আলী আবদুল মুনতাকিম
প্রকৌশলী ও কুরআন গবেষক
কওমি স্বীকৃতি তথা দাওরায়ে হাদিসকে মাস্টার্স মর্যাদা দেয়ার জন্য বর্তমান সরকারকে আন্তরিক ধন্যবাদ। অনেক আলেম, শিক্ষক, ছাত্রদের মত আমারও এটা ভাবতে খুবই ভাল লাগছে যে কওমি মাদরাসার আমাদের সন্তানেরা বিনা বাধায় স্বীকৃত সনদ নিয়েই এখন সরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্বস্বাশিত প্রতিষ্ঠানেে চাকরি করবে তথা গ্যাজেটেড অফিসার, কৃষি অফিসার, ব্যাংক অফিসার, আর্মি, পুলিশ, নানাহ দপ্তরের মাঠ কর্মচারি-কর্মকর্তা হতে পারবে।
কোন অভিভাবক তার সন্তানকে আর কওমিতে ভর্তি করানোর আগে ১০ বার চিন্তা করার প্রয়োজন নেই।
কিন্তু যোগ্যতা অর্জন ছাড়া এ স্বপ্ন বাস্তবায়ন যে অনেক কঠিন তা চিন্তা করতেই আমার প্রিয় সম্মানিত পাঠকদের জন্য আজকের লেখা। লেখাটি খানিকটা দীর্ঘ হলেও আশা করি চিন্তার খোরাক পাবেন ইনশাল্লাহ।
মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষকদের/আলেমদের সাথে আমার ভালোবাসা/মহব্বতের বা তাদের খেদমতে নিজেকে উজার করার পেছনে আমার বাবা মরহুম হযরত মাওলানা কেরামত আলীর উৎসাহ তো অবশ্যই রয়েছে।
তিনি কুমিল্লাস্থ নিমসার উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা হেড মাওলানা, শিকারপুর জামে মসজিদের দীর্ঘ ৪০ বছরের খতিব ও বিশিষ্ট মোফাস্সিরে কোরান ছিলেন। ছোট বেলা থেকেই আমার বাবা আলেমদের ভালোবাসতে শিখিয়েছেন।
তাই আলেম, ওলামা বা মাদরাসার কোনো ইস্যুতে এই অযোগ্য আমি আমার চিন্তা প্রকাশ করার চেষ্টা করি, আমার মালিক যদি এর উসিলায় আমাকে ক্ষমা করেন। চলুন মূল আলোচনায়।প্রথমেই আদ্যোপান্ত দেখা যাক।
কওমি মাদরাসাগুলো বর্তমানে সংসদীয় আইনে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত ইসলামি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এ ধারার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সর্বপ্রথম প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৬৬ খ্রিস্টাব্দে ভারতের বিখ্যাত প্রদেশ (যে প্রদেশ আগ্রার তাজমহল, সম্রাট শাহজাহানের বাড়ি, বহমান যমুনার জন্য বিখ্যাত) উত্তর প্রদেশের সাহারানপুর জেলার দেওবন্দ নামক স্থানে ‘আল জামেয়াতুল ইসলামিয়া দারুল উলুম দেওবন্দ’ নামে।
মাওলানা আবুল কাসেম নানুতবি তার শ্বশুরবাড়ির নিকটস্থ দেওয়ান মহল্লার মসজিদের সাথে প্রথম যে মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন তাই পরবর্তীতে কওমি মাদরাসা দেওবন্দ নামে শুরু হয়।
কওমি মাদরাসার-কওম অর্থ জাতি, আর কওমি অর্থ জাতীয়। মাদরাসা শব্দের অর্থ বিদ্যালয়। সুতরাং কওমি মাদরাসা অর্থ জাতীয় বিদ্যালয়/জাতীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, এখন যেখানে ইফতা বিভাগ আছে সেটিকে বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজ মানের এভাবে বলা যায় কিনা ভেবে দেখা যেতে পারে।
কওমি স্বীকৃতি ও হাইয়াতুল উলইয়ার কাছে আমাদের প্রত্যাশা
আল হাইয়াতুল উলিয়া লিল জামিয়াতিল কাওমিয়া বাংলাদেশের অধীন কওমি মাদরাসাসমূহের দাওরায়ে হাদিস তাকমিলের সনদকে মাস্টার্স ডিগ্রি (ইসলামিক স্টাডিজ ও আরবির সমমান প্রদান) বিল ১৯ সেপ্টেম্বর-২০১৮ সংসদে পাস হয়েছে। ফলে কওমি ছাত্র শিক্ষকদের দীর্ঘদিনের দাবি পূরণ হয়।
গত ১৩ আগস্ট মন্ত্রিসভার বৈঠকে এই আইনটি চূড়ান্ত অনুমোদন দেয়া হয়। আর সেদিনই বর্তমান সংসদের শেষ অধিবেশনে বিলটি তোলার কথা জানানো হয়।
প্রায় ২০ হাজার কওমি মাদরাসায় বর্তমানে ১৫ লাখের কাছাকাছি শিক্ষার্থী পড়াশোনা করেন। বছরে তিন থেকে চার লক্ষ শিক্ষার্থী পাস করে আসেন। এতদিন তাদের স্বীকৃতি না পাওয়াটাই দূর্ভাগ্যের ছিল।
পাসকৃত আইন মোতাবেক কওমি মাদরাসার স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য বজায় রেখে এবং দারুল উলুম দেওবন্দের মূলনীতিগুলোকে ভিত্তি করে এই সমমান দেয়া হলো।
প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, এই সমমান দেয়ার লক্ষ্যে কওমি মাদরাসা শিক্ষাবোর্ড বেফাকুল মাদারাসিল আরাবিয়া- বেফাক সভাপতি হিসেবে পদাধিকার বলে আল্লামা আহমেদ শাহ শফীর নেতৃত্বে কমিটি গঠন করা হয়েছে।
এই কমিটি সনদবিষয়ক যাবতীয় কার্যক্রমের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী বিবেচিত হবে। এদের তত্ত্বাবধানে নিবন্ধিত মাদরাসাগুলোর দাওরায়ে হাদিসের সনদ মাস্টার্সের সমমান বিবেচিত হবে।
এই কমিটির অধীনে ও তত্ত্বাবধানে দাওরায়ে হাদিসের পরীক্ষা হবে। পাঠ্যক্রম প্রণয়ন, পরীক্ষা পদ্ধতি, পরীক্ষার সময় নির্ধারণ, অভিন্ন প্রশ্নপত্র প্রণয়ন ও উত্তরপত্র মূল্যায়ন, ফলাফল এবং সনদ তৈরিসহ আনুষঙ্গিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য এক বা একাধিক উপ-কমিটি গঠন করতে পারবে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে এ বিষয়গুলো অবহিত করবে কমিটি। এই কমিটি দলীয় রাজনীতির ঊর্ধ্বে থাকবে।
এতদিন স্বীকৃতি না থাকায় কওমি মাদরাসার সদনধারীরা সরকারি, বেসরকারি কোনো চাকরিতে যোগ্য বলে বিবেচিত হতেন না। এখন তারা নিয়োগ পরীক্ষায় অংশ নিয়ে তাদের যোগ্যতার প্রমাণ দিতে পারবেন।
অবশ্য এ বিষয়ে নতুন আইন পাস হওয়ার আগেই গত মার্চে ১০১০ জন কওমি আলেমকে মসজিদভিত্তিক শিশু ও গণশিক্ষা কার্যক্রম (ষষ্ঠ পর্যায়) প্রকল্পের আওতায় সরকারি চাকরিতে নিয়োগ দেওয়া হয়।
দাওরায়ে হাদিস কওমি মাদরাসার সর্বোচ্চ স্তর। কওমি শিক্ষায় ছয়টি স্তর রয়েছে। এগুলো হলো: ইবতেদাইয়্যাহ (প্রাথমিক), মুতাওয়াসসিতাহ (নিম্নমাধ্যমিক), সানাবিয়্যাহ আম্মাহ (মাধ্যমিক), সানাবিয়্যাহ খাসসাহ (উচ্চ মাধ্যমিক), মারহালাতুল ফজিলত (স্নাতক), মারহালাতুত তাকমিল বা দাওরায়ে হাদিস (মাস্টার্স সমমান)
এই ৬টি স্তরের কোন স্তর থেকে বের হয়ে বাংলাদেশের কোন প্রতিষ্ঠানে চাকরি পাওয়ার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। কওমি মাদরাসার স্বকীয়তায় দেওবন্দের ৮ মূলনীতিতে জোর দিতে গিয়ে এমনটি ঘটেছে।
নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারা হল কিনা আমি বুঝতে অক্ষম। নিয়োগ পরীক্ষায় অংশ নিয়ে কওমি ছাত্ররা কি লিখবে তাও বুঝতে পারছি না ।
আওয়ার ইসলামের এক ইন্টারভিউতে মাওলানা মাসউদুল করিম দেওবন্দের ৮ মূলনীতির কথা উল্লেখ করে বলেন, দেওবন্দের মূলনীতির বাইরে যাওয়ার সুযোগই নেই। কারণ ওই আট মূলনীতির ওপর ভিত্তি করেই স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। কোনভাবেই বৈরিতা নেই বলে মনে করি। সুতরাং তারা কোনোভাবেই স্বকীতার উপর হস্তক্ষেপ করতে পারবে না।
বাকি আমাদের মাঝে কিছু কিছু আলেমকে এতো উৎসাহি হতে দেখা যাচ্ছে যে, কখন নিজেদের স্বকীয়তার দাবি থেকে সরে যান এ নিয়ে চিন্তা হচ্ছে। এটা রাষ্ট্রের জন্য, সরকারের জন্য উপভোগেরই বিষয়। বলা যায়, আমাদের তুলনায় তারাই লাভবান হবে বেশি...।
মাসউদ সাহেব তার এই উপলব্ধির কথা প্রকাশ করে অনেক চিন্তার খোরাক জোগিয়েছেন। চলুন একটু বিশ্লেষণ করি কি লাভ হল।
১. আপনি দাওরায়ে হাদিসের সনদ নিয়ে বিসিএস পরীক্ষায় অংশ নিতে পারবেন? না। কারণ, বিসিএস পরীক্ষার সিলেবাসের পড়া আপনি পড়েন নি। তাহলে আপনি মেজিস্ট্রেট, ইউএনও, ডিসি বা আমলার কোনো পদের চাকরি পেলেন না।
তাদের শাসনের অধীনেই থাকলেন। শাসক হতে পারলেন না। একজন কুরান-হাদিসের উপর উচ্চশিক্ষা লাভ করে আরেকজন ইংরেজিশিক্ষায় শিক্ষিত শাসকের শাসনেই থাকলেন।
২. আপনি কি ব্যাংক-বীমা, মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির কোনো এক্সিকিউটিভ হতে পারবেন? সম্ভবত না। কারণ যে বিষয়ে লিখিত পরীক্ষা হবে সেগুলো তো আপনি পড়েন নি। যেসকল কিতাব পড়েন তার থেকে এক গাদা কিতাবের কিছু কমিয়ে উক্ত প্রফেশনাল বিষয়গুলো সিলেবাসে ঢুকানো যায় কিনা ভাবতে বলব।
৩. আপনি আর্মি-পুলিশ-আনসার সদস্য বা অফিসার হতে পারবেন? সম্ভবত না। এখানে নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের কোনো দোষ নেই। কারণ সিস্টেমটাই এমন যে আপনি আবেদন করতেই এগুতে চান না। বা নিজের আমলকে গুরুত্ব দিয়ে আপনি ইন্টারেস্টেড হন না।
৪. আপনি বিচারক বা আইনজীবী হতে পারবেন? তাও মনে হয় না। ব্যাতিক্রমের কথা আলাদা।আপনারা তো দেশে প্রচলিত কোন আইনের বই পড়েন নাই। শরিয়তের যে আইন পড়েছেন তা দিয়ে তো বিচারক বা আইনজীবী হতে পারবেন না।
৫. ক্ষুদ্র মাঝারি বা বড় শিল্প মালিক হতে পারবেন? ব্যাংক থেকে কোটি টাকা সুদে ঋণ নিতে হবে। অনুমোদন নিতে লক্ষ টাকা ঘোষ লাগবে। সুদ-ঘোষে নিজেকে জড়াতে পারবেন না।
৬. ছোট-বড় কোম্পানি খুলবেন? ট্রেড লাইসেন্স, বয়লার পারমিশন, বিদ্যুৎ উপকেন্দ্র, পরিবেশ ছাড়পত্র, বিনিয়োগ পারমিশন সবকিছুতে লক্ষ টাকা ঘোষ লাগবে। একজন আলেমে দ্বীনের পক্ষে সম্ভব?
৭. আপনি সংস্কৃতিক কর্মী, এনজিও কর্মী বা সামাজিক কর্মী হয়ে নেতৃত্ব দেবেন? এটাও যে দুর্গমগীরি কান্তার মরূ দুস্তর পারাবার, আমার চেয়ে আপনারা ভাল বুঝেন!
৮. আপনি কি ডিপিডিসি, পিডিবি, ডেসকো, সিটি কর্পোরেশন প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানেের কর্মকর্তা হওয়ার চিন্তা করেন? এখানেওতো জটিল আর কঠিন পদ্বতি।
৯. মেম্বার, চেয়ারম্যান, কমিশনার, মেয়র হবেন বা জন প্রতিনিধি হতে গেলে আমাদের এই দূর্ভাগা সমাজে আলেমদের যে কতটুকু দাম দেয় তা আমার চেয়ে আপনারা ভাল জানেন।
১০. চাকরি নিয়ে বিদেশ যাবেন, সব দেশের এয়ারপোর্টেই পাসিং এর সময় দাড়ি টুপি পাঞ্জাবি দেখলে যে প্রশ্নগুলো করা হয়, ২য় বার আর যেতে ইচ্ছে করবে না।
আর বাকি থাকল কী? মক্তব, মসজিদ, মাদরাসা, স্কুল কলেজ, কিছু প্রতিষ্ঠানের মুয়াজ্জিন, ঈমাম, খতিব, মুদারিস, মুহতামিম, ধর্মীয় শিক্ষক, মোফাস্সির, ওয়ায়েজিনের পেশা। এগুলো আগে যেমন ছিল এখনও আছে।
কেউ বলবেন, আমরা বর্ণিত এতকিছু তো চাচ্ছি না। যা আছি তাই থাকব। তাহলে আমি ক্ষমা প্রার্থী। কাউকে দুঃখ দেয়া আমার উদ্দেশ্য নয়।
কিছু যদি হতে হয়, তাহলে মনে রাখতে হবে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে, আমরা ডিজিটালাইজড হচ্ছি।শিক্ষার কারিকুলাম বা সিলেবাস পরিবর্তন জরুরি কিনা ভেবে দেখুন, দেওবন্দের ৮ মূলনীতি রেখেই তো অনেক পরিবর্তন আনা যায়।
কিন্তু কেউ পরিশ্রম করতে রাজি নয় ৷ আমরাই তো আমাদের পরিবর্তন করতে হবে। সরকার তো সুযোগ দিয়েছে।
আরও পড়ুন: দুই তারকার মৃত্যু শোক প্রতিক্রিয়া; কী শিক্ষণীয়!
-আরআর