তানভীর সিরাজ
লেখক ও সংগঠক
আল্লাহর জমিনে বাস করতে হলে নিয়মনীতি মেনে বাস করতে হয়। শুধু ব্যক্তি জীবন নয়, রাজনীতি, অর্থনীতি,পারিবারনীতি, সমাজনীতি, রাষ্ট্রনীতি, বিচারনীতি, বিবাহনীতি, বৈষম্য নীতি আর সাম্যনীতি সবকিছুই মেনে চলতে হবে।
নীতিবহির্ভূত মানুষ যে সমাজেই হোক সেই সমাজে সে অসামাজিক বলে গণ্য হয়। বাকিরাও তাকে তেমন একটা গ্রহণ করে না। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম- প্রতিটা বিষয়ে নীতিমালা গেঁথে দিয়েছেন। সুতরাং তার অনুসরণ করতে হবে দলমত নির্বিশেষে আমাদের সবার।
নানা পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়ে রাজনীতির নিয়ে বেশ কিছু অভিজ্ঞতা হয়েছে। কিছু নীতিমালা নেতাদের সমীপে পেশ করছি।
১. সুন্দর আচরণ
সামাজিক জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ সুন্দর আচার ব্যবহার। সুতরাং আমাদের মধ্যে যারা রাজনীতি করি বা করি না সবার উচিৎ সুন্দর আচরণ উপহার দেয়া।
বিশেষ করে যারা সমাজপতি আর রাষ্ট্রপতি তাদের মুখনিঃসৃত ভাষা যদি রুচিসম্মত না হয় তাহলে তাদের দ্বারা নিজের দল ও মতের যথেষ্ট ক্ষতি হয়। হয়তো কর্মীরা তাদের দলে যোগ দেবে, তবে তাদের নিশ্চয়তা খুব একটা হবে বলে আমার মনে হয় না।
খেলাফত ও রাজনীতি ইসলামী দৃষ্টিকোণ
তাই অধীনে থাকা নেতাকর্মীদের আচরণ যদি আপনার ভালো নাও লাগে তারপরও তাকে মায়া-মমতা দিয়ে সঠিক বুঝ দিতে হবে। অন্যথায়, সে সুন্দর ও সঠিক বুঝের অধিকারী হলে আপনাকে খারাপ ভাববে।
কাজেই তার সঙ্গে আপনাকে সান্ত্বনা,পরামর্শ, সিদ্ধান্ত আর আদেশ করার সময় শালীন সুন্দর নরম ভাষায় কথা বলতে হবে।
অথচ আমাদের যে অবস্থা তা হল, আমরা রাজনীতির মাঠে এসেই নিজেকে বড় নেতা ভেবে অন্যদের সাথে সুন্দর আচরণ করি না। মনে রাখবেন, নরম ভাষার অধিকারী হবেন তো নেতাকর্মীরা আপনাকে আজীবন স্বরণ করবে।
২. অবস্থার মূল্যায়ন
বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বিভাগের ডিন আমাকে বলেছিলেন, আমরা সম্মানী মানুষকে সম্মান দিতে জানি না। আমরা যদি সর্বকালের শ্রেষ্ঠ রাজনীতির জনক নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম- এর জীবনী আর সাহাবা চরিত গভীরভাবে পড়ি তাহলে দেখবো তাঁরা ধর্মীয় ভেদাভেদ বাদ দিয়ে গোত্রের সম্মানী ব্যক্তিকে তার পদমর্যাদা অনুযায়ী যথেষ্ট সম্মান করতেন।
বাস্তবতার নিমিত্তে একটি উদাহরণ দেই। অন্য মহলের সম্মানী ব্যক্তি আপনার দলে যোগ দেয় তাহলে তাকে তার মহলের অবস্থান অনুযায়ী সম্মান দিতে হবে। এটা নবীর সুন্নত।
আপনার দলে সে নবীন যদি মনে করে আপনি ছাত্রের মত আচরণ করেন তার সাথে; তাহলে তার আত্মমর্যাদায় আঘাত আসার কারণে সে নীরবে গোপন হয়ে যাবে। আপনার দলের ক্ষতি হবে। আর তখনই সবকিছুর মূলে আপনিই দায়ী হবেন। তাই বলতে চাই, রাজনৈতিক নেতা হতে চান, অবস্থার মূল্যায়ন শিখে যান।
৩. চরিত্রবান
রাজনীতির মাঠ কাঁপানোর অন্যতম মূলনীতি হল চরিত্রদোষ মুক্ত হওয়া। চরিত্রহনন করার মত যদি কোনো আচরণ ছাত্রসংগঠন আপনার কাছে দেখে তাহলে ছাত্ররাজনীতির গোড়াপত্তনেই তারা দুঃচরিত্রে গঠন হবে, সুন্দর চরিত্রের খোঁজ তারা পাবে না।
অনেককে বলতে শোনা যায়, ‘যেখানে পাও সেখানে কোপাও।’ এ কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তির বক্তব্য হতে পারে না। তাহলে আমি তাদের সহিংস রাজনীতির দিকে ঠেলে দিচ্ছি। এ হল চরিত্র বিবর্জিত সিদ্ধান্তমূলক আচরণ।
যে কারণে প্রথমে কেন্দ্রীয় নেতাদের চরিত্রবান হবার পাশাপাশি অধীনে থাকা নেতাকর্মীদের চরিত্রদোষ মুক্ত করার চেষ্টা করা। যা করে দেখিয়েছেন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম- তার রাজনৈতিক জীবনে। রাজনৈতিক জীবনে সীরাতকে আমরা মূল পাথেয় হিসেবে গ্রহণ করতে পারি।
৪. খোঁজ-খবর ও দয়াপরবশ
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম- সাহাবা কেরামের খোঁজ খবর নিতেন। কোনো সাহাবী যদি অনুপস্থিত থাকতেন তাহলে তিনি তার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করতেন আর তাঁর ঘরে লোক পাঠিয়ে খোঁজ নিতেন।
তাই বলতে চাই, আপনার কর্মী কোথায় আছে, কী করছে, কী খাচ্ছে, আর না খাচ্ছে, মামলা মোকাদ্দামায় আছে কিনা যাচাই করা ইত্যাদি বিষয় তলিয়ে দেখা।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খবর নিতেন তাঁর সাহাবাগণ অনাহারে বা অন্যকোন কষ্টে আছেন কি না? যথাসাধ্য সাহায্যের হাত এগিয়ে দিতেন।
আপনি রাজনীতির মাঠে কর্মীর মনে স্বরণীয় আর দিলে বরণীয় হিসেবে থাকতে চান তাহলে আপনার নেতাকর্মীদের খোঁজখবর নিতে হবে। বিপদাপদে তার সাহায্যে হাত প্রসারিত করতে হবে।
৫. পক্ষপাত
আপনি যখন রাজনীতি করেন আপনাকে ভাবতে হবে সবাই আপনার কর্মী, সবাই আপনার নেতা। সবাইকে অন্তত সাবার সামনে সমান চোখে দেখতে হবে।
তবে মায়া মুহব্বত যখন একান্ত ভিন্ন জিনিস, সে জন্য কাউকে একটু বেশি মুহব্বত আপনার লাগতেই পারে তবে তা জনসম্মুখে প্রকাশ না করাই ভালো। এতে বাকি নেতাকর্মী আপনার বিপক্ষে অবস্থান নিতে পারে। আর দলের ক্ষতি তো আছেই।
৬. পরনিন্দা
রাজনৈতিক মহলে খুব সাধারণ একটা বিষয় হল পরনিন্দা করা আর সমালোচনা করা। একদল অন্যদলের, একনেতা অন্যনেতার, এক এমপি অন্য এমপির আর ছাত্রনেতা অন্য ছাত্রনেতার সমালোচনা করা তার অনুপস্থিতিতে, আজ বেশ রসমালাই হয়ে উঠেছে।
পরনিন্দা বা গীবত বলতে অন্য নেতাকর্মীর দোষ চর্চা করা। এর দ্বারা যে ক্ষতিটা হয় তা হল, আমার অধীনে যারা রাজনীতি করছে বা শিখছে তারাও একদিন আমার বিরুদ্ধে কথা বলবে আর পরনিন্দা করবে, কারণ আমি তাদের তা শিখিয়েছি ।
৭. সুন্দর মতবিনিময়
দলের বা নির্দিষ্ট কোনো বিষয়ে নেতাকর্মীদের নিয়ে মতবিনিময় সভার আয়োজন করেছেন সেখানে সবাইকে সমান তালে মত বা চিন্তাধারা প্রকাশের সুযোগ দেয়া। আপনার নেতাকর্মীর কেউ পরামর্শ দিচ্ছে এমন সময় তার মতামত মন দিয়ে শুনা, আর না হয়, সে মনে কষ্ট পাবে এবং আপনাকে অপছন্দ করা শুরু করবে।
যদি তার মতামত আপনার অপছন্দ হয় তারপরও তা কান লাগিয়ে শ্রবণ করা আর সুন্দর ভাষায় তাকে বুঝিয়ে বলা লাভ ক্ষতির কথা।
৮. শহরে থাকা
যারা নেতা তারা যেন শহরে থাকে। বিশেষ করে কেন্দ্রীয় নেতা বা তৃণমূল নেতাদের শহরে থাকা আমি খুব প্রয়োজনীয় বিষয় মনে করি, কারণ গ্রামে বাস করে শহরের হাল বুঝা এক প্রকার অবাস্তব বিষয়।
কার সাথে কিভাবে কথা বলতে হয়, অবস্থার মূল্যায়ন করা, স্থানভেদে কথা বলার ভঙ্গিমা ইত্যাদি শিখতে হলে কেন্দ্রীয় নেতা বা তৃণমূল নেতৃবৃন্দের শহরে থাকা আবশ্যক মনে করি।
আসল কথা হল শহরে থাকলে নেতাদের সাথে থাকতে থাকতে রাজনীতি শেখা সহজ। শহরবাসীকে গ্রামের সাদাসিধে মানুষরা একটা মর্যাদা দিয়ে থাকে, যা রাজনীতির মাঠেও একটা পুঁজি।
গ্রামীণ রাজনীতি ও নাগরিক রাজনীতির মাঝে অনেক পার্থক্য আছে। তাই আসুন, রাজনীতির এ কানুনগুলো আমরা আমাদের কাজে পরিণত করি।
লেখক: সাংগঠনিক সম্পাদক, বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রসমাজ চট্টগ্রাম
আপনার ব্যবসাকে সহজ করুন। – বিস্তারিত জানুন