সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪ ।। ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬


হজের সফর ও আখেরাতের সফর

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মূল: হুজ্জাতুল ইসলাম ইমাম আবূ হামেদ আল-গাজালী
অনুবাদ: মুফতি মুহাম্মদ আমিমুল ইহসান

হে হজযাত্রী, আল্লাহর মেহমান; কাবা শরীফ মহান আল্লাহর ঘর। এটি নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলের রাজাধিরাজের দরবার। আপনি সেই মহান সত্তার শাহি দরবারে যাচ্ছেন। আপনি মহান রবের সান্নিধ্যে ও দর্শনে যাচ্ছেন। আপনার চক্ষুদ্বয় এই ভূমণ্ডলে দিদারে ইলাহি অর্জন করতে সক্ষম নয়। তবে বায়তুল্লাহ সফরের সংকল্প করায় এবং বাইতুল্লাহ যিয়ারতে-আল্লাহর দেয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী পরকালে কাবার মালিকের দর্শন লাভে আপনি মহিমান্বিত হবেন।

হজের সফর পুরোপুরি আখেরাতের সফরের মতো, কেননা পরকালে আল্লাহর দিদার নসিব হবে। খুবই সতর্ক থাকুন! যাতে আপনার এ কষ্টসাধ্য সফরটা বিনষ্ট না হয়ে যায়, হজের সফরের মূল লক্ষ্য হচ্ছে পরকালে আল্লাহর দিদার নসিব হওয়া। হজের প্রতিটি কাজে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের যিকির এবং আখেরাতের অনন্ত সফরের কথা চিন্তা করুন। আখেরাতের প্রস্তুতি গ্রহণ করুন, তাহলেই সফরের মূল লক্ষ্য অর্জিত হবে।

স্মরণ করুন, এ সফরের মূল বাহন হচ্ছে শাওক তথা অদম্য স্পৃহা। আপনার স্পৃহা যত বেশি তেজোদ্বীপ্ত হবে, ততবেশি অভিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছা সহজ হবে। আল্লাহকে বেশি বেশি ভালবাসুন। যে অন্তরে আল্লাহর ভালবাসা জাগ্রত হবে, সেই অন্তর কাবা দর্শনের জন্য স্পৃহার আগুনে জ্বলে উঠবে।

কাবা হচ্ছে প্রিয়জনকে দেখার মাধ্যম। মাহবুব তথা প্রিয়তম এর সাথে যে বস্তুর সম্পর্ক হয়ে যায়, ভালবাসাকারীর সাথেও সে বস্তুর নিবিড় সম্পর্ক হয়ে যায়। মহান আল্লাহর ঘর, তাঁর শহর, তাঁর গলি-পথ ও তার ভিটে-মাটি মক্কা শরীফ।

কাবাকে আল্লাহ তাআলা স্বীয় ঘর আখ্যা দিয়েছেন। আর আল্লাহ যে ঘরকে নিজের ঘর আখ্য দিয়েছেন, সেই ঘর পাণে তো আল্লাহর মেহমানরা ছুটবে পাগলপারা হয়ে। আপনি যদি খানায়ে কাবার জন্য পাগল হন, এই জন্য যে এটি আল্লাহর ঘর। তাহলে আল্লাহর সন্তুষ্টির লক্ষ্যে খালেছ নিয়তে এ ঘরের উদ্দেশ্যে সফর করুন। বিশুদ্ধ নিয়ত ব্যতীত কোন আমলই কবুল হয় না। তাই বিশেষভাবে খ্যাতি অর্জনের লক্ষ্যে লোক দেখানো ও দাম্ভিকতাপূর্ণ আমল বর্জন করুন।

আপনার সফর হচ্ছে মহামান্য রাজাধিরাজ বাদশাহর দিদার লাভের জন্য, তবে এতে লক্ষ্য যদি ভিন্ন কিছু হয় তাহলে এর চেয়ে মন্দ আর কিছু হতে পারে না। হৃদয়ের গহিনে বাইতুল্লাহ ও তাঁর রবের মর্যাদাকে গেঁথে নিন। আপনার হৃদয়ে যেন দুনিয়াবী কোন ভালবাসা উত্থিত না হয়।

হজের সফরও অন্যান্য সফরের ন্যায় বিভিন্ন সম্পর্কচ্ছেদ-এর মাধ্যমে শুরু হয়। ঘর-বাড়ি, পরিবার-পরিজন, ব্যবসা-বাণিজ্য, অর্থ-সম্পদ ও মাতৃভূমি ছেড়ে যেতে হয়। এ সফরকে সফলকাম করতে সর্বপ্রথম হক্কুল এবাদ তথা মানুষের হকসমূহ পরিশোধ করুন।

সকল হকদারের পাওনা পরিশোধ করে দিন। সামান্য পরিমাণ জুলুমও যদি আপনি কারো ওপর করে থাকেন, তাহলে আপনি তার ঋণে আবদ্ধ। মজলুম ব্যক্তি আপনাকে উদ্দেশ্য করে বলছে, আপনি কোথায় যাচ্ছেন? আপনার কি লজ্জা হয় না?? আপনি রাজাধিরাজ মহান রবের সান্নিধ্যে যাচ্ছেন বৈ কি??? আপনার কি জানা নেই যে তিনি আপনাকে গুণাহসহ দেশে ফেরত পাঠাবেন না??? তিনি আপনাকে নিষ্পাপ ও নব ভূমিষ্ঠ সন্তানের ন্যায় করে পাঠাবেন।

আপনি যদি সফরের সাফল্য ও স্বার্থকতা পেতে চান তাহলে একনিষ্ঠ তওবা করে সকল গুণাহ থেকে বিদায় গ্রহণ করুন। অন্যায়ভাবে যে সব সম্পদ গ্রাস করেছেন, তা হকদারদের বুঝিয়ে দিন। আল্লাহর আনুগত্যে নিমগ্ন হয়ে যান।

আপনার হৃদয়ের সম্পর্ক গাইরুল্লাহ থেকে বিচ্ছিন্ন করুন। আপনার সফরের লক্ষ্য আল্লাহর ঘর, তাই আপনার মনকেও আল্লাহমূখী করে নিন। স্বীয় মাতৃভূমিকে এমনভাবে ত্যাগ করুন, যেন আর ফিরে আসবেন না।

সফরের ব্যয়ভার নির্বাহের জন্য এ পরিমাণ অর্থ নিয়ে যান, যাতে কোথাও অর্থের অভাব ও টানাটানি না হয়। আখেরাতের সফর হজ্জের সফরের তুলনায় অনেক কঠিন ও দুর্বোধ্য। পরকালীন সফরের রসদ হচ্ছে তাকওয়া। তাকওয়া ব্যতীত দুনিয়ার সব অর্থ-সম্পদ আপনার সাথে গাদ্দারি করবে।

মৃত্যুর সময় কিছুই আপনার সাথে যাবে না। সদা চেষ্টা করবেন যেন, হজের এই দীর্ঘ সফরে আপনার পক্ষ থেকে এমন কোনো ক্রটি প্রকাশিত না হয়, যাতে এ হজ মৃত্যুর পর আপনার কোনো কাজে না আসে। এ সফর থেকে আপনি পরকালীন অনন্ত জীবনের জন্য বেশি করে পাথেয় সংগ্রহ করুন।

পরিবার-পরিজন, সম্পদ ও অন্যান্য উপকরণ হতে বিদায় গ্রহনের পর আল্লাহর শুকরিয়া জ্ঞাপন করুন, যিনি স্থলপথ, জলপথ ও আকাশপথে সব ধরণের বাহনকে আপনার অনুগত বানিয়ে দিয়েছেন।

আপনি যখন হজের বাহন বিমান দেখবেন তখন আপনার জানাযার কথা স্মরণ করুন। যে খাটের ওপর সওয়ার হয়ে আপনি আখেরাত পাণে ছুটে চলবেন। আজ হজ্জের প্লেনে/বিমানে এমনভাবে আরোহন করুন যাতে আপনার আখেরাতের সফরটা সহজ হয়। আপনার কি জানা রয়েছে যে, মৃত্যুর সফর হজের সফরের চেয়েও অতি নিকটবর্তী!!!

আপনি যখন ইহরামের কাপড় ক্রয় করবেন, তখন ওই দিনের কথা স্মরণ করুন যে দিন আপনাকে সেলাই বিহীন কাপড় পরিধান করানো হবে। এমনও হতে পারে হজের সফর সম্পন্ন হতে না হতেই পথিমধ্যেই মৃত্যু আপনাকে আলিঙ্গন করতে পারে। কাফনের কাপড় পরিধান করে আল্লাহর সান্নিধ্যে পাড়ি জমানো সুনিশ্চিত।

আল্লাহর ঘরের যিয়ারত করতে হলে স্বাভাবিকভাবে ব্যবহৃত কাপড় পরিবর্তন করে নতুন পোশাক পরিধান করতে হয়। আখেরাতের সফরেও তিনটি সেলাইবিহীন সাদা পোশাক আবৃত করে কবরে রাখা হবে।

নিজ শহর, পরিবার পরিজন ও মাতৃভূমি ত্যাগ করে এমন সফরে রাওনা হয়েছেন, যা দুনিয়ার অন্য কোন সাধারণ সফরের মত নয়। উপলব্ধি করতে হবে যে, আপনার সফরের মাকসাদ কি? আমি কোথায় যাচ্ছি? কার সাক্ষাৎ লাভ করা আমার উদ্দেশ্য?

এ সফরে আপনার উদ্দেশ্য হচ্ছে আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি অর্জন করা। তাঁর ঘরের উদ্দ্যেশ্যে রাওনা হয়েছেন। তাঁর নির্দেশ পালন, তাঁর প্রতি হৃদয়ের স্পৃহা, তাঁর হুকুমে আপনি সব সম্পর্ক ছিন্ন করে সেই ঘর অভিমূখে রাওয়ানা হয়েছেন, যার সম্মান মর্যাদা অনেক বেশি।

যে ঘরের যিয়ারতের মাধ্যমে বাইতুল্লাহর মালিকের যিয়ারত আপনার নসিব হবে। নিজের কর্মফল দ্বারা সফলতা লাভের আশা করবেন না। বরং আল্লাহর ওপর অবিচল আস্থা ও বিশ্বাস রাখুন যে, তিনি আমার সাথে রয়েছেন। আমাকে সাহায্য করবেন। আমাকে সঠিক পথের রাহনুমায়ী করবেন। আমাকে অভিষ্ট্য লক্ষ্যে পৌঁছাবেন।

মহান আল্লাহর অনুগ্রহ এতই ব্যাপ্তিময় যে, এ সফরে আপনি যদি খানায়ে কাবা নাও পৌঁছতে পারেন, আর পথিমধ্যে মৃত্যু আপনাকে আলিঙ্গন করে, তবুও আপনার মৃত্যু এমনভাবে হবে যে, আপনি তার পাণে সফররত অবস্থায় ছিলেন। তারপর কাল কিয়ামতে তিনি তাঁর সকল প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করবেন।

কুরআনে কারীমে সূরা নিসার ১০০ নং আয়াতে ইরশাদ হয়েছে- “আর যে আল্লাহর পথে হিজরত করবে সে পৃথিবীতে পাবে বহু আশ্রয়স্থল ও প্রাচুর্য। আর যে কেউ তার বাড়িঘর থেকে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের দিকে হিজরত করে বের হয়ে আসে, অতঃপর পথিমধ্যে মৃত্যু তাকে আলিঙ্গন করে, তাহলে তার প্রতিদান আল্লাহর নিকট রয়েছে। আল্লাহ হচ্ছেন ক্ষমাকারী ও দয়ালু।”

আপনার মাদকাসক্ত সজনকে সারিয়ে তুলতে হলি কেয়ারের সেবা নিন
বাড়ী # ১, প্যারাডাইস ভবন, চামেলীবাগ, শান্তিনগর, ঢাকা (01777014346, 01916385382)

আপনি যখন নিজ দেশ ছেড়ে মীকাত (ইয়ালামলাম) পর্যন্ত পৌঁছবেন, তখন মৃত্যুর পর কিয়ামতের মীকাত পর্যন্ত সফরের পরিস্থিতি চিন্তা করুন। কবরের একাকীত্ব, কবরের আযাব, অন্ধকার কবরের দৃশ্য ও মুনকার নাকীরের সওয়াল-জওয়াবের কথা চিন্তা করুন।

মীকাতে পৌছে সূউচ্চ কণ্ঠে “লাব্বায়কা আল্লাহুম্মা লাব্বাইক-লাব্বাইকা লা শারীকা-লাকা লাব্বাইক-ইন্নাল হামদা ওয়ান নিয়মাতা-লাকা ওয়াল মূলক লা-শারীকালাক” পড়তে থাকুন।

আপনার হৃদয় যেন আল্লাহর ভয় ও আশায় প্রকম্পিত হয়। আপনি মহান রাব্বুল আলামিনের মহত্ব ও তার দরবারে উপস্থিতির ঘোষণা দিচ্ছেন এই বলে যে- “হে আল্লাহ, আমি উপস্থিত”।

আবু সুলায়মান দারানী রহ. বলেন, যে ব্যক্তি হারাম পথে উপার্জিত সম্পদ দ্বারা হজ্জ করতে যায় তাকে বলা হয়, আপনার “লাব্বাইক” গ্রহণযোগ্য নয়। যতক্ষণ না আপনি অন্য মানুষের পাওনা হকসমূহ আদায় করে দিবেন। আল্লাহর ভয় ও আশার মাঝে থাকুন। আপনার আহবান কবুল হবে। নিজের আমল দ্বারা মুক্তির আশা করবেন না, বরং আল্লাহর অনুগ্রহ ও অনুকম্পার ওপর ভরসা করুন।

যখন আপনি “লাব্বায়েক” ঘোষণা দিতে থাকবেন, তখন সে সময়ের কথা চিন্তা করুন যখন শিংগায় ফুঁ দেয়া হবে। আর মানুষ কবর থেকে উঠে হাশরের ময়দানে একত্রিত হবে। গভীরভাবে চিন্তা করুন যে, আপনার অবস্থান কোন কাতারে হবে? আমার আমলনামা কোন হাতে দেয়া হবে? আমি কি নৈকট্যশীলদের কাতারে থাকব? আমি কি “আসহাবুল ইয়ামীনদের” মাঝে শামিল হবো? নাকি আমি “আসহাবুস শিমালদের” মাঝে শামিল হবো?

যে মুসলিম হারাম শরীফের সীমানায় প্রবেশ করে সে নিরাপদ। মক্কা মুকাররামার সীমানায় প্রবেশ করার সময় আল্লাহর গজব এবং জাহান্নামের আগুনের কথা স্মরণ করুন। আর দৃঢ় প্রত্যয়ী হবেন যে, আল্লাহ তাআলা আপনাকে তার গোস্বা ও জাহান্নামের আগুন থেকে হেফাজত করবেন। আর হৃদয়ে এ চিন্তা লালন করবেন যে,আমি আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করার সৌভাগ্য অর্জন করতে পারিনি।

তবে আল্লাহর ঘরের সন্নিকটে পৌছে যাবার পর, তাঁর মেহমান হওয়ার পর এবং তাঁর ঘরের সন্নিকটে অবস্থান করার পর-সদা সর্বদা ও সর্বত্র আল্লাহর ভয়ে তটস্থ থাকবেন। আল্লাহর অনুগ্রহ সীমাহীন। আল্লাহর ঘরের মর্যাদা ও সম্মানার্থে তার ঘরের অতিথিদেরও সম্মান করা হয় এবং আল্লাহর নিকট যারা প্রার্থনা করে তাদের হক নষ্ট করা হয় না।

কাবা শরীফের দিকে সম্মান ও মর্যাদার দৃষ্টিতে অপলক নয়নে চেয়ে থাকুন। যে ব্যক্তি কালো গিলাফ আবৃত আল্লাহর ঘর দেখেছে, সে যেন স্বয়ং ঘরের মালিককেও দেখেছে। আল্লাহর নূরের তাজাল্লীতে বাইতুল্লাহর ছায়ায় যেন বান্দাহ বেহুশ হয়ে যায়।

শুকরিয়া আদায় করুন যে, তিনি আপনাকে এ মর্যাদাবান স্থান পর্যন্ত পৌছিয়েছেন। সেই আনন্দঘন মুহূর্তের কথা চিন্তা করুন, যখন আপনার চেহারা মহান রবের চেহারা দর্শনে পুলকিত হবে। আর এ আশা পোষণ করুন যে, তাঁর সম্মানিত ঘরটি যেভাবে এখন আপনার সম্মুখে রয়েছে, তেমনিভাবে হাশরের ময়দানে এবং জান্নাতেও যেন তাঁর চেহারাটি আপনার সম্মুখে থাকে।

তাওয়াফ করার সময় আপনার হৃদয় যেন মহান রবের ঘরের যিয়ারতে-প্রফুল্ল এবং পুলকিত থাকে। আল্লাহর ঘরের ভালবাসা ও সম্মানে যেন আপনার হৃদয় পরিপূর্ণ থাকে। এমন চিন্তা করবেন না যে, আপনি আল্লাহর ঘরের প্রাচীর তাওয়াফ করছেন, তাওয়াফের মূল লক্ষ্য হবে আপনার অন্তর বাইতুল্লাহর মালিকের তাওয়াফ করছে।

হৃদয়ের গহিনে যেন বাইতুল্লাহর মালিকের ভালবাসা লালিত হয়। কাবা শরীফ পৃথিবীতে “দরবারে ইলাহীর প্রতিচ্ছবি”। আল্লাহর নৈকট্যশীল ফেরেশতাদের ন্যায় তাওয়াফ করুন, যারা আরশে আযীমের চারিদিকে সদা সর্বদা অবিরাম তাওয়াফে রত রয়েছে।

হাজরে আসওয়াদে চুমু দেয়ার সময় এ প্রতিজ্ঞা করবেন আপনি যেন মহান রাব্বুল আলামিনের হাতে তার আনুগত্য ও দাসত্যের জন্য বায়আত করছেন। যে ব্যক্তি আল্লাহর হাতে বায়আত গ্রহণ থেকে বঞ্চিত হলো, সে যেন তাঁর অসন্তষ্টির পাত্র হলো।

আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা.হতে বর্ণিত- তিনি বলেন-রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন- হাজরে আসওয়াদ পৃথিবীতে আল্লাহর ডান হাত, তা দ্বারা তিনি তাঁর বান্দাদের সাথে মুসাফাহা করেন, যেমনিভাবে একজন মানুষ তার অপর মুসলিম ভাইয়ের সাথে মুসাফাহা করে। (সহিহ মুসলিম) আপনি বড়ই সৌভাগ্যবান যে, এমন মুবারক স্থানে উপস্থিত হয়েছেন। তাই আল্লাহ তায়ালার আনুগত্যের শপথ গ্রহন করুন।

এবার খানায়ে কাবার গিলাফ আকড়ে ধরুন। আপনি যেন স্বয়ং রাব্বুল আলামিনের হাত আকড়ে ধরছেন। মুলতাজিমের সাথে নিজের শরীরকে মিশিয়ে নিন। বাইতুল্লাহর পবিত্র দেয়ালের সাথে নিজের মস্তককে লাগিয়ে নিন, যেমনিভাবে কোন অপরাধী অন্যের হাত আকড়ে ধরে ক্ষমা প্রার্থনা করে। নিজেকে মহান রবের দরবারে সমর্পণ করুন।

তাওবা, ইস্তেগফার ও কান্নাকাটি করে আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করুন। হৃদয়ের সকল আকুতি পেশ করে আরয করুন, হে আল্লাহ আমি আপনার সান্নিধ্য ছেড়ে কোথায় যাব? কার নিকট প্রার্থনা করে হাত প্রলম্বিত করবো? কার পদদ্বয় আকড়ে ধরবো? আমার শেষ ঠিকানা ও আশ্রয়স্থল হচ্ছেন আপনি।

আপনার অনুগ্রহ ও অনুকম্পা ব্যতীত আমার আর কোন ঠিকানা নেই। আমি আপনার আশ্রয় ছেড়ে যাবো না। আপনার দরবার হতে সরে যাবো না, যতক্ষণ না অমার গুণাহসমূহ মার্জনা করবেন এবং ভবিষ্যতে আমাকে নিরাপদ রাখবেন। আপনি সম্মানিত, দানশীল ও মহানুভব।

আমি মহানুভবের দরবারে এসেছি। আমার অক্ষমতা পেশ করতে এসেছি। আপনার রহমতের আশায় এসেছি। আপনি যদি আমাকে আপনার ক্ষমা ও রহমতের সামিয়ানায় স্থান না দেন, তাহলে আমি কোথায় যাবো!! কি করবো!!

সাফা ও মারওয়া পাহাড়দ্বয়ে সায়ী করার সময় ইবরাহীম আ., ইসমাঈল আ. ও মা হাজেরা আ. এর স্মৃতিচারণ করুন। আপনি একজন গুণাহগার, অক্ষম, দুর্বল, মিসকিন ও গোলামের ন্যায় যেন বাদশাহী মহলের আঙ্গিনায় চক্কর দিয়ে চলছেন। সদা একনিষ্ঠতার সাথে আল্লাহকে রাজি খুশি করার চিন্তা করুন, যাতে তিনি আপনার প্রতি রহমতের দৃষ্টিতে তাকান।

আবার মাঝে মাঝে হতাশ হবেন এই বলে যে, জানিনা আমার আশ্রয় কি রহমতের সামিয়ানায় হয়েছে কিনা? আমার ব্যাপারে মহান আল্লাহর সিদ্ধান্ত কি হয়েছে? সায়ী করতে করতে ভাবতে থাকুন যে, প্রথম সায়ী/রাউন্ডে ক্ষমা না করলেও পরবর্তী রাউন্ড-এ তো অবশ্যই তিনি আমাকে ক্ষমা করবেন। সাফা-মারওয়া সায়ীর সময় হাশরের ময়দানে দাড়িপাল্লায় উভয় দিকের অবস্থা নিয়ে আপনি পেরেশান থাকবেন।

এক পাল্লায় নেকিসমূহ থাকবে, অন্য পাল্লায় গুণাহসমূহ থাকবে, এমন জানা নেই যে, কোনটির পাল্লা ভারি হবে। বুক ভরা আশা ও ভীতি নিয়ে সাফা ও মারওয়া পাহাড়দ্বয়ের মাঝে প্রদক্ষিণ করতে থাকুন।

আরাফাত ময়দানে পা রাখার সাথে সাথে হাশরের ময়দানের দৃশ্য স্মরণ করুন। আরাফাত ময়দানে মানুষের প্রচণ্ড ভিড়,উচ্চ আওয়াজ এবং ভাষা-বর্ণের ভিন্নতা সত্ত্বেও সকলের মুখে একই শ্লোগান। এ ময়দানে পৃথিবীর আদি-অন্ত সব মানুষ একত্রিত হবে।

সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। বিভিন্ন বর্ণ ও গোত্রের লোক এ ময়দানে একত্রিত হবে। সব মানুষই নিজ নিজ আমল অনুযায়ী বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত হয়ে যাবে। এই ময়দানে আল্লাহর রহমত নাযিল হয়। আল্লাহর সেই রহমতকে পূণ্যবানদের আত্মা লুফে নেয়, যে আত্মাগুলো একই সময়ে একই ময়দানে একত্রিত হয়ে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির লক্ষ্যে সিজদায় মস্তক অবনত করে। হেয় ও তুচ্ছ মনে করে স্বীয় রবের সমীপে নিজেকে উৎসর্গ করে দিন।

আল্লাহর দরবারে হাত তুলে ফরিয়াদ করুন। রহমতের বারিধারা বর্ষিত হওয়ার জন্য পৃথিবীতে উত্তম আর কোন কোন স্থান নেই। এখানে পূণ্যবানদের হিম্মত ও উচ্চাকাংখাগুলো একত্রিত হয় এবং পূণ্যবানদের আত্মাগুলো একটি অপরটিকে সাহায্য করতে থাকে। আপনি এমন ধারণা করবেন না যে, অমুকের দুআ কবুল হবে না, অমুকের ওপর আল্লাহর রহমত নাযিল হবে না,অমুকের আশা ব্যর্থ হবে এবং অমুকের প্রচেষ্টা বিফল হবে।

বরং আপনি দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হোন যে, সব হাজ্বীদের ওপর আল্লাহর রহমত নাযিল হবে এবং আরাফাতের সব উপস্থিতি ক্ষমা প্রাপ্ত হয়ে এখান থেকে ফিরে যাবে। এজন্য বলা হয় যে, সবচেয়ে বড় গুণাহ হচ্ছে-আরাফাতে উপস্থিত হয়ে এমণ ধারণা পোষণ করা যে-আল্লাহ আমাকে ক্ষমা করেন নি।

এ ময়দান হচ্ছে দুআ কবুলের। এতে দুআ কবুল হওয়ার শতভাগ গ্যারান্টি রয়েছে। তাই একাগ্রচিত্তে আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করে দুআ করতে থাকুন।

হে আল্লাহ আপনি আমার কথা শুনেন, আমার অবস্থান দেখছেন, আমার প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য সব বিষয় আপনি জানেন। আমার কোন বিষয় আপনার নিকট গোপনীয় নয়। আমি হতদরিদ্র, ফকির, মিসকিন, সাহায্যপ্রার্থী , আশ্রয়প্রার্থী ও ভীতু। আপনার নিকট আমার গুণাহের স্বীকৃতি দিচ্ছি।

মিসকিনের ন্যায় প্রার্থনা করছি এবং অপদস্থ অপরাধীর ন্যায় প্রত্যাবর্তন করছি আপনার পাণে। আমার মস্তক সমর্পণ করছি আপনার তরে। আমার চক্ষুদ্বয় বেয়ে পানি ঝরছে। আপনার রহমত ও করুণা দ্বারা আমাকে আচ্ছাদন করে নিন। হে সর্বোত্তম দাতা ও আশ্রয়দানকারী আমাকে নিরাশ করবেন না।

১০,১১,১২ জিলহজ জামরাতসমূহে কংকর নিক্ষেপে আত্মা ও বিবেকের কোন স্বাদ অনূভুত না হলেও আল্লাহর যিকির ও তার নির্দেশ পালনার্থে নিজেকে সোপর্দ করে দিন। আপনার এ পাথর নিক্ষেপ জাতির পিতা ইবরাহীম আ.-এর পাথর নিক্ষেপের সাদৃশ। কেননা তিনি ইবলীসের প্রবঞ্চণা থেকে বাচার জন্য আল্লাহর নির্দেশে শয়তানকে পাথর নিক্ষেপ করে ছিলেন।

আপনার হৃদয়ে যদি এ প্রশ্ন উত্থিত হয় যে,ইবরাহীম আ.শয়তানের মুখোমুখি হয়ে পাথর নিক্ষেপ করেছেন, অথচ আমি তো শয়তানের মুখোমুখি হইনি,তাহলে আমি কেন কংকর নিক্ষেপ করবো?

শয়তান আপনার হৃদয়ে এমন উদ্ভট প্রশ্ন উত্থাপন করে মূলতঃ কংকর নিক্ষেপ করার দৃঢ় সংকল্প থেকে আপনাকে সরিয়ে দিয়েছে। সুতরাং আপনি এ প্রবঞ্চণা থেকে মুক্ত হয়ে দৃঢ় প্রত্যয়ে কংকর নিক্ষেপ করুণ। বাহ্যিকভাবে আপনি নির্ধারিত পিলারে পাথর নিক্ষেপ করলেও মূলতঃ আপনি শয়তানের চেহারায় পাথর নিক্ষেপ করছেন।

১০ জিলহজ পাথর নিক্ষেপের পর আল্লাহর রাস্তায় দমে শুকর তথা হাদী যবেহ করা তাঁর নৈকট্য লাভের অন্যতম মাধ্যম। আল্লাহ তাআলা কুরবানীর পশুর প্রতিটি পশমের বিনিময়ে আপনার শরীরের প্রতিটি অংগকে জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্তি দান করবেন।

হজ্বের শুরু থেকে শেষ প্রতিটি কাজে আখেরাতের সফরের কথা স্মরণ করুন। এ সফরের সফলতা ও কামিয়াবির জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করুন। এ সফর সফল ও স্বার্থক হলে আপনি পরকালে কাবার রবের পুরস্কার লাভে ধন্য হবেন।

*তথ্যসূত্র: ০১. এহইয়ায়ে উলূমিদ্দিন, কিতাবু আসরারিল হজ্জ ,হুজ্জাতুল ইসলাম আল্লামা আবূ হামেদ মুহাম্মদ ইবন মুহাম্মদ আল-গাজালী, পৃষ্টা নং-২৬৫-২৭২,খন্ড: ১ম, দারু এহইয়াইত তুরাস আল আরাবী, বৈরুত। (সংক্ষেপিত)

০২. কিতাবুল ইযাহ ফি মানাসিকিল হাজ্জ ওয়াল ওমরা, আসরারুল হাজ্জ ওয়া যিকরিয়াতুহু, আল্লামা ইয়াহইয়া ইবনে শরফ আন নববী, পৃষ্টা নং-৩০-৪৩,আল মাকতাবাতুল ইমদাদিয়া, মক্কা মুকাররামা,৬ষ্ঠ সংস্করণ-২০০৬

প্রসঙ্গ : হজ্জ ও উমরাহ কিছু গুরুত্বপূর্ণ অভিজ্ঞতা

-আরআর


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ