সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪ ।। ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬


স্বীকৃতির পর আমাদের কী করণীয়?

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মাওলানা আশরাফ উদ্দিন খান
আলেম, গবেষক

কওমি মাদরাসার দাওরায়ে হাদিসের সনদকে স্নাতকোত্তর সমমানের স্বীকৃতির বিষয়টি এবার আইনি বৈধতা পাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে সোমবার (১৩ আগস্ট) তেজগাঁওয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে মন্ত্রিসভার বৈঠকে এ অনুমোদন দেয়া হয় বলে জানান মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম।

বৈঠক শেষে প্রেস ব্রিফিংয়ে তিনি বলেন, ‘কওমি মাদরাসাসমূহের দাওরায়ে হাদিস (তাকমিল) এর সনদকে মাস্টার্স ডিগ্রি (ইসলামিক স্ট্যাডিজ ও আরবি) সমমান প্রদান আইন, ২০১৮’ শীর্ষক আইনের খসড়ার নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা।

গত বছরের ১১ এপ্রিল গণভবনের বাংলাদেশ শীর্ষ আলেমদের সামনে কওমি মাদরাসার স্বীকৃতি ঘোষণা করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ ঘোষণার পর শিক্ষা মন্ত্রণালয় একটি প্রজ্ঞাপনও জারি করে। কিন্তু আলেমরা দীর্ঘ দিন ধরেই দাবি জানিয়ে আসছিরেন যেন আইনটি মন্ত্রিসভা ও সংসদে উত্থাপন করে পাশ হয়।

জানা যায়, প্রজ্ঞাপন জারির পর বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) উচ্চপর্যায়ের আলেমদের সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠক কর এ সংক্রান্ত আইনের খসড়া চূড়ান্ত করে। ঘোষণার দেড় বছর পর আজ মন্ত্রিসভায় আলোচনার মাধ্যমে চূড়ান্ত হলো এ আইন।

আইনটির মাধ্যমে দাওরায়ে হাদিসের শিক্ষার্থীরা ইসলামিক স্টাডিজ ও আরবি সাহিত্য- এ দুই বিষয়ে মাস্টার্সের মর্যাদা পাবে। প্রেস ব্রিফিংয়ে মন্ত্রীপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম বলেন, কওমি মাদরাসার ১৫ লাখ শিক্ষার্থীকে মূল ধারায় আনতে এ আইন চূড়ান্ত অনুমোদন দেয়া হয়েছে।

মাদরাসা থেকে আগে যেসব সনদ দেয়া হয়েছে তা এই আইনের আওতায় গৃহিত হবে বলেও জানান তিনি। (ourislam24.com)

সন্দেহ নেই যে কওমি মাদরাসা শিক্ষা ব্যবস্থার জন্যে এটি একটি ইতিবাচক সংবাদ, যা দীর্ঘ দিনের ফিকির ও মোজাহাদার মাধ্যমে অর্জিত হল এবং আইনি বাস্তবায়নে অনুমদিত হল। যে কোন নতুন পরিস্থিতি, উদ্যোগ, পরিকল্পনা একদিকে যেমন আশা ও সম্ভাবনা দ্বারা ঘিরা থাকে, ঠিক তেমনি তার বিপরীতে তাকে নিয়ে সংশ্লিষ্ট অনেকের মনেই দ্বিধা, দুঃশ্চিন্তা ও আতংক বিরাজ করে।

কওমি মাদরাসার স্বীকৃতির বিষয়ের সরকারের আজকের সিদ্ধান্ত এই প্রবণতার বাইরের কিছু নয়, যার প্রমাণ সিদ্ধান্তকে কেন্দ্র করে এই পর্যন্ত যতগুলো মতামত ও প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করা হয়েছে তার সব কয়টিতেই এই মিশ্র প্রতিক্রিয়া অনুভব করা যায়।

অনেকে অনেকভাবে বিষয়টি নিয়ে চিন্তা, বিশ্লেষণ, মূল্যায়ন করছেন ও করবেন। ব্যক্তিগত ভাবে সিদ্ধান্তকে আমি এই ভাবে চিন্তা করি যে, কারো হাতে সংরক্ষিত পুজি বা মূলধন রয়েছে, যেটাকে তিনি বিচক্ষণতার সাথে ব্যবহার করার মাধ্যমে যেমন লাভবান হতে পারেন, ঠিক তেমনি সেটাকে কাজে না লাগিয়ে যে অবস্থায় আছে সেই অবস্থায় ফেলে রাখতে পারেন।

কওমি মাদরাসার শিক্ষার সরকারি স্বীকৃতি না থাকার কারণে যে সীমাবদ্ধতা ছিল, এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে সেই সীমাবদ্ধতা উঠে যাওয়ার ব্যবস্থা হল। এরপর আমাদের অবস্থা দুইয়ের একটি হতে পারে- এটা নিয়েই সন্তুষ্ট হয়ে থাকা অথবা এটাকে ভিত্তি বানিয়ে এই সম্ভাবনাকে আরো অনেক দূরে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া।

একটি শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্র, উম্মতের মধ্যে কি ধরনের মৌলিক পরিবর্তন ঘটানো সম্ভব সেটা নতুন করে বলার কোন দরকার নেই। যারা শিক্ষক তাদের বলা হয়ে থাকে ‘মানুষ তৈরির কারিগর’, শিক্ষা ব্যবস্থা হচ্ছে মানুষ তৈরির মাধ্যম, আর যারা শিক্ষা ব্যবস্থার পরিকল্পনা ও নেতৃত্বে থাকেন তারা মানব তৈরির ব্যবস্থার নেতৃত্ব প্রদান করে থাকেন।

যে কোন আদর্শ, ব্যবস্থা, মূলনীতির দুটি ভিন্ন ভিন্ন দিক বা উপাদান থাকে, এক. অপরিবর্তনীয় উপাদান, দুই. নমনীয় উপাদান যা যুগ, সমাজ ও বিভিন্ন প্রেক্ষাপটের ভিত্তিতে পরিবর্তনের আওতায় থাকে। কওমি শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যেও এই দুই ধরনের উপাদান বিদ্যমান।

এখানে রয়েছে এমন কিছু উপাদান যাদেরকে বাদ দিলে বা পরিবর্তন ও পরিমার্জন করতে গেলে সেটাকে আর কওমি শিক্ষা বলার বা নামকরণের কোন উপায় ও সুযোগ থাকে না, আর দ্বিতীয় কিছু উপাদান রয়েছে যাকে পরিবর্তন ও সংস্কার সাধন না করলে এই শিক্ষাকে সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করার পরিবেশ সৃষ্টি হয় না।

স্থির ও অকাট্য উপাদানের পরিবর্তনের চিন্তা যেমন অন্যায় ঠিক তেমনি নমনীয় উপাদানের সংস্কার না করার চিন্তা করা সম পর্যায়ের অন্যায়, কারণ উভয় অবস্থানের কারণেই মূল বিষয়ের ক্ষতি হয়ে থাকে।

মন্ত্রীপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলমের বক্তব্য ‘কওমি মাদরাসার ১৫ লাখ শিক্ষার্থীকে মূল ধারায় আনতে এ আইন চূড়ান্ত অনুমোদন দেয়া হয়েছে’ এর জের ধরে বলতে চাই, ১৫ লাখ শিক্ষার্থীর সার্বিক ভবিষ্যৎ এই শিক্ষা ব্যবস্থার সাথে জড়িত। সার্বিক ভবিষ্যৎ বলার উদ্দেশ্য এটাই যে, শিক্ষা ব্যবস্থা শুধুমাত্র শিক্ষার সংকীর্ণ ধারণা নিয়ে কাজ করে না, বরং প্রতিটি শিক্ষার্থীর জীবনের সকল দিকের গঠন ও উন্নতি নিয়ে কাজ।

শিক্ষা ব্যবস্থা শিক্ষার্থীদের জ্ঞান, মেধা, চিন্তার উৎকর্ষতার পাশাপাশি তাদের শারীরিক, মানসিক, আখলাক, চরিত্র, কর্মযোগ্যতা, সৃজনশীল শক্তি, নেতৃত্বের গুণসহ যাবতীয় মানবীয় গুণ ও অবস্থার উন্মেষ কি ভাবে ঘটানো যায় তা নিয়ে ফিকির করে থাকে এবং কওমি মাদরাসার ফিকির আরো অনেক গভীর, কারণ এটা একদিকে যেমন শিক্ষার্থীদের দুনিয়া নিয়ে ফিকির করে আরেক দিকে বরং সেটাই হচ্ছে কওমি মাদরাসার মূল ‘রিসালাহ’ তাদের ও উম্মতের আখেরাত ও ধর্মীয় জীবন নিয়ে ফিকির করে থাকে। কাজেই এই মাদ্রাসার দায়িত্বের পরিধি অনেক বিস্তৃত, অনেক গভীর।

একটি ধারণা এখানে স্পষ্ট করার চেষ্ঠা করতে চাচ্ছি, যেটা হচ্ছে ‘মূল্যবোধ বা মূলনীতিকে ব্যবহারিক রুপদান করা’র ধারণা। মুসলিম উম্মাহ হিসাবে আমাদের সামনে বিভিন্ন মূলনীতি ও মূল্যবোধ রয়েছে, যেগুলোর উদ্দেশ্য হচ্ছে আমাদের জীবন যাপনের জন্যে সঠিক ও উপযুক্ত পদ্ধতি নির্ধারণ করা।

এই জন্যে আমাদের সেই সকল মূলনীতি ও মূল্যবোধকে দৈনন্দিন কর্মে ও আচরণে রুপান্তর করার জন্যে চিন্তা ও ইজতিহাদের দরকার পরে। সুদের লেনদেন ইসলামি শরিয়তে হারাম, সুতরাং সুদ থেকে মুসলিম উম্মাহকে অবশ্যই দূরে থাকতে হবে।

অন্যদিকে ব্যবসা শরিয়তে হালাল করা হয়েছে, অর্থনৈতিক উন্নতির জন্যে হালাল উপায়ে ব্যবসা-বাণিজ্য করতে হয়। সুদ হারাম এটা একটি ইসলামি মূলনীতি। এই মূলনীতি বাস্তবায়ন করার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান, পদ্ধতি, কৌশল উদ্ভাবন করা হয়েছে।

আজকে ইসলামি অর্থনীতির আকৃতিতে আমাদের সামনে জ্ঞান ও কৌশলের যে বিশাল রাজ্য গড়ে উঠেছে, সন্দেহ নেই কিছু সংখ্যক মুজতাহিদ গবেষক মুসলিমের নিরবচ্ছিন্ন গবেষণা, ইজতিহাদের মাধ্যমেই সেটা গড়ে উঠেছে।

আল্লাহ তায়ালার ঘোষণা অনুযায়ী পবিত্র কুরআনের হিফাজতের নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু দেখা যায় কুরআন অবতীর্ণের সেই যুগ থেকে ও পরবর্তীতে সাহাবায়ে কারাম রা. এর যুগ থেকেই এই মূলনীতির বাস্তবায়ন কিভাবে হতে পারে সেটা নিয়ে চিন্তা, ইজতিহাদ করা হয়েছে।

হিফফুল কুরআন, তাদভিনে কুরআনের মত বিভিন্ন পদ্ধতি উম্মতের সামনে এসেছে। সেই ঘোষণার বাস্তবায়নের জন্যে উম্মতের মধ্যে কুরআনের হিফজ করার আগ্রহসহ আরো বিভিন্ন পদ্ধতি চালু হয়েছে।

বিচার বিভাগের কথা ধরা যাক, ইসলামি শরিয়ত এই বিষয়ে মৌলিক নীতিমালা নির্ধারণ করে দিয়েছে, সেই মূলনীতির আলোকে বিচার বিভাগের পদ্ধতি ও কৌশল হিসাবে কত অসংখ্য ইজতিহাদ ও গবেষণা হয়েছে তার কোন অনুমান করা যাবে না। এই সবকিছু হচ্ছে মূল্যবোধ ও মূলনীতিকে ব্যবহারিক রুপদান করার ধারণা।

একটি ইসলামি মূলনীতি হচ্ছে ‘মানবিক সহযোগিতার গুণ’। অসহায়কে সাহায্য করা একটি ইসলামি মূল্যবোধ, যে বিষয়ে ইসলাম সব সময় গুরুত্ব প্রদান করেছে। নিজেদের মধ্যে সহযোগিতার গুণ সৃষ্টি করা, অভাব ও বিপদগ্রস্তদের সহযোগিতা করা একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত।

অতীতে এটা সম্ভব ছিল অতি সরলভাবে ও ব্যক্তিগত পর্যায়ে, কিন্তু এখন ব্যক্তিগত পর্যায়ের সাথে সাথে –সমস্যার গভীরতার দিকে খেয়াল করে, যেমন প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে- সামস্টিক পর্যায়ে এই গুণটি উম্মতের মধ্যে কার্যকর রাখা অতি জরুরি।

সামষ্টিক পর্যায়ে এই মূলনীতি বাস্তবায়নের জন্যে প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে কাজ করা অতি জরুরি। তাই এখানে চিন্তা-ইজতিহাদের মাধ্যমে যুগ ও সমস্যার আলোকে কর্ম কৌশল নির্ধারণ করা জরুরি।

অন্যদিকে মানুষ ‘ভোক্তা জীব’ অর্থাৎ মানুষ যেমন তার প্রয়োজন পূরণ করতে ভোগ করে থাকে, ঠিক তেমনি বিভিন্ন ব্যবস্থা, পদ্ধতিও মানুষ ভোগ করে থাকে। তাই দেখা যায় সময়ের ব্যবধানে মানুষের সামনে বিভিন্ন পুরাতন পদ্ধতির কার্যকারিতা হ্রাস পেতে থাকে এবং সেই স্থানে তাকে নতুন নতুন পদ্ধতি আবিস্কার করতে হয়। এখানেই চিন্তা ও ইজতিহাদের দরকার পরে।

আমাদের মূল বিষয়ের সাথে এই বিষয়ের অবতারণার উদ্দেশ্য ছিল এই দিকে ইঙ্গিত করা যে, চিন্তা-ফিকির ও ইজতিহাদের মাধ্যমে মূলনীতিকে মূলনীতির পরিধি থেকে বের করে উম্মতের বাস্তব জীবনে সেটা কার্যকর করা হয়ে থাকে এবং এর মাধ্যমে সেই মূলনীতির ফলাফল উম্মতের জীবনে প্রকাশ পেতে থাকে।

এ সকল বিষয়ে ইজতিহাদ ও গবেষণা যত বিস্তৃত হয়ে থাকে, সেই মূলনীতির পরিধি তত বেশি ছড়িয়ে পড়তে থাকে। ধরে নিলাম কওমি মাদরাসা থেকে অর্জিত সনদ এখন সরকারের কাছে ‘স্বীকৃত একটি সনদ’। এই অবস্থা বা বাস্তবতাকে আমরা আমাদের বাস্তব অবস্থার আলোকে ও পরিবর্তিত সমাজ ও বিশ্ব ব্যবস্থাকে সামনে রেখে যত বেশি কার্যকর করার চিন্তা করবো, ‘স্বীকৃতি’ থেকে ঠিক তত বেশি আমরা উপকৃত হব, আমাদের শিক্ষার্থীরা তত বেশী উপকৃত হবে, এবং জাতি এ থেকে তত বেশি উপকৃত হবে।

আর যদি তা না করে স্বীকৃতি নিয়ে আমরা সন্তুষ্ট হয়ে বসে থাকি, তাহলে একটি বিশাল সম্ভাবনা থেকে আমরা মাহরুম রয়ে গেলাম।

কাজেই এখানে লক্ষ্যণীয় হচ্ছে সনদের স্বীকৃতির পরেও আরো কোন ধরনের সীমাবদ্ধতা সামনে থাকলে সেটা দূর করার ফিকির ও পরিকল্পনা করা এবং একজন অভিজ্ঞ ব্যবসায়ী যেমন নিজের পণ্যের জন্যে নতুন নতুন বাজার সৃষ্টির চিন্তা করে থাকেন, তেমনি আমাদেরও উচিত হবে এই সম্ভাবনাকে আরো ব্যাপক ভাবে কি ভাবে কাজে লাগানো যেতে পারে সেই পথে অগ্রসর হওয়া।

শিক্ষার্থীদের শিক্ষা সুযোগ ও কর্ম সুযোগ এর মাধ্যমে আরো বেশি বিস্তৃত ও কার্যকর করার ফিকির করা। আল্লাহ আমাদেরকে তাওফিক দান করুন।আরও পড়ুন

মন্ত্রিসভায় দাওরায়ে হাদিসকে মাস্টার্সের চূড়ান্ত সমমান
প্রধানমন্ত্রীকে আল্লামা আহমদ শফীর অভিনন্দন!
ভোটের আগে জোটের খেলায় ইসলামপন্থীরাও!

-আরআর


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ