জাতীয় পার্টির (জাপা) সঙ্গে নির্বাচনী সমঝোতায় এসেছে দেশের অন্যতম ইসলামী দল বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস। শাইখুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক রহ. প্রতিষ্ঠিত দলটি আজ রাজধানীতে এক সমাবেশের মাধ্যমে এ সমঝোতার ঘোষণা দেয়।
নির্বাচনী এ জোট নিয়ে আলোচনা সমালোচনা শুরু হয়েছে। মজলিস নেতারা বলছেন, এ জোটের মাধ্যমে সংসদে ইসলামের প্রতিনিধিত্ব দেখা যাবে। শক্তিশালী হবে আলেমদের রাজনৈতিক দৃশ্যপট।
তবে বিপরীত মতও কম নয়। কারণ জাতীয় পার্টি নিজেই যেখানে অন্যের শরিক সে দলটির ভবিষ্যত কী এবং নিজেদের মত কতটা প্রতিষ্ঠিত করতে পারবে তা নিয়ে সমালোচনা রয়েছে বিস্তর।
এমন সমালোচনা ও আশঙ্কাকে নাকচ করলেন না বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসেরই সহযোগী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ যুব মজলিসের প্রধান শাইখুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক রহ. এর তৃতীয় ছেলে মাওলানা মামুনুল হক।
এমনকি তিনি মনে করেন জাতীয় পার্টির সঙ্গে জোট গঠনে শাইখুল হাদিস রহ. প্রতিষ্ঠিত এ দলটি ইমেজ সঙ্কটে পড়তে পারে। আওয়ার ইসলামের চিফ রিপোর্টার আতাউর রহমান খসরুর সঙ্গে কথোপকথনে তিনি জানিয়েছেন আরও বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা।
আওয়ার ইসলাম : বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস ২০০৬ সালে বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট থেকে বের হয়ে আসে। এখন আবার জোটবদ্ধ হচ্ছে। কোন যুক্তিতে হচ্ছে?
মাওলানা মামুনুল হক : তখন বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট থেকে বের হয়ে এসেছিলো বিএনপি বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের দাবিগুলো মানতে রাজি হয় নি বলে। পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ দাবি মানতে রাজি হওয়ায় আবার জোটবদ্ধ হয়। ঠিক একই দাবিগুলোর ভিত্তিতে সমঝোতা চুক্তি হচ্ছে।
আওয়ার ইসলাম : বাংলাদেশের রাজনীতিতে সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদকে মনে করা হয় সবচেয়ে অস্থিতিশীল ব্যক্তি। জাতীয় পার্টিও এখন মৃতপ্রায় দল। এমন একটি দলের সঙ্গে চুক্তি করে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস আদৌ উপকৃত হবে?
মাওলানা মামুনুল হক : তখন পাঁচ দফা চুক্তির লক্ষ্য ছিলো তা বাস্তবায়ন করা। সেটা হবে এমন দলের সাথে চুক্তি করলে যাদের সরকার গঠনের সম্ভাবনা রয়েছে।
অর্থাৎ আওয়ামী লীগ বা বিএনপি। এ ধরনের চুক্তি জাতীয় পার্টির সঙ্গে করার কোনো ভবিষ্যত আছে বলে আমরা মনে করি না। এটা অর্থবহ কোনো চুক্তি মনে হয় না। এরশাদের পক্ষে এর চেয়েও কঠিন শর্ত গ্রহণ করতে কোনো সমস্যা নেই।
আমার বরং মনে হয়, তার সঙ্গে চুক্তি করার ফলে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের ইমেজ সংকট তৈরি হবে।
আওয়ার ইসলাম : কী কারণে মনে হচ্ছে, দলের ইমেজ সংকট তৈরি হবে?
মাওলানা মামুনুল হক : কয়েকটি কারণ আছে। যেমন, এরশাদের রাজনৈতিক শঠতা, জাতীয় পার্টির দেউলিয়াত্ব এবং জাতীয় পার্টির সঙ্গে আওয়ামী লীগের সখ্যতা ইত্যাদি।
আওয়ার ইসলাম : জাতীয় পার্টি যদি মহাজোটে থেকে যায়। তাহলে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস দাবি আদায় করতে পারবে? কারণ, আওয়ামী লীগের কাছে স্বয়ং জাতীয় পার্টিই অসহায়।
মাওলানা মামুনুল হক : সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসকে আওয়ামী লীগের সঙ্গে নতুন দেন-দরদারে যেতে হবে। আর জাতীয় পার্টিকে সহায়ক হিসেবে ব্যবহার করতে হবে।
জাতীয় পার্টি মজলিসের হয়ে আওয়ামী লীগের কাছ থেকে দাবি আদায় করে দেবে সে আশা করা ঠিক হবে না।
আওয়ার ইসলাম : অন্যান্য শরিক; বিশেষত বামদের প্রভাব এড়িয়ে আওয়ামী লীগ কি বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের দাবি মানবে?
মাওলানা মামুনুল হক : বামরা বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের অন্তর্ভূক্তিই পছন্দ করবে না। আর আওয়ামী লীগ যে অবস্থানে আছে তাতে মনে হয় না অর্থবহ কোনো দাবি তারা মানবে।
আওয়ার ইসলাম : এর বিপরীতে আরেকটি বিষয় রয়েছে। একদিকে বর্তমান আওয়ামী সরকারের মধ্যে অনেকেই স্বৈরাচারী ছায়া দেখছেন, অন্যদিকে দলটি ধর্ম নিরপেক্ষ মতবাদে বিশ্বাসী। এ দুটি বিষয় খেলাফত মজলিসের আদর্শের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
মাওলানা মামুনুল হক : আমিও মনে করি, একটি ধর্মনিরপেক্ষ ফ্যাসিবাদী দলের সঙ্গে আপোষ বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের জন্য ক্ষতিকরই হবে। দল আস্থার সংকটে পড়বে। সাধারণ মানুষ ও ইসলামপ্রিয় মানুষ উভয়-ই আস্থা হারাবে দলের ওপর।
আওয়ার ইসলাম : এ জোটের বিকল্প কিছু হতে পারতো? ইসলামি দলগুলো বা ইসলামি মূল্যবোধে বিশ্বাসী দলগুলোর জোট?
মাওলানা মামুনুল হক : হ্যাঁ, এমন কিছু হতে পারতো। ইসলামি দলগুলো নিয়ে জোট করা যেতো। কিন্তু আমাদের রাজনৈতিক বাস্তবতায় এ জোট কোনো আবেদন সৃষ্টি করতে পারতো বলে আমার মনে হয় না।
সবচেয়ে ভালো হতো দল যদি নিজের সাংগঠনিক কাঠামো শক্তিশালী ও দৃঢ় করার প্রতি মনোযোগী হতো। কারণ, নিজের শক্তিশালী অবস্থান ব্যতীত জোট করে ইসলামি দলগুলো অনেক বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে।
আপনার মেয়ে বা আত্মীয়কে জামিয়া ইসলামিয়া সাইয়্যিদাতুন নিসায় ভর্তি করুন
আওয়ার ইসলাম : দেশের মানুষ এখন সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিয়েই শঙ্কিত। সেখানে সরকারের অংশিদার একটি দলের সঙ্গে নির্বাচনী সমঝোতাকে আপোষ বলে মনে হয় কি না?
মাওলানা মামুনুল হক : সুষ্ঠু নির্বাচন ও তার জন্য অপরিহার্য বিষয়গুলোর নিশ্চয়তা ব্যতীত সরকারের অংশ একটি দলের সঙ্গে নির্বাচনী সমঝোতা আমার কাছে শক্তিশালী রাজনৈতিক চিন্তা বলে মনে হয় না। অন্তত একটি আদর্শিক সংগঠনের জন্য নয়।
এতে মানুষ আপোষকামিতার ছায়া দেখতে পারে। অসম্ভব কিছু না। কারণ, মানুষ জাতীয় পার্টিকে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক বাহন মনে করে।
আওয়ার ইসলাম : যদি জাতীয় পার্টি মহাজোট থেকে বের হয়ে আসে তাহলে জাতীয় নির্বাচনে এ জোট কতোটা ভালো করবে? জাতীয় পার্টি ও মজলিস কে বেশি উপকৃত হবে?
মাওলানা মামুনুল হক : বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের এখন সাংগঠনিক অবস্থা যা এবং সারা দেশে সংগঠনের যে বিস্তৃতি তাতে দলের হারানোর বা পাওয়ার খুব বেশি কিছু নেই। শায়খুল হাদিসের ব্যক্তিগত ইমেজ ছাড়া সাংগঠনিক তৎপরতা অনেকটাই নিষ্ক্রীয়।
আওয়ার ইসলাম : ইতোমধ্যেই আপনি ও আপনার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ খেলাফত যুব মজলিসের অবস্থান স্পষ্ট করেছেন। বলেছেন, এ জোটের সঙ্গে আপনি ও আপনার সংগঠন নেই। তার আগে দলীয় ফোরামে আপনি আপনার মতামত প্রকাশ করেছেন?
মাওলানা মামুনুল হক : দলীয় ফোরামের যেখানে ব্যক্তিগত মত প্রকাশের সুযোগ আছে সেখানে আমি তা প্রকাশ করেছি। দলীয় সিদ্ধান্ত ও ব্যক্তিগত মত ভিন্ন হয়। নির্বাচনী সমঝোতার সিদ্ধান্ত যথা নিয়মে হয়েছে। আমিও নিয়মতান্ত্রিকভাবে আমার মতামত প্রকাশ করেছি এবং সুযোগও পেয়েছি।
আওয়ার ইসলাম : এখন কি ভাবছেন, দলের আনুগত্য নাকি অন্যকিছু?
মাওলানা মামুনুল হক : দলীয় আনুগত্যের বাইরে যাওয়ার খুব বেশি সুযোগ নেই। সত্য বলতে, আমি বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসে সক্রীয় নই। আমি বাংলাদেশ খেলাফত যুব মজলিসের দায়িত্ব পালন করি। তার প্রতিনিধি হিসেবে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের দায়িত্ব পালন করছি।
আওয়ার ইসলাম : বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসে ও বাংলাদেশ খেলাফত যুব মজলিসের পারস্পারিক সম্পর্ক কেমন?
মাওলানা মামুনুল হক : বাংলাদেশ খেলাফত যুব মজলিস বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের সহযোগী সংগঠন। যুব মজলিস মূল দলের দেশ ও নিরেট ইসলামি আন্দোলনের কার্যক্রমে সহায়তা করে। কিন্তু চলমান জোটভূক্তির প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করবে না।
আওয়ার ইসলাম : আপনি বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের কার্যক্রমের মধ্যে একটি রেখা টেনে দিচ্ছেন। আপনার কি মনে হয় দলের কিছু কাজ জাতীয় স্বার্থ ও নিরেট ইসলামের স্বার্থে পরিচালিত নয়?
মাওলানা মামুনুল হক : এই যেমন নির্বাচন কেন্দ্রিক রাজনীতি এখানে দলীয় প্রয়োজনকেই বড় করে দেখা হয়। এখানে আগামী দিনের দেশ ও ইসলামের চিন্তাটাই একমাত্র বিবেচ্য বিষয় থাকে না।
আওয়ার ইসলাম : আপনি বলেছিলেন, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস শায়খুল হাদিস রহ. এর উত্তরাধিকার। আপনি রক্তে মাংসে এবং চিন্তা-চেতনায় তার একজন উত্তরাধিকারী। তাহলে কেনো মূল দলের কার্যক্রম থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিলেন?
মাওলানা মামুনুল হক : আমি বর্তমান দায়িত্বশীলদের সঙ্গে বিরোধের জায়গায় যেতে চাই না, দলকে সংঘাতের দিকে নিয়ে যেতে চাই না। এজন্য যেখানে সহযোগিতা করা যায় সেখানে সহযোগিতা করি আর যেখানে সহযোগিতা করা যায় না ভিন্ন প্লাটফর্ম থেকে কাজ করি।
আওয়ার ইসলাম : মতবিরোধ হতে পারে এমনটি কখন মনে হলো আপনার?
মাওলানা মামুনুল হক : শায়খুল হাদিস রহ. এর ইন্তেকালের পর আমি দল ও দলীয় কর্মীদের গুণগত মান উন্নয়নের জন্য কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করি। যেমন, লেখালেখি ও কর্মশালা করা।
দলীয় ‘পুরো কাঠামো’ বিষয়টিকে ভালোভাবে গ্রহণ করতে পারে নি। মূলত এজন্য যুব মজলিসের জন্ম।
আওয়ার ইসলাম : পিতার উত্তরাধিকার বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস যেনো সঠিক পথে পরিচালিত হয় সেজন্য আপনার পরামর্শ কী?
মাওলানা মামুনুল হক : সংগঠনকে শক্তিশালী করা, সাংগঠনিক তৎপরতা বৃদ্ধি করা, নতুন নেতৃত্ব গড়ে তোলার চেষ্টা করতে হবে। পর্যাপ্ত জনশক্তি ও নেতৃত্ব গড়ে তোলার পূর্বে রাজনীতিতে অতি মাত্রায় জড়িয়ে পড়া দলের জন্য দীর্ঘ মেয়াদি ক্ষতির কারণ হয়।
বিশেষত রাজনৈতিক জোটে যাওয়ার পর আমার পরামর্শ থাকবে রাজনৈতিক দেন-দরবারগুলো খুব ভালোভাবে করা, যারা দেন-দরবার তাদের শক্তভাবে দলীয় স্বার্থ রক্ষা করতে হবে। নতুবা অতীতের মতো দল বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়বে।
আওয়ার ইসলাম : দীর্ঘ সময় দেয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
মাওলানা মামুনুল হক : আপনাকেও ধন্যবাদ।
[ব্যবসা সংক্রান্ত হিসাব নিয়ে জটিলতায় রয়েছেন? ক্লিক করুন এখানে। ]
আরও পড়ুন
ইসলামি মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যেই মজলিসের সঙ্গে সমঝোতা করছি: এরশাদ
এরশাদ আলেমদের প্রতি আন্তরিক; সংসদেও দেখতে চান: আতাউল্লাহ আমিন
দ্বীন প্রতিষ্ঠায় আলেমদের ঐক্য ফরজ, বিভক্তি হারাম
-আরআর