মুহাম্মদ যাইনুল আবিদীন
অতিথি লেখক
হযরত শাইখ আবু আব্দুল্লাহ উন্দুলুসী রহ. ছিলেন সমকালীন বিখ্যাত ওলী, মুহাদ্দিস ও কালের জগদ্বিখ্যাত মনীষীদের অন্যতম। তার সহজ পরিচয়ের জন্য এতটুকু বলাই যথেষ্ট। পৃথিবীখ্যাত ওলী হযরত জুনাইদ বাগদাদী রহ. ও হযরত শিবলী রহ.-ও ছিলেন তাঁর শিষ্য। কু-সহস্র খানকাহ তাঁর রুহানী আলোকে আলোকিত ছিল, শত-সহস্র মাদরাসা আবাদ ছিল তাঁরই ফয়েজ ও বরকতে। তাঁর মুরীদের সংখ্যাই ছিল প্রায় বার হাজার।
একবারের ঘটনা! হযরত শাইখ রহ. সফরের উদ্দেশ্যে বের হলেন। হাজার হাজার ভক্ত-মুরীদ এবং উলামা মাশাইখ তাঁর সঙ্গে। কাফেলায় সবিশেষ হযরত জুনাইদ বাগদাদী এবং হযরত শিবলী রহ.-ও আছেন।
ঘটনা সম্পর্কে হযরত শিবলী রহ. বর্ণনা করেন, আমাদের কাফেলা খুবই কল্যাণ ও বরকতের সাথে চলছিল। যেতে যেতে পথে একটি খৃষ্টান পল্লী পড়ল। আমরা পল্লীটি পার করে সামনে অগ্রসর হলাম। ধীরে ধীরে নামাজের সময় হয়ে আসছিল। এলাকাটিতে পানি ছিল না।
কিছু দূর পর ময়দানে একটি কূপ থেকে কয়েকটি মেয়ে পানি তুলছিল। হঠাৎ হযরত শাইখের নজর একটি মেয়ের ওপর পড়ল। মেয়েটির প্রতি দৃষ্টি পড়তেই তাঁর চেহারা কেমন যেন হয়ে গেল।
শিবলী রহ. বলেন, তারপর শাইখ মেয়েটির কথা বলে মাথা নিচু করে বসে পড়লেন। তিন দিন চলে গেল- কোনো খানাপিনা নেই, কারও সাথে কথাবার্তা ও নেই। আমরা সকলেই অস্থির।
তৃতীয় দিন আমি সাহস করে আরয করলাম, হযরত! আপনার এই অবস্থায় আপনার হাজার হাজার মুরীদ অস্থির, পেরেশান। তখন শাইখ সবার দিকে ফিরে বললেন, আমার প্রিয় ভায়েরা! আমি আর কতক্ষণ নিজের অবস্থা তোমাদের কাছে গোপন করব?
পরশুদিন আমি যে মেয়েটিকে দেখেছি তার ভালোবাসা আমাকে এমনভাবে গ্রাস করে ফেলেছে, আমার প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ এখন সেই ভালোবাসার অধীন। এখন আমার পক্ষে এই এলাকা ছেড়ে যাওয়া সম্ভব নয়।
তখন হযরত শিবলী রহ. বললেন, সায়্যিদী! আপনি ইরাকবাসীর পীর, মুরশীদ। আপনার জ্ঞান মর্যদা কৃচ্ছতা আল্লাহ ভীতি ও ইবাদত-বন্দেগী বিশ্বময় পরিচিত। আপনার মুরীদের সংখ্যা বার হাজার পার হয়ে গেছে। আল্লাহর কুরআনের বরকতে আমাদের অপমানিত করবেন না।
এর উত্তরে শাইখ বললেন, ‘প্রিয় বৎস! এটা আমার এবং তোমাদের ভাগ্য। আল্লাহর পক্ষ থেকে ফয়সালা হয়ে গেছে। আমার থেকে বেলায়েতের পোশাক–ওলীর আসন ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে। হিদায়েতের পথ রুদ্ধ করে দেয়া হয়েছে।’
এতটুকু বলে তিনি কাঁদতে শুরু করলেন এবং বললেন হে আমার সম্প্রদায়! আল্লাহর পক্ষ থেকে ফয়সালা হয়ে গেছে। এখন আর আমার হাতে কিছুই নেই।
হযরত শিবলী বলেন, অদ্ভুত এ ঘটনায় আমরাতো হতবাক! দুঃখে বেদনায় কাঁদতে শুরু করলাম আমরা। আমাদের সাথে শাইখও কাঁদছেন। বৃষ্টির পানিতে যেমন মাটি ভিজে যায়- আমাদের অশ্র-বন্যাতেও তেমন মাটি ভিজে গেল।
অতপর আমরা বাধ্য হয়ে স্বদেশে ফিরে এলাম। আমরা এসে যখন এই ঘটনা বর্ণনা করলাম তখন শাইখের মুরীদগণের মধ্যে কিয়ামতের ঘন্টা বেজে ওঠল। কান্নার রোল পড়ে গেল।
কয়েকজন তো চিন্তা ও বেদনার সঙ্গে সঙ্গে এই পার্থিব দুনিয়াকে বিদায় জানাল। অবশিষ্টরা বেদনা-ভারাক্রান্ত মনে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল আর পরম দয়ালু মালিকের দরবারে দুয়া করতে লাগল।
তারা কেঁদে কেঁদে বলতে লাগল, ওগো হৃদয় মন ও কলবের মালিক! তুমি আমাদের শাইখকে সুপথে এনে দাও। তাকে তার হারানো আসনে পুনঃপ্রতিষ্টিত করো।
তারপর সকল খানকাহ বন্ধ হয়ে গেল। সবত্র যেন শোকের পর্দা পড়ে আছে। হৃদয়ে হৃদয়ে কেবল বেদনার মাতম। এভাবে কেটে গেল দীর্ঘ একটি বছর। এক বছর পার হবার পর মুরীদগণ চিন্তা করলেন, একবার গিয়ে হযরত শাইখের অবস্থা দেখে আসা দরকার।
তখন আমাদের একটি জামাত এই উদেশ্যে বের হলো এবং সেই গ্রামে পৌঁছে লোকদের জিজ্ঞেস করল হযরত শাইখের অবস্থা। তখন লোকেরা বলল, তিনিতো জঙ্গলে শুকর চরাচ্ছেন। তখন আমরা বললাম, হে আল্লাহ! একি হলো।
তখন গাঁয়ের লোকেরা বলল, তিনি সরদারের মেয়েকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। তখন সরদার তাকে মাঠে জঙ্গলে গিয়ে শুকর চরানোন শর্তে মেয়ে বিয়ে দিতে রাজী হোন। তিনি সে শর্ত মেনে নিয়েই বিয়ে করেন।
একথা শুনে তো আমরা হয়রান। দুঃখে আমাদের কলিজা বিদীর্ণ হবার উপক্রম। চোখ দিয়ে বন্যার মতো পানি বইতে লাগল। বহু কষ্টে নিজেদের সামলে নিয়ে জঙ্গলের দিকে চলতে লাগলাম। জঙ্গলে গিয়ে দেখি, সত্যিই আমাদের শাইখ শুকর চরাচ্ছেন। তার মাথায় খৃস্টানদের ক্যাপ, কোমরে খৃষ্টীয় পৈতা বাঁধা।
যে লাঠিতে ভর করে আমাদের ওয়ায-নসীহত করতেন সেই লাঠির উপর ভর করে শুকরের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। এই অবস্থা যেন আমাদের কাঁচা ঘায়ে লবণ ছিটিয়ে দিল।
শাইখ আমাদের আসতে দেখে মাথা নিচু করে ফেললেন। আমরা কাছে গিয়ে ‘আস সালামু আলাইকুম’ বললাম। হযরত শাইখ খুবই নমিত কণ্ঠে আমাদের সালামের উওর দিলেন।
হযরত শিবলী আরয করলেন, আপনি হাদিস তাফসীর এবং ইলম ও মর্যদায় এত বিশাল অধিপতি হয়েও আজ এ অবস্থায় কেন?
উত্তরে শাইখ বললেন, ভাই! এখানে আমার কিছুই করার নেই। আমার মালিক আমাকে যেমনটি করতে চেয়েছেন করে দিয়েছেন। এবং এতটা কাছে টেনে নেবার পর যখন চেয়েছেন তখন আবার স্বীয় দরজা থেকে দূরে ঠেলে দিয়েছেন। আর তার সিদ্ধান্ত কে ফিরাতে পারে?
হে বৎসগণ! আল্লাহর ক্রোধ ও গযবকে ভয় করো। নিজেদের ইলম ও মর্যদা নিয়ে কোনোরূপ অহংকার করো না।
অতপর আকাশের দিকে দৃষ্টি তুলে বললেন, ‘হে আমার মালিক! তোমার সম্পর্কে তো আমার এমন ধারণা ছিল না। আমিতো ভাবিনি, তুমি আমাকে অপমানিত করে স্বীয় দরজা থেকে এইভাবে তাড়িয়ে দিবে।’
এই বলে তিনি আল্লাহর দরবারে আশ্রয় চাইতে শুরু করলেন। এবং কাঁদতে শুরু করলেন। বললেন, শিবলী! অন্যকে দেখে উহদেশ গ্রহণ করো।
হযরত শিবলী কাঁদতে কাঁদতে আল্লাহর দরবারে আরয করলেন, ওগো আমাদের পরওয়ারদেগার! ওগো মালিক! আমরা তোমারই কাছে সাহায্য চাই। আশ্রয় চাই তোমারই সকাশে। তুমিই আমাদের একমাত্র ভরসা। আমাদের এই বিপদ থেকে রক্ষা করো। তুমি ছাড়া আর কে রক্ষা করবে আমাদের?
ব্যবসার নিয়ে জটিলতার দিন শেষ – বিস্তারিত জানুন
তার কান্না ও বেদনাপ্লাবিত বিলাপ দেখে শুকররা পর্যন্ত এসে তার পাশে দাঁড়াল। তিনি চিৎকার করে কাঁদতে লাগলেন। তার কান্নায় হযরত শাইখও কেঁদে কেঁদে ক্লান্ত।
বেদনা কিছুটা প্রশমিত হবার পর শিবলী আরয করলেন, শাইখ! আপনিতো পুরো কুরআনের হাফেজ ছিলেন। সাত কেরাত অনুযায়ী কুরআন পড়তে পারতেন। এখন কি কুরআনের কোনো আয়াত মনে আছে?
শাইখ বললেন, প্রিয় বৎস! মাত্র দুটি আয়াত মনে আছে। একটি আয়াত হলো- ‘আল্লাহ যাকে অপমানিত করেন কেউ তাকে সম্মান দিতে পারে না। নিশ্বয় আল্লাহ যা চান তাই করেন ।
দ্বিতীয় আয়াতটি হলো, ‘যে ব্যক্তি ঈমানের বদলে কুফরকে গ্রহণ করেছে সে নিশ্চয় সরল পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়েছে।’
শিবলী আরয করলেন, হযরত! আপনার তো ত্রিশ হাজার হাদীস সনদসহ মুখস্ত ছিল। এখন কি কোনো হাদীস মুখস্ত আছে?
শাইখ বললেন, মাত্র একটি হাদীস মুখহ আছে, ‘যে ব্যক্তি তার দীনকে পরিবর্তন করে ফেলে তাকে হত্যা করে ফেলো।
হযরত শিবলী রহ. বলেন, আমরা শাইখের এই অবস্থা দেখে খুবই হতাশ হলাম। কী আর করব। আবার রওনা হলাম বাগদাদের উদ্দেশে। কিন্ত আল্লাহর কি অসীম করুনা! আমরা মাত্র তিন মনযিল পথ অতিত্রুম করেছি।
তৃতীয় দিন দেখি কি, আমরা যেখানে অবস্থান করছি তার সামনের দিককার একটি নহর থেকে গোসল করে হযরত শাইখ উঠে আসছেন এবং সুউচ্চ কণ্ঠে এই কালিমা পাঠ করছেন, ‘আশহাদু আল্লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়া আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসূলুল্লাহ’।
তখন যে আমাদের কী খুশী ও আনন্দ অনুভূত হচ্ছিল তা কেবল সেই ব্যক্তির পক্ষেই উপলব্ধি করা সম্ভব যিনি আমাদের পূর্বকার বেদনাঘন অবস্থা সম্পর্কে অবগত।
পরে অবশ্য আমরা হযরত শাইখকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, হযরত! আপনি যে এই কঠিন পরীক্ষায় নিপতিত হলেন এরও কি কোনো কারণ ছিল?
হযরত শাইখ বললেন, হ্যাঁ, অবশ্যই কারণ ছিল। আমরা যখন সেই পল্লীটির মূর্তিশালা এবং গীর্জাঘরের পাশ দিয়ে আসছিলাম তখন অগ্নিপূজারী আর ত্রুশপূজারীদের দেখে আমার মনে খুব অহংকার হলো, আমরা মুমিন। একত্ববাদে বিশ্বসী। আর এই মূর্খ আহম্মকের দল কত বোকা ও নির্বোধ! অনর্থক জড় পদার্থের পূজা করছে।
আমি যখন মনে মনে একথা ভাবছি, তখনই আমি একটি অদৃশ্য কণ্ঠ শুনতে পেলাম, ‘এই ঈমান ও তাওহীদ তোমাদের নিজস্ব অর্জন নয়; বরং এটা আমার দেয়া তাওফিক। আচ্ছা, তুমি কি তোমার ঈমানকে নিজের এখতিয়ারভূর্ক্ত ও ইচ্ছাধীন মনে কর? যদি তুমি চাও তাহলে এখনি তোমাকে দেখাচ্ছি। আর ঠিক তখনই আমার কাছে মনে হলো যেন একটি পাখি আমার কলব থেকে বেরিয়ে গেল। প্রকৃত পক্ষে ওটাই ছিল আমার ঈমান।
(দেখুন উম্মুল আমরায, শাইখুল হাদিস মাওলানা যাকারিয়া রহ. : ২৫ পৃ.)
লক্ষ করার বিষয়, অহংকার কত ভয়ঙ্কর বিষয়। এর সামান্য ছোঁয়ায় কত বড় বুযুর্গ কোথা থেকে কোথায় নিক্ষিপ্ত হয়েছেন।
অহঙ্কারের ভয়ঙ্কর পরিণতি সম্পর্কে হযরত সা. ইরশাদ করেছেন : ‘যার অন্তরে বিন্দু পরিমাণ অহংকার থাকবে তাকে উপুড় করে জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত করা হবে।’ (প্রাগুক্ত, ১১পৃ.)
যে অহঙ্কার এত ভয়াবহ ব্যাধি সে অহঙ্কার থেকে আমরা কজন মুক্ত আছি, শুনি। সুতরাং আলোচ্য ঘটনা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে পরকালের চূড়ান্ত বিচারের পূর্বেই নিজেদের শুধরে নেয়া অধিক সমিচীন নয় কি?
লেখক: কলামিস্ট, গবেষক ও মুহাদ্দিস