উবায়দুর রহমান খান নদভী: রমজান মাসে সিয়াম সাধনা শেষে আসে ঈদুল ফিতর। ঈদের আনন্দে যেন মুসলিম জাতির প্রতিটি সদস্য শরীক হতে পারে এ জন্য ফিতরা ওয়াজিব করা হয়েছে। এতে রোজার ত্রুটি বিচ্যুতিও পুরণ হয়ে যায়। ইসলাম বিশ্বজনীন কালজয়ী আদর্শ।
দেড়হাজার বছর আগে মহানবি সা. বিশ্বের প্রধান খাদ্যদ্রব্য দিয়ে ফিতরার স্ট্যান্ডার্ড নিরুপণ করেছেন। সাধারণত বিশ্বব্যাপী মানুষের ফসল খাদ্য বা সম্পদ গম, যব, খেজুর, কিসমিস, মনাক্কা, পনির ইত্যাদি দিয়ে পরিগণিত হয়।
পৃথিবীর অনেক দেশ বর্তমানে এ তালিকায় চালকেও শামিল করে নিয়েছে। এটি অঞ্চলের মানুষের প্রধান খাদ্য বিবেচনায় করা হয়েছে। তবে সব আলেম এ বিষয়ে একমত হননি। তারা বলেছেন, এভাবে স্ট্যান্ডার্ড পরিবর্তন করলে মহানবী সা. এর নির্দেশ অবিকৃত থাকবে না।
তিনি ইচ্ছে করলে চালের নাম তখনই উচ্চারণ করতে পারতেন। সুতরাং হাদীসে বর্ণিত বস্তুগুলোকে স্ট্যান্ডার্ড হিসাবে কেয়ামত পর্যন্ত ধরে রাখাই উত্তম। এখানে গম ছাড়া বাকী সব বস্তু দ্বারা ফিতরা দিলে এর পরিমাণ সাড়ে তিন সের। গমের বেলায় পৌনে দুই সের।
এটি খেলাফতের রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত। কারণ, মক্কায় গম ছিল সিরিয়া থেকে আমদানিকৃত বস্তু, দাম ছিল দ্বিগুণ। মানুষ আদায় করতে পারতো না। নবুওয়তের অনুসারী খেলাফত ঘোষণা দিল, অন্যসব সাড়ে তিন সেরই থাকবে। কেবল গম পৌন দুই সের দিলেই চলবে।
যেন, বেশি মানুষ দিতে পারে। অধিকাংশ আলেমগন বলেছেন, যে বস্তুর নাম হাদীসে আছে তা দিয়েই ফিতরা দিতে হবে। কেবল ইমাম আযম আবু হানিফা রহ. ইজতেহাদ করে রায় দিয়েছেন যে, এসবের মূল্য দিলেও ফিতরা আদায় হবে। কারণ দেখিয়েছেন, ‘আনফাউ লিল ফুকারা’।
মসজিদে কেউ এতেকাফ না করলে এলাকার সবার গুনাহ হয়?
কাঁচা খাদ্য খাওয়া ছাড়া অন্য কাজে লাগে না। বেশি হলে নষ্ট হয়। বিক্রিও সম্ভব হয় না। অতএব, গরীবদের জন্য নগদ টাকা পেলে বেশি উপকারী। যেখানে ইচ্ছা খরচ করতে পারে। এ কথাটির অর্থই ‘আনফাউ লিল ফুকারা’। ফিতরা নিয়ে অতীত আলেমদের মতামত ও বর্তমান সময়ের ইসলামী চিন্তাবিদদের কনসেপ্ট অল্প স্বল্প জেনে বাংলাদেশেও গত কয়েক বছর ধরে প্রতিষ্ঠিত ফেকাহ ও শরীয়তের শৃংখলা তছনছ করে দেওয়ার জন্য একটি মহল নানা বিতর্কের জন্ম দিচ্ছে।
এক পর্যায়ে তারা ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ঘারে সওয়ার হয়। তখন খতীব সালাহউদ্দীন সাহেব ও ডিজি দেশের আলেমদের সহায়তা নেন। ঢাকার বিশিষ্ট মাদরাসার ইফতা ও বিখ্যাত মুফতিগণ তাদের ডাকে সাড়া দেন। চ‚ড়ান্ত বৈঠকে অন্যান্যের মাঝে মুফতি আব্দুল মালেক ও আমিও ছিলাম।
অনেক কথাবার্তার পর সর্বশেষ বক্তব্য দেওয়ার জন্য আমাকে বলা হয়। প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া আমাকে ফেইস করতে বলা হয়। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে সবাই মিলে একবাক্যে বলেন, নদভী সাহেব আমাদের এই গবেষণা ও পর্যালোচনার বৈঠকের মুখপাত্র।
তখন প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে ফিতরার পূর্ণাঙ্গ কনসেপ্টটি নতুন করে জনগণের সামনে আসে। এর আগে ফিতরার সর্বনিম্ন পরিমাণ কোনো হিসাব কিতাব ছাড়া ১০০ টাকা ধরে দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল।
আমরা তখন ফিতরার চির নির্ধারিত স্ট্যান্ডার্ড বস্তুর নাম ও পরিমাণসহ মহানবী সা. এর হাদীস থেকে উদ্ধৃত করেছি। সে কাজে যুক্ত ৩৩ জন মুফতি সাহেবের হৃদ্যতা ও শ্রম আমি কোনোদিন ভুলতে পারবো না। এই অভাজনের ওপর তাদের সে সময়কার আস্থার প্রতিদান আল্লাহ তাদের দিবেন। নতুবা সে ফেতনা মোকাবেলা করে আমরা জয়ী হতে পারতাম না।
মদিনা রাষ্ট্রটি তখন কয়েক লাখ বর্গমাইল হলেও নগরটি ছিল বর্তমান মসজিদে নববির সমান। জনগণ ছিলেন সর্বসাকুল্যে তিন লাখ। তাদের কেউ যেন ঈদের দিন কষ্ট না করেন সে জন্য জামাতের যাওয়ার আগেই ফিতরা আদায় করার হুকুম ছিল।
যারা ফিতরা দিতেন তাদের জীবন মানও ফিতরা পাওয়া মানুষদের চেয়ে খুব বেশি উন্নত ছিল না। বিশেষ ধনী মানুষ ছিলেন হাতে গোনা কয়েকজন। আজকের মুসলিম সমাজ বঞ্চিত মানুষদের ঈদ আনন্দে শরীক করতে চাইলে আইনত তারা ৬০-৭০ টাকা থেকে ফিতরা শুরু করতে পারে।
আরও বেশি যে দেওয়া যায় এটি বিগত বিতর্কের আগে মানুষ জানতও না। জানতেন কেবল উলামায়ে কেরাম। এখন গম থেকে পৌনে দুই সের অথবা উহার মূল্য (বাজার ভেদে দাম ৬০/- হাটহাজারী ঘোষিত, ৬৫/- আহমাদিয়া সুন্নিয়া ঘোষিত, ৭০/- ইসলামিক ফাউন্ডেশন ঘোষিত) দাতার ওপর নির্ভর করে।
সর্বনিম্ন পরিমাণ বলে দেওয়া আলেমদের দায়িত্ব। যদি কেউ ১০০/- সমান করে দিয়ে দেন তাহলে সমস্যা কি? পনির দিয়ে আদায় করলে সাড়ে তিন সের মোটামুটি ২০০০/-। খেজুর দিয়ে আদায় করলে সাড়ে তিন সের (১০০/- কেজি থেকে ৫০০০/- কেজি মূল্যের খেজুর ঢাকাতেই পাওয়া যায়।)
৩৫০/- থেকে ১৭৫০০/- পর্যন্ত একেকটি ফিতরার মূল্য দাঁড়ায়। এখন আপনি নিজের ও পরিবারের প্রতিটি পোষ্যের পক্ষ থেকে ঈদের আগেই অর্থাৎ রমজানে ফিতরা আদায় করে দিন। আপনার সংগতি মতে ফিতরা দেওয়া নৈতিকতার দাবী।
একজন কোটিপতি তার পরিবারের চার সদস্যের ফিতরা ২৪০/- টাকা দেবেন না ৭০০০০/- দেবেন এটি তার বিবেচনার ওপর ছেড়ে রাখা হয়েছে। আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস ও মহব্বত অনুযায়ী মানুষ ফিতরা আদায় করে। ফিতরার এ বিস্তারিত হিসাব ও কনসেপ্ট আত্মস্থ করে নিলে এ মহান অর্থনৈতিক কার্যক্রম ও পবিত্র সওয়াবে পরিপূর্ণ ইবাদতটি আপনার কাছে খুব ভালো লাগবে।
মুসলমানরা শুধু নয় বিশ্বের চিন্তাশীল সকল মানুষ মহানবী সা. এর এই মানবিক ও সাম্য, মৈত্রিপূর্ণ আদর্শের প্রতি আরও শ্রদ্ধাশীল হয়ে উঠবে।
আরো পড়ুন- যাকাতের গুরুত্ব ও তাৎপর্য, বর্তমানে যাকাত ফিতরার পরিমাণ