মুহাম্মদ নোমান
আলেম ও কলামিস্ট
চলে গেলেন তুরস্কের বিখ্যাত মুসলিম ইতিহাসবিদ ফুয়াত/ফুয়াদ সেজগিন। গতকাল ৩০ জুন, ২০১৮ ইং তুরস্কের একটি হাসপাতালে তিনি মৃত্যু বরণ করেন। প্রেসিডেন্ট এরদোগানসহ অন্যান্য তুর্কি নেতৃবৃন্দ এবং মুসলিম বিশ্বের স্কলাররা তার মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন।
মুসলিম গবেষক স্কলারদের কাছে সেজগিন একটি অতি আপন, অতি পরিচিত নাম। ১৮ শতক থেকে প্রাচ্যবিদরা বলতে গেলে এককভাবে মৌলিক ইসলামি গবেষণা এবং তাহকিকুত তুরাসের ময়দানে ছড়ি ঘুরিয়েছিল। এটা সালেহ মুনাজ্জিদসহ অনেকেই স্বীকার করেছেন।
যদিও উস্তাদ আবদুস সালাম হারুন এবং আল্লামা আহমাদ শাকের সেটা মানতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। তবে, তুরাসে ইসলামিকে ইতিহাসের হারানো গলিগুলো থেকে তুলে এনে পূনর্জীবন দান করার ক্ষেত্রে প্রাচ্যবিদদের অবদানকে স্বীকার করতে হবে।
তুরাস গবেষণার যে সর্বোৎকৃষ্ট পদ্ধতি তারা প্রয়োগ করেছিলেন তার সাথে তৎকালীন বা তার আগের মুসলিম গবেষকরা পরিচিত ছিল না। আল আগানি, সুবহুল আশার মতো বহু মূল্যবান ইসলামি তুরাস তাদের হাত ধরেই আলোর মুখ দেখেছে।
গুটিকয়েক যে মুসলিম এবং আরব গবেষক প্রাচ্যবিদদের সে গৌরবে ভাগ বসানোর হিম্মৎ করেছিলেন, তাদের মধ্যে আরবে ফুয়াদ আবদুল বাকি, লন্ডনে আলবার্ট হোরানি, আমেরিকায় ফিলিফ হিট্টি, ফ্রান্সে মুহাম্মাদ আরাকুন এবং আলী মুরাদ, জার্মানীতে ফুয়াদ সেজগিনের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
মুসলমানদের পতন বা পিছিয়ে পড়ার মূল কারণগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে আমরা সভ্যতার দৌড়ে পিছিয়ে পড়েছি। অথচ আমাদের পূর্বসূরিরা এক সময় তাদের সভ্যতার চালকের আসনে বসাতে সক্ষম হয়েছিল। ৮ম শতক থেকে নিয়ে ১৫শ শতক পর্যন্ত সময়ের জ্ঞান বিজ্ঞান এবং সভ্যতার ইতিহাস মুসলমানদের হাত ধরেই রচিত হয়েছিল। কিন্তু তার পরে সেই ধারা ধরে রাখা সম্ভব হয়নি।
পাশ্চাত্যের অতি দ্রুত গতিতে উন্নতি লাভ করা বিজ্ঞান, শিল্প, সাহিত্যের সাথে পাল্লা দিতে পারেনি। ফলে গোটা মুসলিম বিশ্বের উপর নেমে আসে কলোনিয়াল শাসনের মতো বিভিষিকাময় এক অধ্যায়। উসমানি সালতানাতের পতনেরও এটাই বড় কারণ।
তারচেয়েও বড় সমস্যা হয়েছে, পরবর্তি মুসলিম প্রজম্ম তাদের পূর্বসূরিদের রেখে যাওয়া জ্ঞান ভান্ডারের ব্যাপারে একেবারেই বেখবর হয়ে গেল। ফলে পাশ্চাত্যের চোখ ধাঁধানো সভ্যতার সামনে নিজেদের অসহায় মনে করা শুরু করলো। এর দ্বারা সাংস্কৃতিক গোলামির দরজা খুলে গেল।
এই আত্মঘাতী মানসিক দৈন্যতাকে রোধ করার প্রথম পদক্ষেপ হচ্ছে উত্তরাধুনিক মুসলিম প্রজন্মের সামনে বিশ্বসভ্যতা গঠনের পেছনে মুসলিম জাতির অসামান্য অবদানগুলোকে তুলে ধরা। এই কাজটিই করতে চেয়েছিলেন ফুয়াদ সেজগিন।
ইসলামি তুরাসের বিব্লিউগ্র্যাফি অনেক মুসলিম লেখকই লিখেছেন। ইবনুন নাদিমের 'ফিহরিস্ত', হাজি খলিফার 'কাশফুজ জুনুন', বাগদাদির 'মু'জামুল মুয়াল্লিফিন' ইত্যাদি খুব প্রসিদ্ধ।
আল্লামা যিরাকলিও 'আল আ'লাম'-এ এ বিষয়ের উপর জোর দিয়েছেন। কিন্তু তাদের মূল জোরটা ছিল ইসলামি উলুমের শাখাগুলোর ওপর। ফলে আরও বড় একটি জগৎ আড়ালে থেকে যায়। সে হিসেবে ইসলামি তুরাসের আধুনিক বিব্লিউগ্র্যাফি বলতে তখন একটাই ছিল।
জার্মান প্রাচ্যবিদ কার্ল ব্রুক্যালমেনের ‘তারিখুল আদবিল আরবি’। কিন্তু ব্রুক্যালমেন তাঁর অনবদ্য এই গ্রন্থে তুরাসে আরবির খুব কিয়দাংশই তুলে ধরতে পেরেছিলেন। তার ইসতিদরাক আসা খুব দরকার ছিল।
সেজগিন ১২ খন্ডে ‘তারিখুত তুরাছিল আরবি’ রচনা করে সেই মহান কাজটি সম্পাদন করেছিলেন। ১৯৪৭ সাল থেকে তিনি কাজটি শুরু করেছিলেন। দৈনিক ১৭ ঘন্টাও কাজ করেছিলেন বলে শ্রুতি আছে।
আরব এং পাশ্চাত্যের হাজার হাজার লাইব্রেরিতে ঘুরে ঘুরে তিনি মুসলিম লেখকদের হাজারো মূলব্যান পান্ডুলিপি সংগ্রহ করেছিলেন। এটি এমন এক মূল্যবান গ্রন্থ, দুনিয়ার কোন মুসলিম গবেষক এর সহযোগিতা না নিয়ে সামনে চলতে পারবে না। এই অসামান্য অবদানের জন্য ১৯৭৯ সালে সৌদি সরকার তাঁকে ফয়সাল পুরস্কারে ভূষিত করে।
রহিমাহুল্লাহু রাহমাতান ওয়াসিয়াহ্!
-আরআর