মাওলানা এহসানুল হক
সিয়াম সাধনার মাস রমজানেই রাজপথে নেমেছিল তরুণ প্রজন্মের উলামায়ে কেরাম। ২১ মে সোমবার জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে অনুষ্ঠিত মাববন্ধনে ঝড় বৃষ্টি উপেক্ষা করে দলে দলে সমবেত হয় দেওবন্দপ্রেমী ছাত্র-শিক্ষকরা। ব্যানার, প্লাকার্ডে লেখা ছিল ‘আমরা দেওবন্দ পড়তে চাই’। ‘একাডেমিক ভিসা চাই’ ‘শিক্ষার দুয়ার হোক উন্মুক্ত’।
ছোট একটি মানববন্ধন বেশ আলোচনার সৃষ্টি করেছে। আপন মহলের মধ্যেই নানা ধরনের আপত্তি সৃষ্টি হয়েছে। উঠে এসেছে বিভিন্ন রকম প্রশ্ন। শুরু থেকেই আমি আন্দোলনের সাথে যুক্ত আছি। কাছ থেকে আমি যা উপলব্ধি করেছি সেই আলোকে কিছু কথা বলতে চাই।
এক. হটাৎ করে এই আন্দোলন কেন?
কোনো কারণ ছাড়াই হটাৎ আন্দোলনের চিন্তা করা হয়নি। একটি বিশেষ পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার কারণেই হয়েছে। আমরা জানি, আমাদের কিছু ছাত্র ভাই দেওবন্দ থেকে ফেরার পথে আইনি জটিলতার মধ্যে পড়েছেন। এ ধরনের জটিলতা সব সময়ই থাকে। কিন্তু এবার বিপদের মাত্রাটা অন্য সময়ের চেয়ে বেশি। এখন আমাদের কী করণীয়? প্রথমত তাদের দেশে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা, আইনি সহায়তা করা। দ্বিতীয়ত এ সমস্যার স্থায়ী সমাধানের চেষ্টা করা।
আমরা সেই কাজটা করতে চাই। ভেতরগতভাবে আলোচনার মাধ্যমে তাদের আইনি সহায়তার চেষ্টা চলছে। আর ব্যাপারটার স্থায়ী সমাধানের জন্য রাজপথে মৃদু আওয়াজ তোলা হয়েছে।
দুই. দাবির সাথে একমত, পদ্ধতির সাথে নয়, আলোচনায় না গিয়ে রাজপথে কেন?
অনেকেই বলছেন, আমরা দাবির সাথে একমত, পদ্ধতির সাথে নয়। রাজপথে কেন নামা হলো। আমরাও জানি এই সমস্যার সমাধান রাজপথে হবে না। তবুও রাজপথে নামতে হয়েছে। আমরা রাজপথে নেমেছি উপর মহলের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য। ব্যাপারটা আলোচনায় নিয়ে আসার জন্য। আর সেটা রাজপথে না নামলে কখনোই হতো না।
বেঁচে আছেন যুবরাজ মুহাম্মদ, অংশ নিলেন পরিষদ সভায়
আলোচনা বাদ দিয়ে রাজপথে আমরা থাকতে চাই না। আলোচনা ও রাজপথ দুইটা এক সাথেই করতে চাই। শুধু আলোচনা করে কোন দাবি আদায় করা যায় না। ঠিক তেমনই শুধু আন্দোলন করেও হয় না। তাছাড়া কোনো মিছিল বা সমাবেশ করা হয়নি, মানববন্ধন করা হয়েছে।
মানববন্ধন হচ্ছে সবচেয়ে নিরীহ ও ভদ্র কর্মসূচি। নিজেদের দাবির জানান দেয়ার জন্য এর চেয়ে উত্তম কোন কর্মসূচি এখনও নেই।
তিন. এরা কারা? কারা এর নেতৃত্ব দিচ্ছে?
আমাদের দেশের কাওমি ধারার প্রায় সবগুলো দল বা হালকার গুরুত্বপূর্ণ প্রতিনিধি এখানে আছেন। খেলাফত মজলিস থেকে মাওলানা মামুনুল হক। ইসলামি ঐক্যজোট থেকে মাওলানা সাখাওয়াত ও গাজী ইয়াকুব। ইসলামি আন্দোলন থেকে গাজী আতাউর রহমান। জমিয়ত থেকে ওয়ালী উল্লাহ আরমান, ইমরানুল বারী সিরাজী, জাবের কাসেমী। খেলাফত আন্দোলন থেকে ফখরুল ইসলাম। নেজামে ইসলাম থেকে শেখ লোকমান আহমদ। অনলাইন এক্টিভিস্টদের মধ্যে সাইমুম সাদী। লেখক সমাজ থেকে মুফতি এনায়েতুল্লাহ, এহসানুল হক। বক্তা ও মিডিয়া ব্যক্তিত্বদের মধ্যে মাওলানা হাসান জামিল, রেজওয়ান রফিকী, শামছুদ্দোহা আশরাফী। প্রায় সবাই পরিচিত মুখ।
চার. আলেম সমাজের প্রতিনিধিত্বশীল ছাত্র সংগঠনকে কেন পাশ কাটানো হলো?
আলেম সমাজের প্রতিনিধিত্বশীল ছাত্র সংগঠনকে রাখা হয়নি। পাশ কাটানো হয়েছে। এটা ভুল কথা। তাদের বাদ দিয়ে এমন সংগঠনকে কি রাখা হয়েছে যারা প্রতিনিধিত্ব করার মত না? রাখা হয়নি। এখানে কোনো ছাত্র সংগঠনের বিবেচনা করা হয়নি। উদ্যোগটা হয়েছে সবদলের মাঝারি ধরনের নেতাদের মাধ্যমে।
পরিকল্পনা হলো, বড়দের সহযোগিতায় ছাত্রদের সাথে নিয়ে আন্দোলন করার। সবাইকে সাথে নিয়ে আন্দোলন করতে হবে। কাউকে পাশ কাটিয়ে নয়।
পাঁচ. দেশ বিরোধী অখণ্ড ভারত প্রতিষ্ঠায় তৎপর গোষ্ঠির হাতে যৌক্তিকতার সুযোগ তৈরি করে দিচ্ছি না তো?
এটা কেমন কথা? স্টুডেন্ট ভিসা চাওয়ার সাথে অখণ্ড ভারত প্রতিষ্ঠার মিল কোথায়। দেশবিরোধী কাজের কথা বলে এখানে একটি বিশেষ মহলকে উস্কানি দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। আর কিছু না।
ছয়. সরলমনা আলেমরা ষড়যন্ত্রে পা দিচ্ছে?
এই আন্দোলনের সাথে যারা যুক্ত তারা কেউই প্রাচীন আমলের না। তাদের সরল সহজমনা নিরিহ উলামায়ে কেরাম বলার সুযোগ অনেক কম। আবার তারা নবীন কিশোরও না। দীর্ঘকাল মাঠে ময়দানে রাজনীতির অভিজ্ঞতা আছে। বতমার্ন যুগের ভাষা সম্পর্কে যাদের দক্ষতা আছে তারাই এখানে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তারা না বুঝে ষড়যন্ত্রে পা দিচ্ছে এমনটা ভাববার সুযোগ অনেক কম।
সাত. এখন নাজুক সময়, এখন দুঃশাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করা দরকার?
এখন নাজুক সময় বলে কি অধিকার আদায়ের কথা বলা যাবে না? তাছাড়া দেশে এখন কোনো উত্যপ্ত পরিস্থিতিও বিরাজ করছে না। হয়তো আইনের শাসন নেই। গণতন্ত্র নেই। বিরোধীদলের বাক স্বাধীনতা নেই। আরও অনেক সমস্যা আছে আমি সেটা অস্বীকার করছি না।
কিন্তু পরিস্থিতি এখন ঠাণ্ডা। বিরোধী দলের আন্দোলন নাই। জামাত শিবিরের আন্দোলন নাই। নিবার্চন সামনে থাকলেও নিবার্চন নিয়ে কোন তৎপরতা নেই। তাহলে কেন এখন দাবি তোলা যাবে না? সময় ভালো ছিল কবে?
তাহলে বলেন কওমি সনদের স্বীকৃতি চাওয়া যাবে না। কোনো দাবি করা যাবে না। নাজুক সময় তখন কই যায়, দুঃশাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনের কথা তখনও মনে রাখা দরকার।
আট. যারা ভারতে আছে তাদের সংকট আরও বৃদ্ধি হবে কি না এর কারণে?
এ দাবি নিয়ে যখনই কথা বলা হবে তখনই দেখা যাবে আমাদের কিছু ছেলে সেখানে পড়ছে। আর আমাদের মানবন্ধন তাদের মুক্তির দাবিতে হয়নি। তারা কোন সমস্যায় পরতে পারে এই কথা মাথায় রেখেই মূল নেতারা তাদের বিষয়ে কোনো বক্তব্য রাখেনি।
কিন্তু যদি তাদের বিপদে ফালানোর চেষ্টা করা হয়। বা তারা কোনো বেকায়দায় পরে তখন চাপ সৃষ্টি করার জন্য কাজে দিবে এই আন্দোলন।
আর আন্দোলন করলেই ভারত সরকার তাদের দিকে নজর দিবো এটা ভাবাও বোকামি। আপনি কি ভেবেছেন ‘র’ জানে না যে বাংলাদেশ থেকে ছাত্ররা পড়তে যায়? এটা হতে পারে না। তাদের কাছে সব খবরই আছে। একদিকে আমরা আমাদের দেশের যে কোনো কিছুর পিছনে ‘র’ আছে মনে করি, অপর দিকে তাদের দেশের আমাদের এত ছেলে আছে সেটা তারা জানে না বলতে চাই এটা স্ববিরোধিতা ছাড়া আর কিছু না।
নয়. সীমান্তের বাধা উঠিয়ে দেয়ার দাবি করা হয়েছে। এটা কেমন কথা?
এখানে মূলত আইনি বাধা উঠিয়ে দেয়ার কথা বলা হয়েছে। ভিসা প্রদানের কথা বলা হয়েছে। এটা যে কেউ বঝুবে। বক্তা একজন লেখক মানুষ হওয়ায় ভাষাগত সৌন্দর্যের জন্য এভাবে তিনি বলেছেন। তবুও আমি স্বীকার করি এভাবে বলার কারণে আপত্তির সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এই সুযোগটা দেয়াও ঠিক হয়নি।
শেষ কথা
দেওবন্দ প্রতিটি কওমি সন্তানেরই প্রাণকেন্দ্র। আমরা সবাই চাই দেওবন্দ পড়াশুনার দ্বার উন্মুক্ত হোক। সেটা কিভাবে হবে। আমরা বিষয়টা আলোচনার টেবিলে নিয়ে আসলাম। কোনো আপত্তি থাকলে বলুন। অনলাইনে বির্তক সৃষ্টি না করে আলোচনা করুন। বেটার ফর্মূলা দিন। আমরা সেটাই অনুসরণ করবো ইনশাআল্লাহ।
লেখক: সহকারী সম্পাদক, মাসিক রাহমানী পয়গাম
‘রাষ্ট্রীয় সীমানা প্রাচীর উঠিয়ে কওমি শিক্ষার্থীদের দেওবন্দে পড়ার সুযোগ দিন’
-আরআর