আলী আবদুল মুনতাকিম
প্রকৌশলী ও কুরআন গবেষক
ছোট্ট বেলায় যার কাছে কোরান শিখেছি, নামাজ শিখেছি , আদব-কায়দা যিনি শিখিয়েছেন, জন্মের সময় দোয়া করেছেন, বিবাহ পড়িয়েছেন, আমার বাবা-মায়ের জানাজা পড়িয়েছেন, আমার ও জানাজা পড়াবেন, প্রতিদিন যার পেছনে নামাজ পড়ি, যার কাছে মাসালা জিজ্ঞেস করি, অসুখে দোয়া চাই, প্রতি জুমায় যাদের খুতবা শুনি, চাদর গায় দিয়ে শীতের রাতে দূরান্তের মাঠে বসে যাদের ওয়াজ শুনি, ভবন-রাস্তা, স্থাপনা উদ্বোধনে যাকে দোয়ার জন্য ডাকি, যাদের মুনাজাতে মাওলার ভয়ে চোখের পানি ভাসিয়ে কাঁদি, সেই তারা বা তাদের অত্যন্ত সুকৌশলে কি বিতর্কিত বা অজনপ্রিয়, বা মানুষের মন থেকে মর্যাদার আসন কেড়ে নেয়া হচ্ছে, নাকি তারা নিজেরাই লোভে পড়ে সব খোয়াতে বসেছেন, নাকি ভুল করে নিজেদের পায়ে কুড়াল মারছেন অবিরত, নাকি আমরা সাধারণেরাই কিছু বুঝতে অক্ষম।
যেমন তাবলিগে তেমনই কওমি অঙ্গনে এখন ঝড়-তুফান চলছে। এক গ্রুপ আরেক গ্রুপের বিরুদ্ধে আদাজল খেয়ে নেমেছে। কোমর ভেঙে যাওয়া জামায়াত, আনন্দে উদ্বেলিত চরমোনাই মিটিমিটি হাসছে। হায় মুসলমান!
তাবলিগের দেওবন্দ গ্রুপ আর সাদ গ্রুপ এর ঝগড়ায় অতিষ্ঠ হয়ে ফেসবুকের এক পোস্টে একজন লিখেছেন, ‘জায়গায় জায়গায় ওজাহাতি, তাবলীগ ধ্বংসের লালবাতি। অতিরিক্ত মাতামাতি, বলতে গেলেই হাতাহাতি।
খুরুজ কিন্তু টলমল, গীবত শেকায়েত জ্বলমল। মারকাজ দেখলে বেপরোয়া, কচিকাচা তলাবারা।’
তাবলীগের আমির সাদ সাহেব জোর করে মজলিশে সুরার নিয়ম ভেঙে ক্ষমতায় আছেন, হাদিসের ভুল ব্যাখ্যা দিচ্ছেন এই অভিযোগে তার এতায়াত বন্ধ করে দিয়েছেন দেওবন্দ তথা কওমিপন্থীরা।
ইজতেমা পর্যন্ত দুই ভাগ হয়ে যাচ্ছে। কাকরাইল তুরাগ এখন দুই চেহারা। এখন মসজিদগুলোতে গাশতের বদলে সাথীরা গীবতে কলহে সময় পার করছেন। কমে যাচ্ছে দাওয়াত। ক্ষতিগ্রস্থ সাধারণ মানুষ। মনে হচ্ছে ইসলামের মূল স্পিরিট এরা বুঝেন নাই।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কওমি সনদের স্বীকৃতি একটি যুগান্তকারী ঘটনা এবং ইতিহাসের মাইলফলক। তাকে যথাযথ সম্মানও জানানো হয়েছে।
কওমি সনদের সরকারি স্বীকৃতি ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে শোকরানা মাহফিলের মাধ্যমে ধন্যবাদ জানানোকে কেন্দ্র করে যেভাবে আালেম ওলামা নিজেদের মধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিন্দা ও গীবত চর্চা বা যে ভাষা ব্যবহার হচ্ছে তাতে আলেমগণের তাকওয়া, পরহেজগারী, নির্লোভ, নিঃস্বার্থবাদিতা, দ্বীনের খেদমতে খুলুসিয়াত, সততা, ক্ষমতার লোভ, ক্যামেরায় চেহারা দেখাবার মানসিকতা, ইত্যাদি নিয়ে মানুষের মাঝে কানাঘুষা, কদর্য ভাষা ব্যবহার, তর্ক-বিতর্ক শুরু হয়েছে।
যোগাযোগ মাধ্যমের বিশেষ করে ফেসবুকের কথাগুলো উল্লেখ করতে গেলে আওয়ার ইসলামের পুরো স্পেস শেষ হবে, হাজার হাজার পৃষ্টা হবে। শুধুই বলব ছিঃ এগুলো কি শুরু করেছেন আপনারা?
দেশবরেণ্য আলেম-ওলামাদের ব্যক্তিগত বিষয়গুলো পর্যন্ত বাদ যাচ্ছে না। কিছু অনলাইন পত্রিকা তো তালি বাজিয়ে যাচ্ছে। একটি পত্রিকা জরিপ করে বলেছে অমুক মাদরাসার প্রধান ও মহাপরিচালক বেতন নেন ৯০,০০০/-টাকা তার ছেলেকে দেন ১৬,০০০/ টাকা, অথচ অন্য শিক্ষকরা বেতন নেন ৬ থেকে ১০,০০০/- টাকা।
কোন অডিট নাই। অমুক এবং অমুক কওমি বড় নেতাগণ (আমি কার ও নাম বলতে চাই না) এমপি হওয়ার নেশায় পাগল হয়ে গেছেন। বার বার ক্যামেরার সামনে থাকছেন। ছাত্রদের ব্যবহার করছেন, ইতিহাস ভুলে যাচ্ছেন, ইত্যাদি। তারাও আাবার উল্টা ওদের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ আনছেন।
মোটামোটি ৫ টি গ্রুপ তর্কবিতর্কে এগিয়ে আছে।তারা একবার ও ভাবছে না তারা নিজেদের পায়ে কুড়াল মারছে। হাসাহাসি করছে সমালোচকেরা।
একদিকে আল্লামা আহমদ শফি হুজুরের অনুসারী আলেম, ছাত্র-শিক্ষক, ঈমাম, ওয়ায়েজিনগণ। ২য় দিকে আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী ও নূর হুসাইন কাসেমী হুজুরদের অনুসারীগণ। দুই পক্ষের এক দলের যুক্তি মেনে নিলে আরেক পক্ষকে কি বেঠিক বলব? না দু পক্ষই সঠিক। এর ফলাফল কী? আমরা সাধারণ মানুষ এখানে বুঝতে পারি না। শুধু গন্ধ পাচ্ছি।
৩য় পক্ষে আছেন চরমোনাইয়ের অনুসারীগণ, বরং তারাই এখন মজা করে হাস্য রসাত্মক পোস্ট দিচ্ছেন। কারণগুলো সবাই জানেন আমার বলার দরকার নেই।
চতুর্থ হচ্ছে জামায়াতের অনুসারীগণ। তারাও বিতর্কে জড়াচ্ছেন যা কাম্য নয়। শেষোক্ত দুই গ্রুপে নেতারা চুপচাপ। ৫ম গ্রুপটি সুন্নী নামে পরিচিত। যদিও তাদের মধ্যে সুন্নতের কিছুই পরিলক্ষিত নয়। তারা কওমি সনদের কট্টর সমালোচনা করেছিল। তারাও এখন হাস্যরসে লিপ্ত।
এছাড়াও আহলে হাদীস ও পীর দরবারের অনুসারীগণও টুকটাক মন্তব্য করছেন। যা উল্লেখযোগ্য নয়।
অত্যন্ত কঠিন সমালোচনায় নেমেছে দেশের বাইরে থাকা কিছু নাস্তিক। এর মধ্যে মুফতি মাসুদ, পবিত্র কুরানের সুরা ফিলকে ব্যাঙ্গ করে তার পোস্টে লিখেছে, হুবহু তুলে ধরা হল, ‘সুরা অাল ফিল, সুরা নং ১০৫, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অবতীর্ণ, দুপুর বারোটায়। অায়াত সংখ্যা- ৫
আলাম তারা কাইফা ফাঅালা... বিঅাসহাবিল শফি। আলাম ইয়াজঅাল কাইদাহুম ফি বিরানি ওয়াল কফি। ওয়া আরসালা আলাইহিম হুজুরান আবাবিল। তারমিহিম.... মিন সিজ্জিল।ফাজাআলাকুম কা সেলফিম লমাহরুম।’
আহমদ শফি হুজুরকে এবং আল কোরানের সুরাকে এভাবে ব্যাংগ করার মত জঘন্য মানসিকতা একজন প্রাক্তন কওমি ছাত্র কিভাবে করতে পারে? সে হাফেজ ও মাওলানা!
কওমি অঙ্গনে এভাবে ঝগরা চালিয়ে গেলে আরও মাসুদ তৈরি হবে। যার দায় বর্তমান ঝগরায় লিপ্তদের। আচ্ছা ঝগড়া বাদ দিয়ে কাজে নেমে পড়ুন। মাসুম ছাত্রদের অনিশ্চিত ভবিষ্যতে ঠেলে দেবেন না।
মানব সেবা যদি মহান কাজ বা এবাদতও হয়, তাহলে স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা সেবা দিয়ে ডাক্তাররা যে কাজটি করছেন, রাস্তা-ব্রীজ,দালানঘর নির্মাণ করে প্রকৌশলীরা যে কাজটি করছেন, আইনের সেবা দিয়ে আইনজীবীরাা যে কাজটি করছেন, প্রশাসন চালিয়ে আমলারা যে সেবাটি দিচ্ছেন সেখানে কওমি ভাইদের এগিয়ে আসার কি প্রয়োজন নাই?
আতুর ঘরে যে পড়ে আছেন খবর রাখেন? মাঠে বক্তৃতা দিয়ে হাজারো লোকের তালি পেয়ে গদগদ হওয়ার কিছু নাই। চোখ মেলে দেখুন। দুনিয়া কোথায় আপনারা কোথায়!
আপনাদের ঈমাম মেনে যারা পেছনে নামাজ পড়ে তাদের জন্য এই বেদনাদায়ক বিতর্ক মানতে কষ্টকর।
কওমি মাদরাসার মুহতামিম, মুদারিস, শিক্ষক, হাফেজ, খাদেম, ছাত্র ও পরিচালকদের মধ্যে গ্রুপিং ও গীবত-দ্বন্দ্ব এখনই বন্ধ করুন। ইউটিউব খুললে দেখা যায় শুধু হুজুরদের ঝগড়া। খুব ছোটখাট বিষয় নিয়ে। অচিরেই এর অবসান না হলে তা সাধারণ জনগণের মাঝে সংক্রমণ ঘটবে এবং তা ভাল ফল বয়ে আনবে না।
অনেক বড় ক্ষতি হয়ে যাবে। ক্ষতির লিষ্ট বড় করা যাবে। শুধুই একটির কথা বলি। যে কোনো মাদরাসা এলাকার গন্যমান্য, দানবীর, ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষের দানের টাকা অভক্তির কারণে কমে যাবে। ফল হল, মাদরাসার সম্মানিত শিক্ষকদের বেতন প্রদানের কষ্ট। এক পর্যায়ে মাদরাসা বন্ধ।
সুতরাং দয়া করে কলহ বন্ধ করুন। মাদরাসাগুলো বাঁচান।