মাওলানা জমির বিন মাহমূদ
কাতার থেকে
২০১২ সালের ৭ডিসেম্বর কাতারে জলবায়ু সম্মেলন শুরু হয়। সে সময় অনানুষ্ঠানিকভাবেই আমাদের সাথে সাক্ষাৎ ঘটে মাননীয় মন্ত্রী ড. হাসান মাহমূদ ও আল্লামা ফজলুল্লাহ ফাউন্ডেশনের চেয়াম্যান ওস্তাদ আবু রেজা মুহাম্মদ নিজাম উদ্দীন নাদভী (বর্তমান সাংসদ) এর সাথে।
বাংলাদেশ থেকে আগত প্রতিনিধিদল অবস্থান করছিলেন Radisson Blu Hotel Doha তে। ব্যস্ততার মাঝেও মন্ত্রীমহোদয় আমাদের সময় দেন। অত্যন্ত আন্তরিকভাবে তিনি আমাদের গ্রহণ করেন।
সাক্ষাতের পর অনুভব হল, রাজনৈতিক ডামাডোল ও মেরুকরণের বাইরেও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের আছে আলাদা জীবন, সেই ব্যক্তি সত্তাটিও দলমত নির্বিশেষে সমাজে সমাদৃত হওয়া প্রয়োজন।
বিদেশের মাটিতে দলমতের উর্ধ্বে উঠে একজন অভিভাবকের মতই তিনি খোলামেলা আলোচনা করেছেন। কওমি মাদরাসার সনদের স্বীকৃতির বিষয়টিও আলোচনায় স্থান পেয়েছিল।প্রকৃতপক্ষে কওমি সনদের স্বীকৃতি বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
কওমি স্বীকৃতির ফলে বাংলাদেশের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হবে। মৌলিক ও ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত এক বিশাল জনগোষ্ঠির স্বতন্ত্র শিক্ষা ব্যবস্থাকে রাষ্ট্র মেনে নিল।
স্বীকৃতি বিষয়টি মৌলিক একটি অধিকার। অধিকার দেয়ার উদ্যোগ নিয়ে নিজ দায়িত্ব পালন করেছে বর্তমান সরকার। এ জন্য ধন্যবাদ দিতেই হয় সরকারকে। পারিবারিক ও সামাজিক শৃংঙ্খলা রক্ষায় এ শিক্ষা ব্যবস্থার রয়েছে বাস্তব ভূমিকা। রয়েছে অর্থনৈতিক অবদান।
হাজার-হাজার মানুষের এই কর্মসংস্থাগুলো সরকারের কোনো ধরনের অনুদান ও সাহায্য ছাড়াই পরিচালিত হয়। সাধারণ মুসলমানগণের সাহায্যে দিয়েই তা চলে। দলমত নির্বিশেষে সব মুসলমান নিজেদের অর্থ দিয়ে এগুলো পরিচালনায় শরীক হন।
নাস্তিক-মুরতাদরা সরাসরি বিরোধিতা করলেও কিছু অবুঝ মুসলমান রয়েছে যারা এই শিক্ষা ও সনদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। নামধারী কিছু আলেম রয়েছে; বিরোধিতা করার পাশাপাশি এই ধারার ওলামাগণকে কাফের বলতে তাদের বাঁধে না।
নাস্তিক্যবাদের পাশাপাশি এই শ্রেণীর লেবাসধারীরাও দেশ-জাতির বিষফোঁড়া। বিশাল এই জনগোষ্ঠিকে রাজনৈতিকভাবে পক্ষে রাখার জন্য জবরদস্ত একটি শ্রেণীর উদ্ভব হয়েছে, যদিও রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্বের সুযোগ প্রতিষ্ঠান সমূহের নেই।
নিজেদের অসচেতনতা আর একটি সংঘবদ্ধ মহলের বিরোধিতায় কওমি মাদরাসা সনদের মান ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে দীর্ঘ দিন। পূর্বেকার সরকারগুলো নানা অজুহাত ও তালবাহানার আশ্রয় নিলেও স্বীকৃতির বিল এই প্রথম মন্ত্রীসভা হয়ে সংসদে উত্তাপিত হল।
এ পর্যন্ত বিলটি এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে সরকারের আন্তরিকতা প্রকাশ পেয়েছে। ইসলাম ধর্মের মৌলিক আকিদা-বিশ্বাসের সুতিকাগার কওমি মাদরাসাগুলো ইসলামি জ্ঞান বিস্তারের স্বার্থে এ পর্যন্ত নিয়োজিত রয়েছে।
রাজনৈতিক পক্ষাবলম্বন থেকে বিরত থাকলেও জন সমাজে এই দাওয়াতি কাফেলার বিশাল প্রভাবকে দল ও সরকারগুলো পক্ষে রাখার জন্য কৌশল গ্রহণ করে। নিজ নিজ স্বার্থ রক্ষা হলে সরকারের কৌশলে অংশ নেয়ার মধ্যে কল্যাণ।
যা আছে সংসদে উত্থাপিত কওমি মাদরাসা বিলে
এসে গেল যাদুকরী মাদরাসা ম্যানেজমেন্ট সফটওয়্যার
এভাবে রাষ্ট্রের প্রতিটি সেক্টর বিকশিত হয়। নিজেদের স্বাতন্ত্র ও স্বার্থের শতভাগ রক্ষা হলে সরকারের কৌশলের বিরুদ্ধে যাওয়া ইসলামি স্বার্থের জন্য ক্ষতিকর বরং এর মাশুল গুণতে হয় যুগের পর যুগ।
সরকার কিভাবে নির্বাচন করল, কে বা কারা সরকারে আসল বা গেল; এই বিতর্কের চেয়েও রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ব্যক্তিগণকে, ধর্মীয় অবস্থান থেকে কতটুকু প্রভাবিত করা যায়, সেটাই বড় কথা।
কওমি মাদরাসা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ সেটার প্রতি পূর্ণমাত্রায় সজাগ বলে স্বীকৃতির বিলটি বানচাল হয়নি এবং সরকারও বুঝতে পেরেছে নিজেদের রাজনীতি ও ভোটের স্বার্থে কওমি মাদরাসা সনদের স্বীকৃতি হওয়া প্রয়োজন।
এর চেয়েও বিবেচ্য বিষয় হল; রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় হতে বলা হচ্ছে- আল্লাহর ওয়াস্তে কওমি মাদরাসা সনদের স্বীকৃতি দেয়া হচ্ছে। নেগেটিভ চর্চা পরিহার করে অনেক মন্ত্রীমহোদয় কওমি মাদরাসা সম্পর্কে বাস্তব, উপযুক্ত ও আশাব্যঞ্জক বক্তব্য রাখছেন।
বর্তমান সরকারের জন্য এটা সহজ ছিল না। ওলামা ও সরকারের দূরত্ব ছিল যোজন যোজন মাইল। একাধারে সরকার ও দলটিকে ইসলাম বিদ্বেষী হিসেবে আখ্যায়িত কর হত। এই দূরত্ব গুছানোর সুযোগ সৃষ্টি করেছে সরকার। সেখানে সরকার আন্তরিক ছিল।
বাস্তবতা বিবেচনায় এবং ভোটের স্বার্থে সরকারের নেয়া পদক্ষেপ ‘কওমি মাদরাসা সনদের স্বীকৃতি’ বিষয়ে আমাদের সরাসরি জানার সুযোগ হয়। তৎকালিন মন্ত্রী জনাব ড. হাসান মাহমুদ বিষয়টি সম্পর্কে আমাদের অবগত করেন।
‘শাপলা ট্রাজেডি‘র তখনো পাঁছ মাস বাকি ছিল। কাতার সরকার আয়োজন করেছে ‘জলবায়ু সম্মেলন-২০১২’ (COP)। ৬ ডিসেম্বর ২০১২। কাতার ওলামা কমিউনিটির পক্ষ থেকে আমরা কয়জন সাক্ষাৎ করি সম্মেলনে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের নেতৃত্বদানকারী মাননীয় মন্ত্রী ড. হাসান মাহমূদের সাথে।
আমাদের সাক্ষাতের আয়োজনটি করে দেন এবং কী কী বিষয়ে মন্ত্রীমহোদয়ের সাথে আলোচনা করতে পারি তারও একটা ধারণা দেন ওস্তাদ প্রফেসর আবু রেজা মুহাম্মদ নিজামউদ্দীন নাদভী (মাননীয় সাংসদ সাতকানিয়া/লোহাগাড়া,চট্টগ্রাম)।
মন্ত্রী মহোদয়ের সাথে আমরা ৭টি বিষয়ে আলোচনা করি। তার একটি হল কওমি সনদের স্বীকৃতি। আমরা জানতে চেয়েছিলাম, কওমি মাদরাসার স্বীকৃতি কওমি অঙ্গনের দীর্ঘ দিনের প্রত্যাশা, সর্বোচ্চ ওলামাগণ স্বীকৃতির অধিকার নিয়ে দাবি করে আসছেন, হাজার-হাজার ছাত্র তাদের সনদের সরকারি মান পেতে আগ্রহী। এই বিশাল জনগোষ্ঠির প্রত্যাশার বিষয়ে সরকারের অবস্থান কি?
তিনি আমাদের জানালেন, সরকার স্বীকৃতির বিষয়টি চূড়ান্ত পর্যায়ে বিবেচনা করছে। শুধু স্বীকৃতি নয়; কওমির এই বিশাল জনগোষ্ঠির ধর্মীয় জ্ঞানের আলো তৃণমূল পর্যায়ে পৌঁছানোর লক্ষ্যে সরকার বিশহাজার প্রাইমারি স্কুলে বিশহাজার আলেম নিয়োগ দেবে।
তিনি এটাও বলেছিলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এ চাওয়াটির বাস্তবায়ন আওয়ামী সরকারের জন্য এত সহজও নয়, অনেক ঘাতপ্রতিঘাত-বাধা বিপত্তি পাড়ি দিতে হবে।
(মাওলানা ক্বামার, লেখক, মাননীয় মন্ত্রী, মাওলানা আহসান উল্লাহ, প্রফেসর আবু রেজা নাদভী)
যা হোক; আমরা লক্ষ্য করলাম, সরকার ওলামাগণকে যত কাছে নিতে চাচ্ছে কোনো অদৃশ্য কারণে হচ্ছে বিপরীত। এরপর সংঘটিত হল শাপলা ট্রাজেডি। নাস্তিক্যবাদের শাহবাগীয় ষড়যন্ত্র পরাস্ত হল শাপলার রক্তের মাধ্যমে।
‘হেফাজত’ এর বিশাল শাপলা চত্বরের জমায়েত সমগ্র রাষ্ট্রযন্ত্রে নাস্তিক্যবাদের প্লাবন রুখে দিল। দেশ ও জাতি রক্ষা পেল নাস্তিক্যবাদি ষড়যন্ত্র হতে। কওমির এ বিশাল জন প্রভাবের মূল্যায়ণ আরো তীব্রতর হলো।
অরাজনৈতিক এই শক্তিটির মূল্যায়ণে পাল্টে যেতে পারে ভোটের হিসাব-নিকাশ- এ ধারণাটি প্রবল আকার ধারণ করল।
কওমি সনদের স্বীকৃতির বিষয়ে সরকারের স্বদিচ্ছার প্রকাশ ঘটে আল্লামা আহমদ শফি দামাত বারকাতুহুমের নেতৃত্বে ওলামাগণের সাথে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কয়েক দফা বৈঠক ও সাক্ষাৎ এবং কওমি মাদরাসার প্রতি সরকারের আন্তরিকতাপূর্ণ আচরণ।
রাজনৈতিক সরকারের ওপর দেশের প্রতিটি নাগরিকের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটানোর দায়িত্ব থাকে। সরকারে থাকাকালে যথাসময়ে উপযুক্ত সিদ্ধান্ত নেয়া গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। এখানে ব্যর্থ হলে তার প্রভাব পড়ে পরবর্তি নির্বাচনে।
দেশের সকল জনগোষ্ঠির সাথে আন্তরিক ও হৃদ্যতাপূর্ণ মানসিকতা নিয়ে তাদের সুখ-দুখ ও সব ধরনের প্রয়োজনীয়তায় পাশে থাকার এবং রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে সহযোগিতা করার সুযোগ থাকে সরকারের।
ভোটাভোটির মাধ্যমে সরকার নির্বাচনের যুক্তিও সেখানে। কওমি স্বীকৃতি সুদূরপ্রসারী, যুগান্তকারী ও সময়োপযোগি একটি সিদ্ধান্ত। কওমি সনদের মাধ্যমে সুফল ভোগকারী নতুন প্রজন্ম এতে প্রভাবিত হবে তাতে সন্দেহ নেই।
বড় প্রশ্ন হল, এই জনগোষ্ঠি ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতির জন্য কতটুকু প্রস্তত? নিরেট ইসলামের এ দাওয়াতি কাফেলাটি রাষ্ট্রযন্ত্রের বিশাল কর্মযজ্ঞে অন্যদের সাথে নিঃসার্থতা ও আদর্শ দিয়ে উপযুক্তভাবে নিজেদের উপস্থাপন করতে এবং নিজস্ব তাহজীব-তামাদ্দুন ধরে রেখে পরিবেশের সাথে মানিয়ে নিতে পারবে কি না?
সংসদে কওমি সনদের বিল; পাঁচ বিশিষ্ট আলেমের প্রতিক্রিয়া
ইসলামি জ্ঞানের নির্দেশনা চর্চায় বিষয়টি সহজ হলেও কর্মযজ্ঞের বাস্তব ময়দানে বিপরীতমুখি ঝড়তুফান মোকাবিলার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতেই হবে। প্রমাণ করতেই হবে যে, ব্যক্তি জীবনসহ সকল ক্ষেত্রে ইসলাম চর্চার মধ্যেই রয়েছে সুফল।
স্বীকৃতি পাওয়ার পর যে দায়িত্ব বর্তাবে তা পালনের জন্য আরো বেশি আধ্যাত্মিক, জাগতিক ও মানসিক শক্তি প্রয়োজন। সনদের বিনিময়ে পাওয়া জীবনের সব সুযোগকে ইসলাম কায়েমের ব্রত হিসেবে নেয়ার টার্নিংটাই যদি গৌণ হয়ে যায়, তবে কওমি মাদরাসা শিক্ষার স্বার্থ ও স্বকীয়তা বিসর্জিত হবে।
এই ‘সনদ’ ওলামাগণ যেমন গ্রহণ করেছেন তেমনি ‘সনদ’ গ্রহণের লক্ষ্য-উদ্দেশ্যকে ইহজাগতিকতার উর্ধ্বে রাখা এবং শয়তানের হাতিয়ার হওয়া থেকে রক্ষার দায়িত্বও আলেমদের। কোন অসচেতনতায় যেন এই ‘সনদ’ ইসলাম ও দ্বীনি শিক্ষা ধ্বংসের কারন না হয়।
রাষ্ট্রীয় সনদ গ্রহণের বিপরীতে এই দিকটিও বিবেচনায় আনতে হবে যে, স্বাধীন ও স্বচ্ছভাবে রাষ্ট্রের কাছে জওয়াবদিহিতার অঘোষিত একটি দায়িত্ব অনিবার্য হল। যে কোনভাবে যে কোন পন্থায় প্রতিষ্ঠান পরিচালনার পথ বড় ধরনের দায়িত্বশীলতার মোড়কে আবৃত হবে।
সর্বাবস্থায় মহান আল্লাহর কাছে জওয়াবদিহিতার ভয়ের কারণে কওমিয়ানদের জন্য বিষয়টি সহজও বটে। মহান আল্লাহর ওপর ভরসা করে, উপযুক্ত ‘হিকমাহ’ অবলম্বনের মাধ্যমে অগ্রসর হতে হবে।
‘যে আল্লাহর ওপর ভরসা করে তার জন্যে তিনিই যথেষ্ট’ (ত্বালাক-৩)। ‘যাকে হিকমাহ দান করা হয়েছে, সে প্রচুর কল্যাণ প্রাপ্ত হয়েছে’। বাকারাহ-২৬৯
লেখক: আল মাহমুদ ফাউন্ডেশনের অন্যতম ব্যবস্থাপক ও ইসলামী জনকল্যাণ সংস্থা কাতারের সহ সাধারণ সম্পাদক
ব্যবসা এখন আপনার হাতের মুঠোয়। – বিস্তারিত জানুন