হুমায়ুন আইয়ুব
সম্পাদক
ঈমানি চেতনার দাওয়াতি মেহনতের নাম তাবলিগ। আল্লাহর দেওয়া জান, আল্লাহর দেওয়া সম্পদ ও সময় আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করার নাম তাবলিগ।
হাজারো আলেমের চোখের জল, লাখো বজুর্গানে দীনের রুনাজারি আর ইখলাসের ফসল শতবর্ষী এ দাওয়াতি মেহনত ।
সাম্প্রতিক তাবলিগ জামাতে কিছুটা সঙ্কট দেখা দিয়েছে। যদিও মুরব্বিরা বলছেন এ সঙ্কট থাকবে না, এ ঝড় থেমে যাবে। হজরতজি মাওলানা ইলিয়াস রহ. এর অন্তরআত্মার এখলাসের ফলে এই ঘনকোয়াশা কেটে যাবে। আবারও তাবলিগি সামিয়ানা আলোকিত করবে ভোরের নতুন সূর্য।
আমার দেখা তাবলিগের সাথীদের মেলবন্ধন ও আন্তরিকতা সবার জন্য উদাহরণ। নতুন সাথীকে আল্লাহর রাস্তায় বের করার জন্য- দিনের পর দিন ওই সাথীর জন্য সালাতুল হাজত আদায়, উঁচু-নীচু মানসিকতা দূর করতে এক দসতরখানে বসা, ঘৃণা বিদ্বেষ ও মনের ময়লা সরাতে এক প্লেটে খাওয়া, পরস্পর একরাম, সম্মান, সহযোগিতা এ কাজের মূলমন্ত্র।
শুধু নসিহত, দাওয়াতি অভিযান আর বয়ানের নাম কিন্তু তাবলিগ নয়। বরং জোড় মিল মহব্বত আর ইকরামের সাথে আমলি-আখলাকি হাজারো কাজের সম্মিলন এ তাবলিগি মেহনত।
এতো নরম আখলাক, এতো মায়াবি আওয়াজ, আর এতো দরদি দিল সাথীদের ছিলো বলে এ মেহনত দিনদিন আগে বেড়েছে। তাবলিগি সাথীদের কথায় কথায় আল্লাহ খাওয়ান, আল্লাহ পালেন, আল্লাহ হায়াত ও মওতের মালিক-বলার উদ্দেশ্য ছিল, মন থেকে আমিত্ব-অহঙ্কার দূর করে মহান আল্লাহর দৃঢ় বিশ্বাস অন্তরে জায়গা দেয়া।
বলতে বাধা নেই- আজ আমিত্ব-অহঙ্কার আর ক্ষমতা ও সম্পদের মোহে আক্রান্ত এ নুরানি কাফেলা।
তাবলিগের সাথীরা আজ ছয় উসুল প্রায় ভুলতে বসেছেন। মসজিদে পাঁচ কাজের আমল অনেকাংশে কমে গেছে। উভয় পক্ষ বাড়াবাড়ি করছে বলেই মনে হচ্ছে। তাবলিগের মুরব্বিগণ এখন আগের মতো ঈমান একিনের বয়ান করছেন না! সাথীরাও আগের মতো সাদামাটা বয়ান পছন্দ করছেন না। দলভাড়ি করা কিংবা নিজের আনুগত্য স্বীকার করানো এখন বড় মেহনত।
মনে রাখার মতো বিষয় হলো, আমাদের কেউ যদি প্রচলিত তাবলিগ না করি তবুও আল্লাহর দীন আল্লাহর জমিনে টিকে থাকবে যে কোনো পদ্ধতিতেই। আমাদের মেহনত, আমাদের তাবলিগ, দীনের নামের আমাদের কোনো কাজ বা পন্থার জন্য আল্লাহ মুহতাজ নন। তবে দীনের যে কোনো শাখায় কাজ করার নামে যদি বদনাম হয় তাহলে তার দায়ভার আমাকে আপনাকে বহন করতে হবে। আমার আপনার কারণে যেন মসজিদ গোনাহর মারকাজে পরিণত না হয়।
তাবলিগিরা আজ দুভাগ
একদল এতায়াতের নামে সাথীদের দলে ভেড়াচ্ছেন। তারা লিখিত অলিখিতভাবে দিল্লির নিজামুদ্দীন মারকাজের মুরব্বি মাওলানা সাদ কান্ধলভির আনুগত্যের স্বীকারোক্তি নিচ্ছেন।
দুই. মাওলানা সাদ কান্ধলভির ভুল মতাদর্শের বিরুদ্ধে জনগণকে সচেতন করছেন, শুরার পক্ষে জনমত তৈরি করছেন।
চলমান এই গ্রুপিং বা দলাদলিতে-হক বাতিল কিংবা শরিয়ত বা গাইরে শরিয়তের বিষয়টা কী পরিমাণ আছে তা সমকালীন আলেমগণ সিদ্ধান্ত দেবেন। হক বাতিল বিষয়ে প্রতিনিধিত্বশীল ও মধ্যমপন্থী আলেমদের মতামতই চূড়ান্ত বলে বিবেচিত হবে।
তবে তাবলিগে ২টি সঙ্কট বিরাজ করছে। এক. ইলমি বা আদর্শিক সঙ্কট। দুই. ব্যবস্থাপনাগত বা পরিচালনাগত সঙ্কট।
ইলমি বা আদর্শিক সঙ্কট
যেসব ভুল কথা, ভ্রান্ত আকিদা-বিশ্বাস বয়ান বা তাবলিগি নেসাবের কিতাবপত্রের মাধ্যমে অনুপ্রবেশ করেছে সে বিষয়ে নিয়মতান্ত্রিকভাবে সচেতন করা। হজরতজি মাওলানা ইলিয়াস রহ. এর যুগ থেকে আজ পর্যন্ত বয়ান ও কিতাবপত্র ঘেটে হজরত উলামোয়ে কেরাম সতর্ক করবেন, তাবলীগের শুরুর যুগ থেকে আজ পর্যন্ত নানা কথা ও চিন্তার ভ্রান্তি চলে আসতে পারে।
উম্মতের আত্মশুদ্ধি হয় ফায়দা হয়, এমন কথা ও কাজের ব্যাপারে সতর্ক করা উচিত। দরদ নিয়ে উলামায়ে কেরাম কাজগুলো করেন ও করছেন। দারুল উলুম দেওবন্দসহ হজরত উলামায়ে কেরাম দায়ত্বিটি পালন করছেন। কেয়ামত পর্যন্ত আলেমরা উম্মতের মুহসিন অভিভাবক হিসাবে সেই দায়িত্ব পালন করবেন।
এই দায়িত্বপালনরত আলেমগণ অবশ্যই দেওবন্দের চিন্তা চেতনা ও মনোভাব বুঝে কাজ করছেন ও করবেন।
উলামায়ে দেওবন্দ এ উম্মতের রক্ষাকবজ। তাদের ইশারা চূড়ান্ত নির্দেশতুল্য। তাদের হুকুম শীরধার্য। উলামায়ে যে পথে হাঁটেন অপথও পথ হয়ে ওঠে। উলামায়ে দেওবন্দ তর্জনী তুললে গুরস্থানও জিন্দা হয়ে ওঠে। সুতরাং তাদের মর্যদা যতো বেশি দায়িত্বও স্পর্শকাতর।
ব্যবস্থাপনাগত বা পরিচালনাগত সঙ্কট
তাবলিগের পরিচালনা পদ্ধতি কী হবে? তাবলিগ কি একক কারো নেতৃত্বে (আমির) চলবে নাকি পরামর্শভিত্তিক (শুরা) নিয়মে চলবে? বিষয়টি একান্তই তাবলিগের আভ্যন্তরিণ সমস্যা। একক নেতৃত্ব বা পরামর্শভিত্তিক উভয়টি প্রচলন ইসলামে আছে!
সুতরাং উভয় পদ্ধতির সঠিক ব্যবহার না হলে সঙ্কট চিরকাল লেগে থাকবে। তবে তাবলিগের সংশ্লিষ্টরা বিষয়টির চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেবেন। আলেমগণ তাবলিগের মা বাবার ভূমিকায়। সাধারণ সাথীরা সন্তানতূল্য। মা বাবা ও সন্তানের বৈরী সম্পর্কে তৃতীয় কেউ যেন ফায়দা লুটতে না পারে সেদিকেও সজাগ থাকতে হবে।
আকাবির আসলাফের রেখে যাওয়া এ আমানত –দাওয়াতের এ মেহনত আমার-আপনার কোনো আত্মঅহমিকা বা ব্যক্তি আক্রোশের শিকার হলে কেয়ামতের মাঠে কী জবাব দেবো? নবীজি সা. এর সামনে দাঁড়াবো কী করে?
আরও পড়ুন: প্রিয় তাবলিগি ভাইয়েরা এবার একটু ক্ষান্ত দিন!
-আরআর