রেক্সোনা জাহান জুবাইদা
দুপরের খাবার পর বাচ্চাদের ঘুমানোর জন্য বারবার তাগিদ দিচ্ছিলাম। আমার ধমকিতে বিন্দুমাত্র পাত্তা না দিয়ে, ওদের খেলতে বসে যাওয়ার অবাধ্যতায় আমি রীতিমত অবাক! রাগ করার উপায় নেই। কারণ, ইতিমধ্যে মিনতিপূর্ণ কণ্ঠে বড়জনের আবদার - আম্মু, আজকে আমরা ঘুমাবো না!
কি আর করা। খেলার ভূবনে ওদের ছেড়ে দিয়ে ভাবতে থাকলাম - আমরা এই বয়সে কত স্বাধীন ছিলাম! খোলা মাঠের মুক্ত বাতাসে খেলতে খেলতে হারিয়ে যেতাম প্রকৃতির দিগন্ত সীমায়।
আর ওরা? শহরের বদ্ধ পরিবেশে মাত্র কয়েক বর্গেের ফ্লাটের চার দেয়ালের মাঝে বন্ধি!
খেলার কয়েক মিনিটও হয়নি, বড় জন দৌড়ে এসে খবর দিল - আম্মু, দরজায় কে যেন নক করছে ? ওর চোখ-মুখে আতঙ্কের ছাপ।
কয়েক মাস আগে বেড়াতে যাওয়ার পরদিনই বাসা চুরি গিয়েছিল। ফ্লাটের দরজার তালা ভেঙ্গে বেশ মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিয়েছিল চোর। সেই থেকেই দরজায় কেউ নক করলে ভয় পেয়ে যায় ওরা।
পরিচিত কণ্ঠ পেলে আশ্বস্ত হয়। আর বাবার কন্ঠে হয়ে ওঠে প্রফুল্ল। কিন্তু এখন দরজার ওপারে কারো সাড়া না পেয়ে ওরা রীতিমত আতঙ্কিত। দুপরের নির্জনতা ওদের ভয়কে বাড়িয়ে দিয়েছে দ্বিগুন।
দরজার লুকিং গ্লাসে চোখ রেখে জানতে চাই কে? মহিলা কণ্ঠে ক্ষিন আওয়াজ আসে - আমি।আশ্বস্ত হয়ে দরজা খুলে ফেলি। তরুণী মহিলা সাত বছরের ছেলের হাত ধরে দাড়িয়ে আছে। স্বাভাবিক কথা বলার শক্তিও যেন নেই।
ছেলেটাকে দেখিয়ে বলল- জন্ডিস হয়েছে। প্রতিদিন জন্ডিসের টিকা দিতে হয়। ১৭০ টাকা করে লাগে। ইট ভেঙ্গে ১০০ টাকা হয়েছে। আরো ৭০ টাকা লাগবে।
আমি কিছু টাকা এনে দিতেই কেঁদে ফেলল মহিলা। সিড়ি ভেঙ্গে ভেঙ্গে কোথাও ছয়তলা, কোথাও পাঁচতলার অন্তত বিশটা বাসা নাকি সে গিয়েছে। কিন্তু শূন্য হাতেই ফিরতে হয়েছে। আমার নিচের ফ্লাটের ভাবীও কিছু দিয়েছে, এতগুলো বাসা থেকে মোট দু জায়গায় কিছু টাকা পেল সে।
ইতিমধ্যে আমার পাশের ফ্লাটে নক করলো তার ছেলে। সাড়া না পেয়ে দরজার বাহিরে রাখা একজোড়া জুতা হাতে নিয়ে দেখতে থাকলো। চোখে মুগ্ধ দৃষ্টি। জুতাগুলো পাশের ফ্লাটের ছেলের । ঠিক ওর বয়সী হবে। তাইতো জুতাগুলোর দিকে এত মুগ্ধ দৃষ্টি।
হয়তো ভাবছে এরকম জুতা যদি ওরও থাকতো! ঠিক এময়ে দরজা খুললেন পাশের ফ্লাটের আন্টি। নাতির জুতা টোকাই ছেলের হাতে দেখেই গেলেন ক্ষেপে।
- এই, কি করছো? জুতো হাতে নিয়েছো কেন তুমি? (আন্টি এমনিতেই ভদ্র। গরিবদের সাহায্যও করেন যতেষ্ট। কিন্তু নাতির জুতো হাতে নেওয়াতে রেগে গেছেন।)
সাহায্য চাওয়া মহিলার কপাল মন্দ। ছেলে জুতো হাতে নেওয়াতে ভুল বোঝাবুঝি। আন্টি টাকা না দিয়ে দুম করে দরজা বন্ধ করে দিলেন। শুধু তাই নয়, একটু পর পর দরজা খুলে চেক করতে লাগলেন মহিলা তার সন্তানকে নিয়ে জুতাসহ উধাও হয় কিনা।
অসহায় মহিলা বুঝতে পেরে দুঃখিত হয়ে বলল- আফা, তিনি এমন করছেন যেন আমি জুতা চোর। হায়রে বড়লোক! টাকা নিয়া কি কবরে যাবি? সব টাকা উপরেই পড়ে রবে। তোরাও যে কবরে যাবি, গরীবরাও সেই কবরেই যাবে। তোদের জন্য আলাদা কবর তৈরি হবে না, যেটার বড়াই তোরা করবি।
এরমধ্যে পাশের আন্টি আবার দরজা খুলে জানতে চান - কি গো বসে রইলা যে তুমি? (মহিলা ক্লান্ত হয়ে বসে ছিল সিঁড়ির মাথায়) এই দুপরে মানুষ ঘুমাবে না?
এবার মারমুখি হয়ে মহিলা জবাব দেয়, আন্নে ঘুমান। সমস্যা কি? আমি কি আন্নেরে বিরক্ত করছি নাকি? আমি এই আফার সাথে দুঃখের কথা কইতেছি।
ঘটনা ঝগড়ার দিকে মোড় নেয় কিনা, এ সম্ভাবনায় আমি মহিলাকে বুঝিয়ে বিদায় দিলাম। মহিলা যেতে যেতে বলল- এদের মন এত কম জন্যই এরা বড়লোক। একজোড়া জুতার চিন্তায় ঘুম আসেনা। আল্রাহর কাছে বিচার দিমু।
এদিকে পাশের আন্টি আশ্বস্ত হয়ে দরজা বন্ধ করলেন। আর আমি? বিচিত্র অভিজ্ঞতা নিয়ে ভাবতে থাকলাম অনেক কিছু। খুজে পেলাম নীতিকথা।
হবে না ধনবানদের জন্য কোন রাজ কবর ! যা গরিবদের কবর থেকে আলাদা। গরিবেরা যদিও ভান ধরে কিংবা মিথ্যে বলে সাহায্য চায়, তবুও সাহায্যের হাত বাড়ানো মানবতার কাজ।
কেননা, অভাব থেকেই তারা মিথ্যে বলা শিখে যায়। আর মিথ্যে চাওয়া হলেও দানটা তো আর মিথ্যে নয়। মন উজাড় করেই দান করা হয়। তাই নিয়তের কারণে দানের সওয়াব পেয়েই যায় দানকারী।
আমার পিচ্চি মেয়েটাই একদিন আমাকে লজ্জিত করেছিল। শিক্ষা দিয়েছিল অন্য রকমভাবে।
কোন ভিক্ষুক আসলে ও দৌড়ে যায় দান করতে। টাকার ব্যাগ ধরেনা। কিন্তু চালের কন্টিনার থেকে নিম্ন হাফ কেজি করে চাল উধাও হয়ে যেত। অনেক বুঝিয়েও কাজ হয়নি।
তাই একদিন বকা দিলাম। খুব অভিমান হল ওর। কাঁদো গলায় আধোভাবে বলল, লোকটা খুব বুড়ো তাই দেই। প্রতিবার লোকটা আমার মাথায় হাত রেখে দোয়া করে। আমি বললাম,সাধ্য বুঝে দান করতে হয়।
- আম্মু হাফ কেজি চাল কি সাধ্যের বাইরে? আব্বু তো সবসময় চালের বস্তা নিয়ে আসে। তুমি তো সব সময় বল বেশি বেশি দান করতে। আর এখন তুমিই বকা দিচ্ছ।
আমি লজ্জায় পড়ে গেলাম। মনে মনে বললাম, হাফ কেজি চালের বিনিময়ে আমার মেয়ে যদি অসহায় বৃদ্ধের অন্তর ভরা দোয়া পুঁজি করে মন্দ কি! নেওয়ার সময় এখনি। যাক না সপ্তাহে ৫ দিন হাফ কেজি করে চাল।
এ ভাবনা আমার এমনি এমনি হয়নি। আমার মেয়ের দেয়া শিক্ষা থেকে তৈরি হয়েছে।
আমরা মানুষ বড় অদ্ভুত। শুধু উপদেশ কিংবা পরামর্শ দিতে পছন্দ করি। কাজের বেলায় জিরো।
(লেখকের ফেসবুক টাইমলাইন থেকে নেয়া)
কুরআন বিরোধী আইন করায় তিউনিশিয়ায় নারীদের বিক্ষোভ
-আরআর