ত্বরিকুল ইসলাম
রাজনৈতিক বিশ্লেষক
সময় টিভির একটি লাইভ রিপোর্ট নিয়ে খুব আলোচনা সমালোচনা চলছে। ইয়াবা চালানের সময় একজন জোব্বা পরিহিত দাড়ি-টুপিওয়ালাকে মসজিদ থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। লাইভে মিথ্যাচার করে বলা হচ্ছে, সে নাকি চট্টগ্রামের পটিয়া মাদরাসায় এবং দেওবন্দে পড়াশোনা করেছে। ইতোমধ্যে সবাই কমবেশি এ বিষয়ে অবগত।
একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনাকে নাটকের মতো সাজিয়ে লাইভ প্রচার করে ইসলামবিদ্বেষী বর্ণবাদী মিডিয়া এ ইস্যুতে মাদরাসা, মসজিদ ও আলেম-ওলামার ইমেজকে কলঙ্কিত করতে একযোগে প্রপাগান্ডায় মেতে উঠেছে।
হলুদ মিডিয়ার এ ধরনের প্রপাগান্ডার বিরুদ্ধে হকপন্থী মিডিয়ার পাল্টা জবাবই সর্বোত্তম। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে, কওমি ঘরানার কোনো মূলধারার সংবাদপত্র বা মিডিয়া না থাকায় তা সম্ভব হচ্ছে না।
ফলে, মূলধারার প্রচলিত প্রপাগান্ডিস্ট মিডিয়াগুলো প্রায়ই ইসলামপন্থী নেতাকর্মীদের সম্পর্কে উদ্দেশ্যমূলক বানোয়াট তথ্য প্রচার করে। আবার সেই বানোয়াট তথ্যগুলো ভিকটিমদের বিরুদ্ধেই পরবর্তীতে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করা হয়। এই হলো বাস্তবতা। জাতীয় পর্যায়ে নিজেদের মিডিয়া না থাকলে বঞ্চনা ও অপসাংবাদিকতার শিকার হওয়া ছাড়া উপায় আছে কি?
ইয়েলো মিডিয়া প্রতিদিন আপনাদের ভিলেন বানাচ্ছে। কুরআন হাদিসের বইকে ‘জিহাদি বই’ বানাচ্ছে। আপনাদের হাতের মিছওয়াককে ‘ছোরা’ বানিয়ে জাতির সামনে উপস্থাপন করছে। আপনাদের হাতের তসবিহ’র দানাকে ‘বুলেট’ আকারে প্রদর্শন করে আপনাদের প্রতিদিন কালিমালিপ্ত করছে— এগুলো মোকাবেলার জন্য আপনাদের একটাই মাত্র উপায়: সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম।
আজকের দিনে মিডিয়ার প্রপাগান্ডা একটি সাধারণ বাস্তবতা। এটার পাল্টা মোকাবেলা করতে হবে সেই মিডিয়া দিয়েই। কিন্তু আবেগসর্বস্ব তর্জন-গর্জন করে কোনো কাজ হবে না। এভাবে আদৌ কিছু হয়েছে কি?
কওমিরা হলো একটা কমিউনিটি। মূলধারার গণমাধ্যম সেক্টরে তাদের কমিউনিটি-বেইজড বা প্রতিনিধিত্বকারী একটি প্রিন্ট/ব্রডকাস্ট মিডিয়া থাকা অনিবার্য হলেও সেটা একেবারেই নেই। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক এবং হতাশাজনক।
যদিও অনলাইন জার্নালিজমে কওমিদের উপস্থিতি সাম্প্রতিককালে বাড়ছে। তবুও সেটা যে খুব সুসংগঠিত, আমার তা মনে হয়না। তবে আরো এগিয়ে যেতে হলে এইক্ষেত্রে তাদের আরো বেশি সংগঠিত হওয়া এবং কওমি নেতৃবৃন্দ কর্তৃক সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা গ্রহণ করা জরুরি।
কওমিদের এখন বুঝতে হবে, সাংবাদিকতা কী জিনিস। শুধু সাহিত্য নিয়ে মগ্ন থাকলে ফলাফল অশ্বডিম্ব। সাহিত্যচর্চার পাশাপাশি সাংবাদিকতা পেশায় তাদের অংশগ্রহণ আরো বাড়াতে হবে।
এখন কওমিদের উপলব্ধি করা দরকার যে, হলুদ মিডিয়ার মোকাবেলা শুধু সাহিত্য দিয়েই করা যাবেনা। গল্প-কবিতার সমাহার দেখিয়ে আপনি হলুদ মিডিয়ার অনাচার ও দুরাচার রোধ করতে পারবেন না। সাংবাদিকতা, চিন্তা ও বিশ্লেষণচর্চা ব্যতীত আপনি শুধু সাহিত্য দিয়ে আপনার রাজনৈতিক সংকটও মোকাবেলা করতে পারবেন না।
আমি যতদূর জানি, আল্লামা শফী সাহেবের একটা ফোনই যথেষ্ট। দশটা পত্রিকা ও দশটা টিভিচ্যানেলের লাইসেন্স মাদ্রাসায় এসে পায়ে সালাম করে সরকার দিয়ে যাবে।
কিন্তু কওমি মাদরাসার কর্তৃপক্ষ এবং নেতৃবৃন্দকে তো আগে এর গুরুত্ব বুঝতে হবে। তাছাড়া দক্ষ ও যোগ্য সাংবাদিক জনবল গড়ে না তুললে নিজেদের জন্য জাতীয় মানের কোনো পত্রিকা চালানোও সম্ভব না, টিভিচ্যানেল তো দূরের কথা। হাজারটা লাইসেন্স পেয়ে কী লাভইবা হবে তখন?
সুতরাং, আজকের পরিস্থিতি বিবেচনায় কওমি মাদরাসায় সাংবাদিকতা বিষয়ে একাডেমিক পাঠদান ও প্রশিক্ষণ জরুরি। নন-একাডেমিক প্রশিক্ষণের কথা বলছি না। মিডিয়ার জন্য যোগ্য ও দক্ষ সাংবাদিক জনবল গড়ে তুলে নিজেদের জন্য একটি মূলধারার জাতীয় দৈনিক বা একটি টিভি চ্যানেল প্রতিষ্ঠা করা তাদের একান্ত জরুরি।
তাছাড়া সাহিত্য আর সাংবাদিকতাকে গুলিয়ে ফেলা যাবে না। দুটোর অবস্থান গুণগতভাবেই স্বতন্ত্র। বিশেষত, সাংবাদিকতা একটি পেশা। ব্যক্তির খেয়ালখুশি, স্বেচ্ছাচারিতা, কল্পনা-জল্পনার সুযোগ এখানে নাই। কারণ শুধু ভাবতে পারা বা লিখতে পারাই সাংবাদিক হওয়ার যোগ্যতা নয়। নিউজ, রিপোর্ট, ফিচার, এডিটোরিয়াল ইত্যাদি লেখার ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট ফরম্যাট অনুসরণ করে লিখতে হয়। এটি গল্প-কবিতা লেখার মতো ইচ্ছামাফিক কোনো বিষয় নয়।
এছাড়া সাংবাদিকতার নির্দিষ্ট পেশাগত মূল্যবোধ ও নীতিমালা রয়েছে। এগুলো না মানার সুযোগ নেই। অন্যদিকে, সাহিত্যে এতসব ফর্মালিটি ও নিয়মনীতির বালাই নেই। সাহিত্য হচ্ছে, রসকলা ও শিল্পকলার চর্চা মাত্র। সাহিত্যের জন্য প্রশিক্ষণ লাগে না। নিজের রুচিমতো ব্যক্তিগতভাবে নিরন্তর চর্চা করতে থাকলে এবং ট্যালেন্ট থাকলে যেকেউ একজন ভালো সাহিত্যিক হতে পারেন।
কিন্তু একাডেমিক পদ্ধতির বা নিয়মতান্ত্রিক প্রশিক্ষণ ছাড়া পেশাদারিত্ব ও মূল্যবোধ নিয়ে সাংবাদিকতা করা কঠিন। প্রশিক্ষণ ছাড়া সাংবাদিক হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলা সময়সাপেক্ষ বটে এবং স্ট্যান্ডার্ড লেভেলের পেশাদার সাংবাদিক হওয়ার সম্ভাবনাও খুব কম।
ইসলামী যিন্দেগী ইনস্টল করতে এখানে ক্লিক করুন
তাছাড়া আমাদের দেশে সামগ্রিকভাবে সাংবাদিকতা চর্চায় প্রফেশনালিজম বা পেশাদারিত্ব গড়ে না উঠার প্রধান কারণ হলো, একাডেমিক পদ্ধতির প্রশিক্ষণকে অবহেলা করে সাংবাদিকতা করার সুযোগ পাওয়া।
তবে, সামনে সাংবাদিকতা করতে হলে সনদ লাগবে। সনদ ছাড়া সাংবাদিকতা করা যাবে না। ভুয়া সাংবাদিকদের দৌরাত্ম্য ও অপসাংবাদিকতা রোধে কঠোর নীতিমালা করার ক্ষেত্রে সরকার ইতোমধ্যে কাজ শুরু করেছে। শিগগির এ নীতিমালা আমরা পাবো।
আজকের দিনে মিডিয়া হচ্ছে একটা শিল্প প্রতিষ্ঠান। সাংবাদিকতা যেমন একটি বিশেষ পেশা, তেমনি এটি একটি শিল্পও। আর, সাহিত্যকে অবশ্যই গুরুত্ব দিতে হবে। কিন্তু অত্যধিক গুরুত্ব দিতে গিয়ে সাংবাদিকতার প্রশিক্ষণ গ্রহণে কোনো অবহেলা নয়। বিষয়টা যেন কওমিরা মাথায় রাখেন।
সময়ের চাহিদানুসারে একটি মূলধারার প্রিন্ট বা ব্রডকাস্ট মিডিয়া নিয়ে কোনো পরিকল্পনা কি কওমি কর্তৃপক্ষ বা নেতৃবৃন্দের আছে? প্রতিপক্ষ বহু আগে থেকেই প্রস্তুত, কিন্তু আপনারা? সময়ের চাহিদা ও আবেদন না বুঝলে বর্তমানকে জয় করা যায়না এবং ভবিষ্যত নির্মাণের পথও সুগম হয় না।
ইয়াবা ব্যবসায়ী শহিদুল্লাহর গ্রেফতারের ভিডিও; মিডিয়ার অসুখকর বাড়াবাড়ি
-আরআর