জহির উদ্দিন বাবর
আলেম, সাংবাদিক
মূলধারার মিডিয়া ইসলামপন্থীদের ইতিবাচক কোনো কাভারেজ দেয় না এই আক্ষেপ অনেক পুরোনো। প্রায়ই বিভিন্নজন এই আক্ষেপ নতুন করে প্রকাশ করে থাকেন। অনেকে এই কারণে মিডিয়া ও সাংবাদিকদের প্রতি ক্ষোভ ঝাড়েন।
একটি শ্রেণি ও বৃহত্তর গোষ্ঠীকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে মিডিয়া কাভারেজের বাইরে রাখা নিঃসন্দেহে অন্যায়। তবে যারা কাভারেজ দেয় না শুধু দায় তাদেরই না, যারা কাভারেজ পাচ্ছেন না তাদেরও এক্ষেত্রে কিছুটা দায় আছে।
বর্তমানে মিডিয়া কীভাবে চলে, কারা চালায় সে সম্পর্কে আমরা সবাই কমবেশি জানি। কোটি কোটি টাকা খরচ করে যারা মিডিয়া করেন তাদের নিশ্চয় কিছু উদ্দেশ্য থাকে। পুঁজিবাদী বিশ্বে সবকিছুই নির্ধারণ হয় ‘গিভ অ্যান্ড টেক’ এর ভিত্তিতে।
জহির উদ্দিন বাবর লিখিত বইগুলো কিনতে এখানে ক্লিক করুন
আমি আপনার জন্য কিছু করব তখনই যখন আপনি আমার জন্য কিছু করবেন। আপনি আমার জন্য কিছুই করবেন না আর আমার কাছ থেকে কিছু পেতে চাইবেন সেই আশা এখন করে লাভ নেই।
প্রথমত ‘গিভ অ্যান্ড টেকের’ বিচারে ইসলামপন্থীরা মিডিয়ার কাছে অপাঙক্তেয়। কারণ ইসলামপন্থীদের আর্থিক কোনো সুবিধা মিডিয়াগুলো সাধারণত পায় না। এজন্য তাদের ইতিবাচক নিউজের ব্যাপারে মিডিয়া হাউজগুলোর তেমন কোনো আগ্রহ নেই।
তবে নেতিবাচক নিউজগুলোর ব্যাপারে আগ্রহ আছে। কারণ যারা মিডিয়ার পরোক্ষ নিয়ন্ত্রক, ‘ফুয়েল’ যারা সরবরাহ করেন তারা ইসলামপন্থীদের নেতিবাচক খবর বেশি বেশি চান।
কোনো হাউজ ইসলামিস্টদের একটু বেশি কাভারেজ দিলে তাদের দেখা হয় ভিন্ন চোখে। তাদের গায়ে লাগানো হয় নানা ট্যাগ। করপোরেট জগতে কালো তালিকাভুক্ত হওয়ার ঝুঁকিও থাকে।
যেমন কোনো দৈনিকে ইসলামি বিষয় বেশি গুরুত্ব দিলে মোবাইল কোম্পানিগুলো বিজ্ঞাপন দিতে সাচ্ছন্দবোধ করে না। বহুজাতিক কিছু প্রতিষ্ঠান আছে যারা ‘ইসলাম’ গন্ধ পেলেই নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখে। সঙ্গত কারণেই মিডিয়াগুলো ইসলামপন্থীদের কাভারেজ দিয়ে তাদের বিরাগভাজন হতে চায় না।
ইসলামপন্থীরা মিডিয়া কাভারেজ না পাওয়ার একটি মৌলিক কারণ এটি। এর বাইরেও আছে নানা কারণ। তবে ছোটখাট কিছু বিষয়ে নজর না দেয়ার কারণেও ইসলামপন্থীরা মিডিয়া কাভারেজ থেকে বঞ্চিত হন।
আমাদের অনেক জাতীয় প্রতিষ্ঠান আছে, যারা প্রোগ্রাম বাস্তবায়নে খরচ করে লাখ লাখ টাকা। কিন্তু অনেক বড় প্রোগ্রাম করেও তেমন কোনো মিডিয়া কাভারেজ পায় না। হয়ত মিডিয়ার জন্য তারা আলাদা কোনো বাজেটই রাখেনি। অথবা রাখলেও তা যথাযথ পদ্ধতিতে খরচ হয়নি।
সাধারণত মিডিয়া হাউজগুলোতে কে কোন সংবাদ কাভার করবেন তা ভাগ করা থাকে। এটাকে সাংবাদিকতার পরিভাষায় বলে ‘বিট’। প্রতিটি হাউজেই ইসলামি দল তথা ইসলামপন্থীদের নিউজ কাভারের জন্য রিপোর্টার নির্ধারিত থাকেন।
ইসলাম বিটের সাংবাদিকদের বড় আক্ষেপ হলো, ইসলামপন্থীদের কাছ থেকে তারা যথাযথ মূল্যায়ন পান না। সংশ্লিষ্ট বিটের সাংবাদিকদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ আছে এমন দল খুব কমই আছে।
আমার জানামতে ইদানীং ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ সাংবাদিকদের সঙ্গে কিছুটা যোগাযোগ রক্ষা চেষ্টা করে। চরমোনাই পীর সাহেব বছরে একবার হলেও সাংবাদিকদের সঙ্গে বসেন। বিভিন্ন পার্বনে সাংবাদিকদের ছোটখাট শুভেচ্ছা উপহারও দেয় দলটি।
বিভিন্ন প্রোগ্রাম বাস্তবায়ন উপলক্ষে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের নেতারা মিডিয়া হাউজগুলোর দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের সঙ্গে সরাসরি সাক্ষাৎ করে কথা বলেন, সহযোগিতা চান। এর ইতিবাচক প্রভাব হলো, মূলধারার মিডিয়াগুলো এখন চরমোনাই পীর সাহেবের দলের নিউজকে গুরুত্ব দেয়।
সদ্য মরহুম মাওলানা আহলুল্লাহ ওয়াসেল রহ.ও সাংবাদিকদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করতেন। আমার জানামতে, সাংবাদিকদের সঙ্গে এতোটা সুসম্পর্ক আর কোনো ইসলামি নেতার ছিল না। বিবিসি থেকে শুরু করে সব মিডিয়া হাউজেই তাঁর পরিচিতি ছিল। তাঁর ইন্তেকালের খবরে মূলধারার অনেক সাংবাদিককে আক্ষেপ করতে দেখেছি।
ইসলামি বিট করেন এমন সাংবাদিকদের সঙ্গে প্রায়ই কথাবার্তা হয়। তাদের অভিযোগ, ইসলামি দলের নেতারা কোনো প্রতিক্রিয়া বা তথ্য জানতে ফোন দিলে খুব কমই মূল্যায়ন করেন।
অনেকে সাংবাদিকদের প্রতিপক্ষ মনে করতে থাকেন। অনেক ক্ষেত্রে রুঢ় আচরণ করেন বলেও অভিযোগ আছে। অথচ যত নেতিবাচক নিউজই করুক পেশাদার কোনো রাজনীতিবিদ কখনও সাংবাদিকের সঙ্গে রুঢ় আচরণ করতে পারেন না। কারণ রাজনীতিতে ভালো করতে হলে সাংবাদিকদের সহযোগিতা লাগবেই।
আমাদের অনেক ইসলামি দল রমজানে সাংবাদিকদের সম্মানে ইফতার মাহফিলের আয়োজন করে। তবে সেখানে প্রকৃত সাংবাদিকের উপস্থিতি থাকে কম। সংবাদপত্রে সবচেয়ে ব্যস্ত সময় কাটে সন্ধ্যাবেলায়। সেই মুহূর্তে শুধু ইফতার খাওয়ার জন্য সাংবাদিকদের আসা কঠিন।
এজন্য ইফতার মাহফিলের দাওয়াতে সাংবাদিকরা সাড়া দেন কম। সাংবাদিকদের সম্মানে দলগুলো রমজান ছাড়া অন্য কোনো সময় আয়োজন করতে পারে। এতে সাংবাদিকদের সাড়া পাওয়া যাবে বলে আশা করা যায়।
আমাদের অনেকেই আবার সাংবাদিকের অবস্থানটাও বুঝতে পারেন না। কেউ হয়ত ফেসবুকে ‘মারদাঙা’ স্ট্যাটাস দেন, তাকেও সাংবাদিক ভাবতে থাকেন। কেউ হয়ত বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখালেখি করেন তাকেও সাংবাদিক হিসেবে মূল্যায়ন করেন।
আবার কেউ হয়ত মাঝে মাঝে ‘লিফলেট’ টাইপের কোনো কাগজ বের করেন; তাদেরকে সাংবাদিকদের আয়োজনে ডাকা হয় ‘মহাসম্মানে’।
কারও হয়ত একটি ডোমেইন নেয়া আছে, ওয়েবসাইটটিতে মাঝে মাঝে কপি করে দুই-চারটা নিউজ দেন তাকেও সাংবাদিক মর্যাদায় অভিষিক্ত করা হয়। তাদেরকে আপনি মূল্যায়ন করেন, তাতে কারও আপত্তি থাকার কথা নয়। তবে আপনি কোরোসিন আর সয়াবিনের পার্থক্য না বুঝলে প্রতারিত হবেন এটাই স্বাভাবিক।
মনে করুন আপনি খুব ভালো একটা কাজ করেছেন কিংবা ভালো একটা পণ্য উৎপাদন করেছেন। আমার কাজটি বা পণ্যটি মিডিয়া কেন হাইলাইটস করে প্রচার করছে না-এটা ভেবে মনের খেদ প্রকাশ করে কোনো লাভ নেই।
কেউ এসে তোষামোদি করে আপনাকে কাভারেজ দেবে না। আপনাকেই উদ্যোগী হয়ে মিডিয়াম্যানদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। ‘প্রচারেই প্রসার’ এই নীতিতে বিশ্বাসী হলে আপনাকে এক্ষেত্রে প্রয়োজনে কিছু বিনিয়োগও করতে হবে।
বর্তমানে পুঁজিবাদীব্যবস্থায় একটি পণ্য উৎপাদনের সঙ্গে প্রচার-প্রসারের খরচটি অনিবার্যভাবে যুক্ত হয়ে যায়। পণ্য উৎপাদনে ১০ টাকা খরচ হলে তা প্রচার-প্রসারে আরও পাঁচ টাকা যুক্ত হয়ে পণ্যের দাম দাঁড়ায় ১৫ টাকা।
কওমি মাদরাসা ম্যানেজমেন্ট সফটওয়্যার – বিস্তারিত জানুন
মনে করুন আপনার প্রকাশনী থেকে একটি ভালো বই প্রকাশ করেছেন। আপনি সংবাদপত্রে এই বইটির প্রচার চান। বিভিন্ন সংবাদপত্রে যারা কাজ করেন, বিভিন্ন ইসলামি পাতার দায়িত্বে যারা আছেন তাদের সম্মানে একটা আয়োজন করেন।
তাদের জন্য সামান্য গিফটের ব্যবস্থা করেন। একটি গ্রন্থ আলোচনাসহ বইটি তাদের হাতে তুলে দেন। হয়ত সবাই আপনাকে সাপোর্ট দিতে পারবে না, কিন্তু তারপরও যে সাপোর্ট আপনি পাবেন তা বিনিয়োগের তুলনায় অনেক গুণ বেশি। যথাযথ প্রক্রিয়া অবলম্বন ও সৌজন্যবোধ না দেখিয়ে মিডিয়া কাভারে পাওয়ার আশা করে লাভ নেই।
কারও কারও বক্তব্য হলো, আমাদের অনেক লোক বিভিন্ন মিডিয়ায় কাজ করেন। তারা আমাদের যথাযথ কাভারেজ দেন না। আচ্ছা, আপনাদের যারা বিভিন্ন মিডিয়ায় কাজ করেন তারা কতটা প্রতিকূল পরিবেশে টিকে আছে সে খবর কি কোনোদিন নিয়েছেন?
মিডিয়ার পলিসি যারা নিরূপণ করেন এমন কয়জন আছেন আপনাদের? যারা যেখানে আছেন নিজ যোগ্যতা বলে গেছেন। টিকে আছেন নানা প্রতিকূলতার মধ্যে। তারা হুট করে চাইলেই মিডিয়ার পলিসির বাইরে গিয়ে আপনাকে কাভারেজ দিতে পারবে না। সেই ক্ষমতা তাদের নেই।
আপনি যদি এতোটাই কাভারেজ পেতে চান তাহলে নিজে মিডিয়া করুন। তখন আপনারা কাভারে ঠেকানোর মতো কেউ থাকবে না।
গত কয়েক বছরে আওয়ার ইসলামসহ আমাদের ধারার ছোটখাট বেশ কিছু মিডিয়া দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। তারা কতটা প্রতিকূলতার মধ্যে এগিয়ে যাচ্ছে সেটা সংশ্লিষ্টরাই ভালো জানবেন।
এসব মিডিয়া টিকিয়ে রাখার কোনো উদ্যোগ তো তেমন চোখে পড়ে না। বরং পান থেকে চুন খসলেই তাদের তুলোধুনো করা হয়। ছোটখাট এসব উদ্যোগকে সম্মিলিতভাবে সহযোগিতা করলে একদিন মূলধারার মিডিয়া গড়ে তোলা সম্ভব।
কিন্তু সে দিকে আমাদের মনোযোগ খুব একটা নেই। পরের টাকায় গড়া মিডিয়ায় এতো কাভারেজ পাওয়ার আশা না করে নিজেরা মূলধারার মিডিয়া গড়ে তোলার ব্যাপারে উদ্যোগী হোন। না হলে সারা জীবন আক্ষেপই করে যেতে হবে, সুদিন আর আসবে না।
লেখক: বার্তা সম্পাদক, দৈনিক ঢাকা টাইমস
‘আলিয়া বা কওমির যে শিক্ষা এটাই ইসলামি শিক্ষা নয়’
-আরআর