মেহেদী হাসান
এক ছোট ভাইয়ের সাথে মাঝে মাঝেই ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন নিয়ে টুকটাক কথা হয়। ভাই আমার সূর্যসেন, মহাত্মাগান্ধীর অবদানে মুগ্ধ হলেও জানে না ফরায়েজী আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা হাজী শরিয়উল্লাহ সম্পর্কে।
তার ছেলে দুদু মিয়া, ওহাবি আন্দোলন, খেলাফত আন্দোলন, মুসলিম মাওলানাদের কোন ভূমিকা ইত্যাদি সম্পর্কেও সে অজ্ঞ। তিতুমীরের বাঁশেরকেল্লা সম্পর্কে সে সামান্য জানে কিন্তু তা তার কাছে কোনো গুরুত্ব পায় না। কেননা সে তার পাঠ্য বইয়ের চেপে রাখা ইতিহাস সম্পর্কে কিছুই জানে না।
ফলে পাঠ্যবইয়ের ইতিহাসকে ধ্রুব সত্য বলে ধরে নেওয়াটা তার জন্য সহজ হয়। স্বার্থান্বেষী কিছু মানুষযে নিজেদের স্বার্থে ইতিহাস পরিবর্তন করে ফেলে সেই ব্যাপারে তাকে বুঝানোর চেষ্টা করি।
প্রসঙ্গ সহজ করার জন্য একদিন সবচেয়ে সহজ উদাহরণটাই টেনে আনলাম। জিজ্ঞেস করলাম, ‘আচ্ছা বলতো আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের ঘোষক কে?’
সে এই প্রশ্নের উত্তর দিয়েছিল। তবে আমরা অনেকেই জানি আমাদের ইতিহাসে এই প্রশ্নের উত্তরটি বারবার পরিবর্তন হয়। উত্তরটি পাক খায় দুইটি নামের মাঝে। যার যেই নামটি প্রতিষ্ঠিত করলে ফায়দা হবে সে সেই নামটিই প্রচার করে বেড়ায়। আর পাঠ্যপুস্তক হয়ে উঠে তা প্রচারের প্রধান হাতিয়ার।
এটা জাস্ট ইতিহাস বিকৃতির একটি উদাহরণ মাত্র। যুগে যুগে দেশ-বিদেশের ইতিহাসে এই বিকৃতির চর্চা অনেক হয়েছে এবং হচ্ছে। কিন্তু এর পরিণাম মোটেও ভালো নয়।
একটা ছোট্ট উদাহরণ দিয়ে বুঝানো যাক, ধরুন ভারত আর নেপাল মিলে একটি চুক্তি করলো, তারা আপোষে নিজেদের ইতিহাস সংশোধন, পরিবর্ধন অথবা পরিমার্জন করবে। এতে ভারত নিজেদের ইতিহাস যে রকম রচনা করবে নেপাল ঠিক তাতেই সায় দিবে আবার নেপাল তাদের যে রকম ইতিহাস দেখতে চায় ভারত ঠিক তাতেই সায় দিবে।
চুক্তির পর ভারত তাদের ইতিহাসের বেশ কিছু জিনিস সংশোধন করলো। তারা ইতিহাসে লিখতে শুরু করলো, সিকিম নামক তাদের একটি রাজ্য আছে যা কখনোই স্বাধীন কোন দেশ ছিল না বরং তা সবসময়ই ভারতের অঙ্গরাজ্য ছিল।
তারা এও রচনা করলো, দুই বাংলা আগে যেমন পৃথক ছিল না এখনো তেমনি নেই, জাস্ট একটা কাঁটাতারের বেড়া দেওয়া হয়েছে। তবে যেকোন মুহূর্তে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার চাইলেই তাদের অঙ্গরাজ্য বাংলাদেশকে আবার পশ্চিমবাংলার অন্তর্ভুক্ত করে ফেলতে পারবে।
তারা তাদের পাঠ্য বইয়েও এই ইতিহাস ছাপাতে শুরু করলো। চুক্তির শর্তানুযায়ী অনুযায়ী নেপালও এই ইতিহাস বিকৃতিকে তাদের পাঠ্যবইগুলতে স্বীকৃতি দিল। ফলে আলটিমেটলি কী হলো?
ভারত এবং নেপাল এই দুইটা দেশেরই কয়েক প্রজন্ম সিকিম এবং বাংলাদেশ সম্পর্কে মারাত্মক ভুল ধারণা পোষণ করতে শুরু করলো। এমতাবস্থায় যদি বাংলাদেশ, সিকিমসহ অন্যান্য দেশ এই মারাত্মক বিকৃতির বিরুদ্ধে সোচ্চার না হয় তাহলে অদূর ভবিষ্যতে ভারত ও নেপালের যতটা না ক্ষতি হবে সিকিম ও বাংলাদেশের তার চেয়ে অনেক বেশি ক্ষতি হবে।
ভারত ও নেপালেরও সামান্য ক্ষতি হবে এজন্য বলছি তাদের প্রজন্ম নিজেদের প্রতি অন্ধ বিশ্বাস নিয়ে বড় হবে। ফলে গায়ে ছাল না থাকলেও নিজেদের কুকুরগুলোকে তার বাঘা নাম দিতে শুরু করবে। হয়তো যারা বিড়ালের সাথেও লড়াইয়ে টিকতে পারবেনা।
যেই উদাহরণটি দিলাম সেটি অবশ্যই একটি অবাস্তব উদাহরণ। কিন্তু দুঃখের বিষয়, এই অবাস্তব উদাহরণের ভিকটিম সিকিম ও বাংলাদেশের মতই হয়তো রোহিঙ্গা আর ফিলিস্তিনিদের অবস্থা হতে যাচ্ছে।
একটি সংবাদ হয়তো অনেকেরই চোখ এড়িয়ে গেছে। আর অনেকে হয়তো এমন চুক্তি আরও অনেকেবার দেখেছে তাই তাদের তেমন কোনো রিয়েকশন ছিল না।
ঘটনাটি ছিল ২৮-০৫-১৮ তারিখের। সেই মাসেরই ১৪ তারিখে ফিলিস্তিনি ভাইবোনদের রক্ত মাড়িয়ে যারা যুক্তরাষ্ট্রের ইসরাইলি দূতাবাস জেরুজালেমে সরানোর অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছিল সেখানে আমাদের প্রতিবেশী, মুসলিম রোহিঙ্গা ভাইবোনদের রক্তখেকো যালিম মায়ানমারের প্রতিনিধিও ছিল।
ইসরাইলের সাথে তাদের সখ্যতা অনেক আগে থেকেই। এই তথ্যটা অনেকে জানলেও হয়তো অনেকে এটা জানে না যে তাদের এই সখ্যতা এখন কোন মাত্রায় পৌঁছে গেছে।
২৮-০৫-১৮ তারিখে তারা ইতিহাসের পাঠ্য বদলে দিতে মিয়ানমার-ইসরাইল শিক্ষা চুক্তি করেছে। চুক্তি অনুযায়ী মিয়ানমার ইসরাইলের পাঠ্যসূচিতে বর্ণিত মিয়ানমারের ইতিহাস ইচ্ছেমত বদলে দিতে পারবে।
একইভাবে মিয়ানমারের পাঠ্যসূচিতে থাকা নিজেদের ইতিহাস বদলে দিতে পারবে ইসরাইল। তাদের রচিত ইতিহাসে রোহিঙ্গা ভাইয়েরা হবে সন্ত্রাসী, বাঙালি ভূমি দখলদার আর মায়ানমারের জনগণের জন্য হুমকিস্বরূপ।
ফিলিস্তিনি ভাইয়েরা হবে ইসরাইল নামক স্বাধীন দেশের উপর আগ্রাসী, দখলদার হানাদার বাহিনী। যাদের হত্যা করা তাদের জন্য বৈধ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে তাদের রচিত ইতিহাসে।
তবে, তাদের নিজেদের মধ্যকার এই আপোষ দেখে হতাশ হইনি। কেননা এটাই হওয়ার কথা ছিল। মনে পরে গিয়েছিল, সর্বশক্তিমান মহান রবের কথা।
সূরা আনফালের ৭৩ নাম্বার আয়াতে আল্লাহ বলেছেন, وَالَّذِينَ كَفَرُوا بَعْضُهُمْ أَوْلِيَاءُ بَعْضٍ ۚ إِلَّا تَفْعَلُوهُ تَكُنْ فِتْنَةٌ فِي الْأَرْضِ وَفَسَادٌ كَبِيرٌ
অর্থঃ ...যারা কুফুরি করেছে তারা একে অপরের বন্ধু, যদি তোমরা তা না কর অর্থাত কাফেরদের সাথে সম্পর্কের বিষয়ে আল্লাহর আদেশ মেনে না চল তাহলে দেশে অধর্ম ও মহাবিপর্যয় দেখা দেবে।
জানি না কবি ফররুখ আহমদের মন এমন কিছু দেখেই বলেছিল কিনা, রাত পোহাবার কত দেরী পাঞ্জেরী?
লেখক: শিক্ষার্থী (চতুর্থ বর্ষ), পুরকৌশল বিভাগ, বুয়েট
-আরআর