পলাশ রহমান
ইতালি থেকে
দেশ একটি ‘নিয়ন্ত্রিত’ নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে তা সবাই আঁচ করতে পেরেছিল। প্রশ্ন হলো- সাধারণ মানুষ এই সরল সমীকরণ বুঝতে পারলো, রাজনীতিকরা বুঝতে পারলেন না? তিনবার ক্ষমতায় আসা দল বিএনপিও বুঝতে পারলো না?
আমার ধারণা রাজনীতিকরা সরকারের মনোভাব বুঝতে পেরেই বিনা শর্তে নির্বাচনে যাওয়ার ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত নেন। দেশে রাজনীতির স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে চেষ্টা করেন।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারী নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আমরা অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের ট্রাক থেকে ছিটকে পড়েছিলাম। বিএনপিসহ অন্যান্য বিরোধী দলগুলো এই বাস্তবতা বুঝতে পেরেই নির্বাচনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। তারা সরকারকে এক বিরাট সুযোগ করে দেয় গ্লানি মুছে ফেলার।
কিন্তু হতাশার কথা হলো সরকার সুযোগটা কাজে লাগাতে পারলো না। ক্ষমতার মোহ তাদের সব অর্জন কেড়ে নিলো।
সচেতন মহল মনে করেন, এ নির্বাচনে বিরোধী দলগুলো হারেনি, হেরেছে বাংলাদেশ। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর ক্ষতি হয়নি, হয়েছে স্বাধীনতার নেতৃত্ব দেয়া দল আওয়ামী লীগের। দলটির ভবিষ্যৎ রাজনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
কারণ এ নির্বাচন দেশের যুব সামাজের কাছে আওয়ামী লীগ সম্পর্কে কোনো ভালো বার্তা দিতে পারেনি।
একাদশ জাতীয় নির্বাচনে অংশ নেয়া দলগুলোর মধ্যে সবচেয়ে লাভবান দল হলো ইসলামি আন্দোলন বাংলাদেশ। এ নির্বাচনের মাধ্যমে তাদের সবচেয়ে বড় অর্জন হলো দলটাকে একদম তৃণমূলে নিয়ে যেতে পেরেছে, যা গত ৩১ বছরেও সম্ভব হয়নি।
দেশের সব মানুষ এখন জানে হাতপাখা ইসলামি আন্দোলনের নির্বাচনী প্রতীক। হাতপাখারা আওয়ামী লীগ বিএনপি সাথে নেই। তারা বাংলাদেশে ইসলামি আদর্শের স্বতন্ত্র শক্তি হিসাবে নির্বাচনী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে চেয়েছিল।
নিজেদের জনসমর্থন দেখতে এবং দেখাতে চেয়েছিল। সম্ভব না হওয়ার দায় তাদের নয়, গোটা জাতির।
ইসলামি আন্দোলনের নির্বাচনী ইশতেহার এখন দেশের বুদ্ধিজীবীদের পড়ার টেবিলে জায়গা করে নিয়েছে। এর মাধ্যমে সুশীল সমাজ জানতে পেরেছে ইসলামি আন্দোলনের রাজনৈতি চিন্তা-চেতনা। তাদের সম্পর্কে দেশবাসী এখন যতোটা স্বচ্ছ ধারনা পেয়েছে কিছু দিন আগেও তা ছিল না।
এ নির্বাচনের মধ্যদিয়ে ইসলামি আন্দোলন গণমুখী রাজনীতির ট্রাকে উঠে পড়েছে। এখন শুধুমাত্র ধারাবাহিকতা রক্ষা করা দরকার। গণমানুষর সাথে মিশে যাওয়া দরকার। তাদের সুখে দুখে পাশে থাকা দরকার। আনন্দ বেদনার ভাগিদার হওয়া দরকার। মেহেনতি মানুষের নিত্য জঞ্জাল সরাতে গণমুখী কর্মসূচি গ্রহণ করা দরকার।
সহজ কথা হলো দৃশ্যমান জনসেবায় নেমে পড়া দরকার। আর তা পারলেই হাতপাখা হয়ে উঠবে দেশের শান্তিপ্রিয় গণমানুষের আস্থার প্রতীক।
দেশের বিভিন্ন জায়গায় আন্দোলনের কর্মীদের উপর নির্বাচনী হামলা হয়েছে। বরিশালে নারীসহ প্রায় এক ডজনেরও বেশি কর্মী জখম হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে।
আমি খবর নিয়ে জেনেছি, বাংলাদেশের আর কোথাও না হোক- বরিশালে তারা এর কড়া জবাব দিতে পারতো, কিন্তু তা করেনি। কোনো হঠকারি সিদ্ধান্ত নেয়নি। তাদের ধর্য এবং বিচক্ষণতা দেশবাসী দেখেছে।
এবারের নির্বাচনে যে কটা আসন দেশি বিদেশিদের বিশেষ নজরদারিতে ছিল তার মধ্যে অন্যতম একটি বরিশাল ৫ আসন। এর একমাত্র কারণ ওই আসনের বিপুল সম্ভাবনাময় প্রার্থী ছিলেন সৈয়দ ফয়জুল করিম।
ওখানে যদি আন্দোলনের নেতাকর্মীরা কোনো অপ্রীতিকর ঘটনায় জড়িয়ে পড়তেন তবে দেশি বিদেশি মিডিয়াগুলোর রোষানলে পড়তো ইসলামি আন্দোলন। ইসলামের চেতনা বিরোধীরা সৈয়দ ফয়জুল করিমকে জঙ্গিনেতা বানিয়ে ছাড়তো। তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের বারোটা বাজাতে সর্ব শক্তি নিয়ে ঝাপিয়ে পড়তো।
সৈয়দ ফয়জুল করিম তার উন্নয়ন পরিকল্পনা তুলে ধরতে গিয়ে এক নির্বাচনী সমাবেশে বলেছিলেন, ক্ষমতায় গেলে উন্নয়নের জন্য একশ বছরের পরিকল্পনা হাতে নিয়ে কাজ শুরু করবেন। দেশবাসী তার কথার বাস্তবায়ন দেখতে চায়।
একশ বছরের উন্নয়ন পরিকল্পনা ঘোষনা করুন। ক্ষমতার বাইরে থেকে যেগুলো বাস্তবায়ন করা সম্ভব সেগুলো আলাদা করুন এবং কাজে হাত দিন। দেশের মানুষ আপনাদের দক্ষতা যোগ্যতা এবং আন্তরিকতার প্রমান চায়।
নেতাকর্মীদের মান উন্নয়নের জন্য বেশি বেশি হোমওয়ার্ক করুন। ছায়া মন্ত্রীপরিষদ গঠন করুন। প্রত্যেক মন্ত্রনালয়ের জন্য ছোট ছোট টিম গঠন করুন। রাষ্ট্রের প্রয়োজনে গড়ে ওঠা প্রতিটি প্রতিষ্ঠান নিয়ে ব্যাপক হোমওয়ার্ক করুন। প্রতিটি দপ্তরের জন্য যোগ্য মানুষ তৈরির কাজে হাত লাগান।
এবারের নির্বাচন থেকে অর্জিত অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে এখন থেকেই ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ শুরু করুন। ভালো মানের প্রার্থী তৈরী করার পদক্ষেপ নিন। ক্ষমতার বাইরে থেকেই জনকল্যানে আপনাদের যোগ্যতা তুলে ধরতে পারলে শুধু ভোট বিপ্লব নয়, গণবিপ্লব সৃষ্টি করাও অসম্ভব হবে না।
নিয়ন্ত্রিত নির্বাচন অনেক যুবক কে হতাশ করেছে। আমি বলবো আদর্শবাদী বা বিপ্লবীরা কখনো হতাশ হয় না। বাধা বিপত্তি থেকে অভিজ্ঞতা অর্জন করে এবং পরবর্তিতে তা কাজে লাগায়। একজন মুফতি ফয়জুল করিম নয়, সারা দেশে অন্তত তিনশ ফয়জুল করিম তৈরি করুন। কেউ আপনাদের বিজয় কেড়ে নিতে পারবে না।
দেশবাসী নবউদ্যাম দেখতে চায়। গণমানুষ প্রত্যাশা করে ইসলামি আন্দোলন যেনো গণমুখী রাজনীতির এই পথ থেকে যেনো সরে না যায়। যদিও এই পথ অনেক পিচ্ছিল, তবু আদর্শ এবং যোগ্যতার সাথে নিজেদের টিকিয়ে রাখতে পারলে বিজয় আসবেই।
দেশের সচেতন মহলের কাছে বার্তা পৌছে গেছে, ইসলামি আন্দোলন দেশের একমাত্র রাজনৈতিক দল যারা ইসলাম এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করে রাজনীতি করে। আত্মশুদ্ধি এবং প্রতিরোধের সমন্বয়ে স্বতন্ত্র রাজনীতি করে। এ দলের নেতাকর্মীরাই সত্যিকারের দেশপ্রেমিক।
নিন্দুকের কথায় কান না দিয়ে এখন শুধু গণমুখী রাজনীতির ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে হবে। জনগণের কাছাকাছি থাকতে হবে। গণবিপ্লবের জন্য এটাই সঠিক পথ।
কারো কথায়, প্ররোচনায় বিভ্রান্ত হওয়ার কিছু নেই। তবে সতর্ক থাকা জরুরি। নেতাকর্মীদের মনোবল ভেঙ্গে দিতে, নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করতে গভীর ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে। এসব ষড়যন্ত্রে শতকোটি টাকা লগ্নি করারও মানুষ প্রস্তুত আছে। অন্য এক সময়ে এ বিষয়ে লিখবো বিস্তারিত।
লেখক: ইসলামী রাজনীতি বিশ্লেষক