে। গণমুখী রাজনীতির ট্র্যাক থেকে নেতাকর্মীরা দুরে সরে যেতে বাধ্য হবে।
জনকল্যাণমূলক রাজনীতির বিপরীতে জনবিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি হবে। তাছাড়া দেশের রাজনীতিতে এমন কোনো পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় নি যে সরকার বিরোধী আন্দোলন করে ইসলামপন্থীরা সামনে এগিয়ে যেতে পারবে। সহসা এমন কোনো সম্ভবনাও দেখছেন না রাজনীতি সচেতন মানুষরা।
সুতরাং দলীয় বৈঠকের মধ্যে নিজেদের আটকে না রেখে গণমুখী সমাজকল্যাণমূলক রাজনীতির সাথে মিশে থাকতে পারলেই গণমানুষের আস্থা অর্জন করা সহজ হবে।
সরকার নিয়ন্ত্রিত নির্বাচন করবে, প্রধানমন্ত্রী কথা-কাজে মিল রাখেন নি, নির্বাচন কমিশন সরকারের তাবেদারি কবে, এমন অজুহাতে মাঠ ছেড়ে দেয়া কোনো রাজনৈতিক দলের কৌশল হতে পারে না।
রাজনৈতিক দল হিসাবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা এবং সরকারের অগণতান্ত্রিক মনোভাবের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করাই রাজনৈতিক দলের কর্মকৌশল হওয়া উচিত। দশম জাতীয় নির্বাচনের মতো একাদশ জাতীয় নির্বাচনও যদি বিরোধী দলগুলো বর্জন করতো তবে কোনোভাবেই প্রমাণ করা সম্ভব হতো না সরকার ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য কতোটা অগণতান্ত্রিক হতে পারে।
সুতরাং নির্বাচন বর্জন না করে সরকারের সামনে চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করতে হবে। নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেই বার বার প্রমান করতে হবে দলীয় সরকারের অধিনে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সম্ভব নয়। গণবিপ্লব সৃষ্টির জন্য আপাতত এটাই সঠিক পথ।
লেখক: ইসলামি রাজনীতি গবেষক
আরআর