ত্বরিকুল ইসলাম
রাজনৈতিক বিশ্লেষক
সম্প্রতি সুবর্ণচরে একজন জননী গণধর্ষণের স্বীকার হয়েছেন (ঘটনার সূত্রপাত যা-ই হোক)। সম্ভ্রম হারানো নির্যাতিত নারীর ন্যায়বিচার পাওয়ার দাবিতে রাজপথে এ নিয়ে গণআন্দোলনের কথা থাকলেও তা হয়নি। এমনকি এ ইস্যুতে আলেমদেরও কোনো কর্মসূচি নেই!!
দু-একজন মুখ রক্ষার জন্য হয়ত বিবৃতি দিয়েছেন বড়জোর। কিন্তু ধর্ষণ হওয়া বা একজন নারীর সম্ভ্রম হরণ কি এতই মামুলি অপরাধ যে- টুকটাক বিবৃতি দিলেই দায় সারা হয়ে যায়? এ ভয়ঙ্কর অপরাধ দমন করতে না পারলে একদিন কি আমাদের ঘরকেউ পোড়াবে না!
কেউ কেউ আছেন, যারা বলবেন, ভাই সুবর্ণচরের ঘটনাটা রাজনৈতিক ব্যাপার স্যাপার। এ ঘটনায় আলেম-ওলামা মাঠে নামলে তাদের আবার ‘বিএনপি-জামাতের দালাল কিংবা স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি’ বলে হেয় করা হবে।
আচ্ছা, তাহলে বলুন তো- ইতোপূর্বের এমন একটা সাধারণ ধর্ষণের ঘটনার কথা উল্লেখ করুন, যেই ঘটনায় ধর্ষকদের বিচার চেয়ে ওলামায়ে কেরাম দেশব্যাপী আন্দোলন করেছেন? কেউ এরকম একটা উদাহরণ দেখাতে পারবেন?
আচ্ছা, গত বছর নোয়াখালীতে একজন কুরআনের হাফেজা ও মহিলা কওমি মাদরাসার শিক্ষিকা যে ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন, সেই ইস্যুতে ওলামায়ে কেরামের ভূমিকা কী ছিল?
সেই নির্যাতিত বোন তো কওমি ঘরানার। কওমি ওলামায়ে কেরাম আন্দোলন করে নিজ ঘরানার মেয়েটার ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকারটুকুও কি নিশ্চিত করতে পেরেছেন? এই ঘটনার কোনো খোঁজখবর তারা আদৌ রেখেছেন কি?
অথচ জাতিসংঘের সিডও সনদের আলোকে নারীনীতি প্রণয়ন করা হলে সে ওলামায়ে কেরামই তীব্র আন্দোরন গড়ে তোলেন। কারণ, সেখানে পুরুষতান্ত্রিক স্বার্থ আছে!
খেয়াল করবেন, ইসলামবিরোধী নারীনীতি বাতিলের দাবিতে তাদের আন্দোলনের মূল ফোকাস হলো, উত্তরাধিকার সম্পদ বণ্টনে নারী-পুরুষের সমানাধিকারের বিরোধিতা। সন্দেহ নেই- এটা নারীনীতির একটা ইসলামবিরোধী ধারা। এর প্রতিবাদ যৌক্তিক। এখানে অন্যান্য বিষয়ও আছে, তবে তাদের মূল ফোকাস এটা।
ভারসাম্য বজায় রেখেই নারী ও পুরুষ উভয়ের স্বার্থ রক্ষা করেছে ইসলাম। বৈষম্য করেনি। কিন্তু ইসলাম কর্তৃক নির্ধারিত পুরুষের স্বার্থ ক্ষুণ্ন হতে দেখলেই আলেমগণ রাজপথে আন্দোলনে গর্জে ওঠেন। পক্ষান্তরে, ইসলাম কর্তৃক নির্ধারিত নারীর হক ও অধিকার রক্ষায় তারা বেমালুম চুপ থাকেন বা এড়িয়ে যান! কী আশ্চর্য!!
মিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন হলো, ইসলাম কর্তৃক নির্ধারিত নারীর অধিকার রক্ষায় এবং নারীর প্রাপ্য আদায়ে আমাদের ওলামায়ে কেরামের রাজনৈতিক ভূমিকা কতটুকু দৃশ্যমান?
যেমন, ইসলামের নির্ধারিত নারীর মোহরানা যথাসময়ে পরিশোধ করা হচ্ছে না বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই। ঝুলিয়ে রাখা হয়। শরিয়ার দৃষ্টিতে এ ব্যাপারে কঠোর সতর্কতা রয়েছে। সো, এটা মামুলি বিষয় না।
এই লেখাটা যারা পড়ছেন, তাদের মধ্যে যারা বিবাহিত, তাদের মধ্যে কয়জন আছেন যে- বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবেন- আপনার স্ত্রীর মোহরানা ইতোমধ্যে পরিপূর্ণভাবে পরিশোধ করেছেন? গুটিকয়েক অবশ্য ব্যতিক্রম থাকবেন জানি। কিন্তু ব্যতিক্রমকে উদাহরণ হিসেবে গণ্য করা হয় না।
এছাড়া, উত্তরাধিকার সম্পত্তি বণ্টনে ইসলাম মোতাবেক নারীর প্রাপ্যটুকুও কি ঠিকমতো পুরুষ ভাইয়েরা তাদের সহোদরা বোনদের বুঝাই দেন? বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এ জায়গায় মুসলিম নারীরা বঞ্চিত হন। আরে ভাই, যতই এড়িয়ে যান। লাভ নাই। আল্লাহর কাছে তো জবাবদিহি করতে হবে একদিন!
ধর্ষণ, যৌতুক ও নারী নির্যাতনের কথা নাহয় বাদ দিলাম। কিন্তু নারীর প্রতি এসব গুরুতর বৈষম্য ও জুলুমের বিরুদ্ধে এবং ইসলাম মোতাবেক নারীর মৌলিক প্রাপ্য ও হকটুকু নিশ্চিতকরণে আইন করার পক্ষে তারা কোনোদিন আন্দোলন করেছেন? করেন নাই। অথচ এগুলো নিয়ে আন্দোলন জরুরি ছিল।
যদি এমন চিত্র হতো যে- ইসলাম প্রদত্ত নারীর অধিকার ও প্রাপ্য রক্ষার্থে ধর্ষণের বিরুদ্ধে এবং ধর্ষকদের শাস্তির দাবিতে, নির্যাতিত মা-বোনদের ন্যায়বিচার প্রাপ্তির স্বার্থে ওলামায়ে কেরাম আন্দোলন করতেন, তাহলে সেকুলার নারীবাদীদের আস্ফালন বহু-বহু আগেই মার খেয়ে যেতো। উলামায়ে কেরাম প্রশংসা পেতেন সমাজের সর্বস্তরের মানুষের।
এখন কেউ কেউ বলবেন, ওয়াজ-মাহফিলে ওলামায়ে কেরাম তো এসব বিষয়ে বয়ান করেই থাকেন। আপনার কি সেসব চোখে পড়ে না?
চোখে পড়ে। আচ্ছা, শুনেন, তাহলে নারী-পুরুষের সমানাধিকারের প্রশ্নে রাজপথে আন্দোলন না করে ওয়াজ-মাহফিলে বয়ান করার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেই তো হয়! তখন রাজপথ কাঁপানোর দরকারটা কী? নিজেদের পুরুষতান্ত্রিক স্বার্থের বেলায় এত স্বার্থপরতা কেন? ইসলাম তো স্বার্থপরতার শিক্ষা দেয় না।
পুরুষের স্বার্থ ক্ষুণ্ন হলেই সেটা ইসলামবিরোধী, কিন্তু নারীর অধিকার ও স্বার্থ ক্ষুণ্ন হলে সেইটা কি ইসলামবিরোধী হয় না?
সুতরাং, ইসলামের নির্ধারিত নারীর অধিকার ও প্রাপ্য রক্ষায়ও ওলামায়ে কেরামকে একইসাথে রাজনৈতিক ভূমিকা পালন করতে হবে। এটাও তাদের ঈমানি ও নৈতিক দায়িত্ব।
(লেখাটি একান্তই লেখকের ব্যক্তিগত মতাত)
আরআর