হাসান আল মাহমুদ
আওয়ার ইসলাম
দীর্ঘ ৩০-৩৫ বছর পর পাকিস্তান ও বাংলাদেশের দুই তরুণ আলেমের সহযোগিতায় আপন পরিবার ফিরে পেলো এক বাংলাদেশী মহিলা। মহিলাটির নাম যাহেদা খাতুন।
বাংলাদেশের ঝিনাইদহ জেলার (জেলা শহরে) ভুটিয়ারগাতী গ্রামের এই মহিলাকে ১৯৮০ সালের দিকে একদল নারী পাচারকারী দালাল বাংলাদেশের তখনকার যশোর জেলাধীন ঝিনাইদহ থেকে অপহরণ করে পাকিস্তানের করাচী শহরে বিক্রি করে দেয়।
সেই থেকে আজো (২০১৮) অবধি পাকিস্তানের নানা হাতে হস্তান্তর হতে হতে অবশেষে পাকিস্তানি তরুণ আলেম মাওলানা ওয়ালীউল্লাহ্ মারূফ ও বাংলাদেশী তরুণ আলেম মাওলানা মঞ্জুর আহমাদের সহযোগিতায় জাহেদা খাতুন তার পরিবার ফিরে পেলো।
মঞ্জুর আহমাদের সূত্রে জানা যায়, জাহেদার বিয়ে হয় এক যুবকের সাথে। কিন্তু এই যুবক পূর্ব বিবাহিত ছিল যা জাহেদার পরিবার জানত না। তবে, তার স্বামী তাকে ভালবাসতো। কিন্তু তার সতীন, ননদ ও শ্বশুর শাশুড়ি এ বিয়েটা মেনে নেয়নি। ফলে তারা এক গভীর ষড়যন্ত্র করে। সহজ সরল জাহেদা যা কল্পনাও করতে পারেনি। কোন মানুষের চিন্তাও সে পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে না।
তারা ষড়যন্ত্রের নকশা আঁকল বিদেশ পাচারকারী চক্রের সঙ্গে। একদিন জাহেদাকে বাজারে নিয়ে গেল। জাহেদা যা ভাবেনি সেই জঘন্যতম কর্মটিই তারা করল। জাহেদার খাদ্যে নেশা জাতীয় কিছু মিশিয়ে তাকে পান করাল। জাহেদার কোলে তার ছোট শিশুটিও ছিল। তারা শিশুটিসহ তাকে বিক্রি করে দিল। বাচ্চাটির নাম ছিল রমজু / রঞ্জু।
জাহেদাকে অচেতন করে দালাল চক্রটি পাকিস্তানের করাচি নিয়ে যায়। সেখানে ভাগ্য বিড়ম্বনায় জাহেদা এক হাত থেকে অন্য হাতে স্থানান্তর হতে লাগল।
জাহেদা এখন কেনা গোলাম। তার কথা কে শুনবে? বাংলায় কথা বলা জাহেদা কাউকে কিছু বলে বুঝাতেও পারে না। জাহেদা তার কাছেই সব বলল, যিনি সকল ভাষা বুঝেন যিনি সকল ভাষার স্রষ্টা।
একদিন পাকিস্তানের এক আলেম তাকে দেখতে পেলেন। তাকে তার মালিকের কাছে কিনে আনেন। বাংলাদেশে ফিরে আসার কোন ব্যবস্থা না করতে পেরে তিনি জাহেদাকে তার সম্মতিতে এক পাকিস্তানি যুবকের সাথে বিয়ে করিয়ে দিলেন। জাহেদার জীবনে একটু স্বস্তি ফিরে এল। কিন্তু অন্তরে তার নিজ দেশ, মা, বাবা, ভাই বোনের প্রতিচ্ছবি ভাসছিল।
এভাবে ত্রিশ থেকে পঁয়ত্রিশ বছর কেটে যায় জাহেদা খাতুনের জীবন। জাহেদা উর্দুতে কথা বলে। যেন সে এক পাকিস্তানি মহিলা। ভুলে গেছে বাংলা ভাষা তবে অন্তরে থাকা দেশের মমতা ভুলতে পারেনি। কিন্তু জাহিদা জানে না কিভাবে সে তার দেশ বাংলাদেশে ফিরবে।
জাহেদা খাতুন কিভাবে তার পরিবার ফিরে পেলো সে বিষয়ে মঞ্জুর আহমাদ জানান, জাহেদা খাতুন সবসময় দেশে ফেরার আক্ষেপ করতেন লোকজনের কাছে। তার একটাই আশা, যেন মৃত্যুর পূর্বে তাঁর মা, বোন ও ভাইদের সাথে একবার সাক্ষাৎ হয়।
তার এ আশা পূরণ করতে পাকিস্তানের যেখানে তিনি বাস করেন, সেখানকার এক প্রতিবেশী তরুণ আলেম ওয়ালিউল্লাহ্ মারূফ উদ্যোগ নিলেন জাহেদা খাতুনকে তার আত্মীয় স্বজনের কাছে ফিরিয়ে দেয়ার। তিনি উর্দু ভাষায় যাহেদা খাতুনের বিস্তারিত বিবরণ লিখে তার ফেইসবুক আইডিতে পোস্ট করলেন।
মঞ্জুর আহমাদ জানান, পাকিস্তানের ওয়ালীউল্লাহ্ মারূফ নামে সেই ভায়ের আইডি থেকে ফেসবুকে জাহেদা খাতুনের সমস্ত বিবরণ নিয়ে লেখা একটি পোস্ট ঘুরতেছিল। ফেসবুকের এক ওয়াল থেকে অন্য ওয়ালে ঘুরতে ঘুরতে পোস্টটি আমার নজরে আসে। আমি তার কাহিনী পড়তে পড়তে সংকল্প তার আত্মীয় স্বজনকে খোঁজে বের করব।
মঞ্জুর আহমাদ বলেন, ওয়ালীউল্লাহ মারূফের সাথে ফেসবুকে তার সম্পর্কে আরো তথ্য নিই। কিন্তু তার দেয়া তথ্য গুলো পুরোপুরি মিলছিল না। তার গ্রামের নাম লেখে গুগল ম্যাপসহ সবজায়গায় সার্চ করতে লাগলাম কিন্তু কোন ক্লু পাচ্ছিলাম না। কারণ, মহিলার থেকে শোনা মারূফ ভায়ের দেয়া ঠিকানাটা ছিল আগের। এখনতো ঝিনাইদহ স্বতন্ত্র জেলা হল।
পরে, আশেপাশে যারা ছিল সবাইকে জিজ্ঞেস করতে লাগলাম। কেউ নিশ্চিত তথ্য দিতে পারছিলেন না। সবার দেয়া তথ্য একত্র করে মোটামুটি আমি সেই গ্রামটির পাশে থাকা একটা ব্রীজকে চিহ্নিত করি।
এই খোঁজ-তল্লাশির চিন্তা আমার ঘুম কেড়ে নিয়েছিল। ঘুমালেই স্বপ্ন দেখি মহিলার আত্মীয় স্বজন খোঁজে বেড়াচ্ছি। ইতোমধ্যে ওয়ালিউল্লাহ ভাই একটা ভিডিও ক্লিপও পাঠালেন। যা দেখে আমি শিউর হলাম যে এবার রওয়ানা করা যায়।
কিন্তু আমার হাতে কোন টাকাও ছিল না। বড় দুর্দিন চলছিল। সন্ধ্যার পর পাকিস্তানের ভাইয়ের সাথে বললাম ইনশাআল্লাহ কাল রওয়ানা করব। আল্লাহর সাহায্য আসতে শুরু করল, আলহামদুলিল্লাহ আমি একজন থেকে পাঁচশ টাকাও পেয়ে গেলাম।
সকাল বেলা না খেয়েই বেড়িয়ে পড়লাম। নেটে খোঁজ করে সেই গ্রামের কয়েকজনের নাম্বারও পেয়েছিলাম কিন্তু কেউ কল রিসিভ করেনি।
ওয়ালীউল্লাহ ভাই আমাকে রবিউল নামে এক ভাইয়ের নাম্বার দিল সে নাকি ভুটিয়ারগাতী মাদরাসায় পড়াশুনা করে। কল করার পর জানাল সে এখন আর সেখানে থাকে না। বললাম গ্রামের অন্য কারো নাম্বার থাকলে দাও। সে আবুবকর নামে এক লোকের নাম্বার দিল যাতে কল করতে করতে আমার চার্জ শেষ করে ফেললাম তবুও তিনি কল ধরলেন না।
মঞ্জুর আহমাদ বলেন, আল্লাহর ভরসায় বেড়িয়েছিলাম তাই আল্লাহ সাহায্য করলেন। আমার পাশের সিটে বসা একভাইকে বললাম যিনি ঝিনাইদহ যাচ্ছিলেন। ঝিনাইদহের ভুটিয়ারগাতী গ্রাম চিনেন? তিনি বললেন, হ্যাঁ। আমার থেকে সব কথা শুনে বললেন, যদি আপনি আমাকে আধঘন্টা সময় দেন। আমিও এই মহৎ কাজে শরীক হতে চাই।
তারপর সেই ভাইকে নিয়ে ভুটিয়ারগাতী গ্রামে গেলাম। ভাইটির নাম ছিল আতিক। আমরা হাটতে হাটতে খোঁজ করতে ছিলাম। সবাইকে জিজ্ঞেস করছিলাম কেউ তাদের চিনতে পারছিল না।
হঠাৎ সুসংবাদ মিলল। একজন বয়োবৃদ্ধ বললেন, চিনতে পেরেছি, কিন্তু আপনাদের দেয়া তথ্য ঠিক নেই। এজন্য কেউ চিনতে পারতেছে না। আমি খুশিতে আতিক ভাইকে জড়িয়ে ধরলাম।আল্লাহর শোকর আদায় করলাম। আল্লার সাহায্য ছাড়া এটা সম্ভব ছিল না।
আমরা চলছিলাম, তখন দেখতে দেখতে গ্রামের লোক আমাদের সাথে এসে মিলিত হচ্ছিল যেন এক খুশির মিছিল হচ্ছে।
সে গ্রামের অনেক লোক এখন আমাদের সাথে। আমরা গেলাম জাহেদা খাতুনের বাড়ি। জাহেদা খাতুনের মায়ের সাথে সাক্ষাৎ করে জানাই, আমি আপনার মেয়ে জাহেদার সংবাদ নিয়ে এসেছি।
তিনি কিছুটা নীরব রইলেন। কোন কথা বলতে পারছিলেন না। আমি বুঝতে পারছিলাম আবেগে স্মৃতিচারণ করে বেড়াচ্ছিলেন। একসময় কেঁদে ওঠলেন। আমার জা হে দা! জা হে দা!
তারপর পাকিস্তানি ভাই (ওয়ালীউল্লাহ্ মারূফ) কে ভিডিও কল দিয়ে জাহেদা খাতুনকে তার মা ও বোন শাহেদার সাথে কথা বলিয়ে দিলাম। আমি সেখানকার কয়েকজনের মেসেঞ্জার নাম্বার সংগ্রহ করে দিয়ে চলে এলাম। ভাবছিলাম এটা যেন ইয়াকুবের সাথে ইউসুফের সাক্ষাৎ।
পাকিস্তানের ভাইকে বললাম এরা খুব গরীব তারা উনাকে পাসপোর্ট ভিসা করে আনার সামর্থ্য রাখেন না। আপনারা আরেকটু কষ্ট করবেন আশাকরি।
মঞ্জুর আহমাদ জানান, পাকিস্তানি সেই ওয়ালীউল্লাহ্ মারূফ ভাই সেখানে জাহেদা খাতুনের নামে একটি ফান্ড তৈরি করেছেন। অতি শিগগির তাকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠাবেন।
২০ দলীয় জোট যোগ দিল আরও তিনটি দল