সুফিয়ান ফারাবী
ভ্রাম্যমাণ প্রতিবেদক
প্রচণ্ড খিদে নিয়ে চা দোকানে ঢুকলাম। পকেটে টাকা থাকলেও আশেপাশে ভালো খাবারের দোকান চোখে পড়লো না। তাই একপ্রকার জোর করেই ঢুকে পড়লাম আবু বকর টি স্টলে। এককাপ চাসহ হালকা নাশতা সেরে উঠতে যাবো এমন সময় দেখলাম, দোকানের বাইরে বৃদ্ধ একজন লোক দাঁড়িয়ে আছেন। কিছু একটা বলতে চাচ্ছেন, কিন্তু বলছেন না।
চোখে চোখ পড়তেই মৃদু হাসি দিলেন। তাঁর হাসি শত আবদারের হাসি। মানে কিছু চান এমন একটা হাসি। ভালো করে দেখে বুঝলাম লোকটি দিনমজুর। বছরখনেক আগে একটা কাজে এনেছিলাম তাকে। সবসময়ই হাসি খুশি থাকেন। বাচ্চাছেলেদের সাথে দুষ্টুমিতে মগ্ন থাকেন।
আমি বললাম, চাচা কিছু বলবেন?
ইতস্তত করলেন। কিছু বললেন না। আমি জিজ্ঞেস করলাম, দুপুরে খেয়েছেন?
এই প্রশ্নে তিনি কিছুটা সাহস পেলেন বলে মনে হলো৷ সঙ্গে সঙ্গেই বললেন, না বাবা। সারাদিন কাগজ টুকাইতে অয়। খামু কহন? আর খামুও বা কী?
কথাটা শুনে আমার খুব খারাপ লাগলো। মনে মনে ভাবলাম, উনার ছেলেমেয়েরা কোথায়, তারা দেখে না, তাদের বাবা কাগজ টোকায়?
লোকটিকে পাশে বসিয়ে এককাপ চা আর একটা রুটি খেতে দিয়ে বললাম, আপনার গ্রামের বাড়ি কোথায়? কবে এসেছেন ঢাকায়? ছেলেমেয়ে কজন? তারা কী করে?
তিনি বললেন, গেরামের বারি তো বরিশাল। দশ বছর আগে ডাহায় আইছি। আগে কামলা দিতাম, সারাদিন খাইটা ৩০০-৪০০ টাহা লইয়া ঘরে যাইতাম। এহন বুইরা অইয়া গেছি। কন্ট্রাক্টাররা আপনেগো মতো জোয়ান পোলা খোঁজে। আমাগরে নিতে চায় না। আর নিলেও ২০০ টাহা আতে দরায়া দেয়।
বাড়িতে বউ আছে। হেয় মাইনসের বাসায় কাম হরে। প্রতিমাসে দুই হাজার টাহা ঘর ভাড়া দিতে অয়। আমার বউ কাম কইরা এই দুই হাজার টাহা দেয়। বড় মাইয়াডারে বিয়া দিছি। জামাই অটো চালায়। বাসায় ছোড আরেকটা পোলা আছে। সারাদিন কাগজ টুকায়া যা পাই তা দিয়া টুকটাক বাজার করি। তয় আল্লায় ভালাই রাখছে। সুখেই আছি কইতে পারুম।
পাঁচ দিনের সফরে বাংলাদেশে আসছেন দেওবন্দের শায়খে সানী
বলছিলেন আবদুস সালাম। মানুষটাকে পেশাজীবি বলা যাবে কিনা জানি না। যদি যায় তাহলে তাঁর পরিচয় তিনি একজন টোকাই। শুনতে খারাপ শোনালেও এটাই সত্য। বয়স ৬০। সাভারের কোনো এক বস্তিতে নীড় সাজিয়েছেন। সকালে বস্তা নিয়ে বের হন কাগজ, প্লাস্টিকের খোঁজে। মানুষের বাড়ির ডাস্টবিনে ডাস্টবিনে ঘুরে দুবেলা খাবার জোটান। কখনো কখনো জোটাতে পারেন না। তবে তাঁর এই অবস্থাতেও তিনি খুশি। আল্লাহর উপর সন্তুষ্ট। কোনো অভিযোগ নেই প্রভুর দরবারে।
তাঁর বিল পরিশোধ করে দোকান থেকে বের হলাম। কান্নায় বুকটা ফেটে যাচ্ছিল। কারণ রুটি আর চা খেয়ে আল্লাহর দরবারে হাত উঠিয়ে যেভাবে ভক্তি করে দোয়া করলেন তাতে লোকটির কৃতজ্ঞতার পুরোটাই প্রকাশ পেয়েছে। মাত্র তেত্রিশ টাকায় যে দোয়া পেলাম, তাতে মনটা ভরে গেল। রাস্তা দিয়ে হাঁটার সময় মনে মনে বললাম, তবুও হাসুক আবদুস সালামরা।
যখন আজাব আসে, পাশের শহরকেও ছাড়ে না
এসএস