পলাশ রহমান
ইতালি থেকে
দেশের অন্যতম প্রধান বিভাগীয় শহর এবং বন্দরনগর খুলনায় সিটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে গত ১৫ মে তারিখে। প্রায় ৫ লাখ ভোটারের এ নগরে মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন পাঁচ জন প্রার্থী।
দেড় লাখের উপরে ভোট পেয়ে নৌকা প্রতীকে নির্বাচিত হন সরকার দলীয় প্রার্থী তালুকদার আবদুল খালেক। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন বিএনপির নজরুল ইসলাম মনজু। ধানের শীষ প্রতিকে তার প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যা এক লাখ নয় হাজারের মতো।
তৃতীয় সর্বোচ্চ ভোট পেয়েছেন হাতপাখা প্রতীকে মাওলানা মুজাম্মিল হক। ইসলামী আন্দোলন খুলনা মহানগরের সভাপতি মুজাম্মিল হকের প্রাপ্ত ভোট সংখ্যা ১৪ হাজার ৩৬৩। মজার ব্যাপার হলো সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টির নেতা শফিকুর রহমান এ নির্বাচনে লাঙ্গল প্রতীকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ভোট পেয়েছেন মাত্র ১ হাজার ৭২। কমিউনিস্ট পার্টি পেয়েছে লজ্জাজনক ভোট। মাত্র ৫০০।
ইসলামী আন্দোলনের প্রতীক হাতপাখার প্রাপ্ত ভোট নিয়ে দেশের সর্ব মহলে আলোচনা সমালোচনা হচ্ছে। বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে বেশ লেখালেখি হয়েছে, হচ্ছে। বিজ্ঞ নির্বাচন বিশ্লেষকরা তাদের মতামত প্রকাশ করেছেন।
অধিকাংশ ভোট বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ভোটের রাজনীতিতে ইসলামী আন্দোলনের নীরব উত্থান ঘটেছে। যদিও দলটি এখনো দেশের কোথাও মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আসতে পারেনি, কিন্তু তাদের ভোট প্রাপ্তির ধারাবাহিকতা বেশ সন্তোষজনক।
উল্লেখ্য, নারায়নগঞ্জের মেয়র নির্বাচনে ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থী মুফতি মাসুম বিল্লাহ পেয়েছিলেন ১৩ হাজার নয়শ ১৪ ভোট। ঢাকা উত্তরের নির্বাচনে সাবেক ছাত্র নেতা শেখ ফজলে বারী মাসউদ পেয়েছিলেন ১৮ হাজার ৫০ ভোট। দক্ষিণে আবদুর রহমানের প্রাপ্ত ভোট সংখ্যা ছিল ১৪ হাজার সাতশ ৮৪।
রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে গোলাম মোস্তফা পেয়েছিলেন ২৩ হাজার সাতশ ১৮ ভোট। যা ছিল বিএনপির ধানের শীষ প্রতীকে প্রাপ্ত ভোটের খুব কাছাকাছি। ধারণা করা হচ্ছে গাজীপুরেও হাতপাখা উল্লেখযোগ্য ভোট সংগ্রহ করতে পারবে।
খুলনা সিটি নির্বাচনে ইসলামী আন্দোলনের হাতপাখা প্রতীকের প্রাপ্ত ভোট নিয়ে দেশের বিভিন্ন মহল থেকে মিশ্র প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেছে। বিশেষ করে ইসলামি মহলের প্রতিক্রিয়া অনেকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।
অন্যান্য ইসলামি দলের নেতারা তাদের মতামত প্রকাশ করতে গিয়ে কেউ কেউ মনের খেদ প্রকাশ করেছেন। খুলনার নির্বাচনে তাদের কোনো প্রার্থী না থাকলেও তারা কেউ উদারভাবে ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থীকে সমর্থন যোগাতে পারেননি। হাতপাখার ধারাবাহিক উত্থানকে তারা কেউ ইসলামের বিজয় হিসাবে দেখতে পারেননি।
তারা কেউই উদারভাবে বলতে পারেননি- ইসলামী আন্দোলনের প্রাপ্ত ভোট বা হাতপাখার প্রাপ্ত ভোট বাংলাদেশে ‘ইসলাম’ বিজয়ের অনুপ্রেরণা সৃষ্টি করেছে। তারা অনেকেই কৌশলি কথা বলেছেন। কারো কারো কথায় বিদ্বেষ প্রকাশ পেয়েছে।
এর পেছনের কারণ হতে পারে দেশে ইসলামী আন্দোলনের মতো স্বাধীনভাবে অন্য কোনো ইসলামি দল রাজনীতি করে না। তারা কোনো না কোনোভাবে অন্য কোনো দল বা জোটের সাথে সুতা বেঁধে রেখেছেন। সুতরাং ইচ্ছা করলেই তারা স্বাধীন মতামত প্রকাশ করতে পারেন না।
আবার কেউ কেউ মনের দৈন্যতায়ও ভুগতে পারেন। তবে সঠিক ইসলামের রাজনীতি করলে তাদের উচিৎ ছিল যে কোনো নির্বাচনে ইসলামের পক্ষের প্রার্থীকে সমর্থন যোগানো। যে উদারতা দেশের কোনো ইসলামি দল আজ অবধি দেখাতে পারেনি।
খুলনার সিটি নির্বাচনে হাতপাখার প্রাপ্ত ভোট নিয়ে খোদ ইসলামি আন্দোলনেই অসন্তোষ দেখা গিয়েছে। তাদের স্থানীয় নেতাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, সরকারি দল খুলনায় অভিনব ভোট কারচুপি করেছে। তারা বিভিন্ন কেন্দ্র থেকে পোলিং এজেন্টদের বের করে দিয়েছে। ভোট পরিচায়নায় নিয়জিত কর্মকর্তাদের জিম্মি করে সরকারি দলের সমর্থকরা ব্যাপক জাল ভোট দিয়েছে।
আওয়ার ইসলামকে দারুল উলুম দেওবন্দের চিঠি
অনেক ভোটার কেন্দ্রে গিয়ে ভোট না দিয়ে ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছে। কারণ সরকারি দলের সমর্থকরা আগেই তার নামে জাল ভোট দিয়ে রেখেছে। ইসলামী আন্দোলনের নেতারা মনে করেন, সরকার ভোট জালিয়াতি না করলে তাদের মেয়র প্রার্থী আরো বেশি ভোট পেতেন। ৩১ ওয়ার্ডের মধ্যে অন্তত ১০ জন কাউন্সিলর প্রার্থী মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আসতে পারতেন। কিন্তু তা হতে পারেনি। পরিকল্পিতভাবে তাদের প্রতীকে ভোট দেয়া হয়নি।
উল্লেখ্য, খুলনায় ব্যাপক ভোট জালিয়াতির খবর সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে। এ নিয়ে খোদ মার্কির রাষ্ট্রদূতও হতাশা প্রকাশ করেছেন। বিএনপির নেতারা নির্বাচন কমিশনের পদত্যাগ দাবী করেছেন।
ইসলামী আন্দোলনের নেতারা বলেছেন, এই কমিশনের অধিনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। স্থানীয় ভাবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে- সরকার দলীয় সমর্থকরা সকাল ১০টার পর থেকে ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে বিভিন্ন কেন্দ্রে প্রবেশ করে এবং এজেন্ট ও নির্বাচন কর্মকর্তাদের বের করে দিয়ে নৌকা প্রতীকে জাল ভোট দেয়। তারা জাল ভোট দিতে কোনো হাঙ্গামা সৃষ্টি করেনি।
অনেকটা চুপিসারে কেন্দ্রে ঢুকে জাল ভোট দিয়ে বেরিয়ে যায়। এক একটা কেন্দ্রে তারা জাল ভোট দিতে সর্বোচ্চ সময় নিয়েছে মাত্র ১০ থেকে ১৫ মিনিট। কেউ কিছু বুঝে উঠার আগেই বা মিডিয়া প্রবেশের আগেই তারা কেন্দ্র ত্যাগ করে। তাদের দক্ষতা দেখে মনে হয়েছে এ কাজে তারা বিশেষভাবে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত। ভোটের আগে অবশ্যই তাদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। না হলে এত দক্ষতা তারা কোথায় পেলো?
সরকার দলীয় সমর্থকদের ভোট জালিয়াতির সময় পুলিশ নীরব ভূমিকা পালন করেছে। বরং ওই সময়ে কোনো সংবাদিক বা অন্য কেউ যাতে কেন্দ্রে ঢুকতে না পারে তা নিশ্চিত করেছে।
খুলনার ইসলামী আন্দোলনের নেতাদের সাথে কথা বলে জানা যায়, এ সিটিতে তাদের ভোট ব্যাংক প্রায় ২৬ হাজার। তারা প্রত্যাশা করেছিল হাতপাখা প্রতীকে কমপক্ষে ৩০ হাজার ভোট পড়বে। কিন্তু বাস্তবে ভোট পড়েছে মাত্র ১৪ হাজার। বাকি ভোট কোথায় গেলো?
তারা বলতে চান- সরকারি দলের ভোট জালিয়াতির কারণে তারা প্রত্যাশিত ভোট পাননি। তাদের ভোটারদের অনেকে কেন্দ্রে যেতে পারেনি। তাদের পোলিং এজেন্টদের বের করে দেয়া হয়েছে।
উল্লেখ্য, ইসলামী আন্দোলনের প্রধান দুই নেতা- আমির, সৈয়দ রেজাউল করীম এবং নায়েবে আমির, সৈয়দ ফয়জুল করীম চরমোনাই তরিকার সকল মুরিদ বা মুজাহিদদের ভোট হাতপাখা প্রতীকে নিশ্চিত করতে বেশ কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেছেন।
আগামী জাতীয় নির্বাচনে হাতপাখায় তারা মোট ভোটের পাঁচ শতাংশ অর্থাৎ সারা বাংলাদেশে কমপক্ষে এক কোটি ভোট হাতপাখা প্রতীকে সংগ্রহ করতে ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করেছেন।
খুলনার সিটি নির্বাচনে হাতপাখার বেশ কিছু ভোট নষ্ট হয়েছে। একই সাথে হাতপাখা এবং নৌকায় সিল দেয়া অনেক ব্যালট পেপার পাওয়া গিয়েছে। এ বিষয়ে ইসলামী আন্দোলনের একজন কেন্দ্রীয় নেতা মজা করে বলেছেন, ভোটাররা দুই দলের কাছেই কমিটমেন্ট ঠিক রেখেছে।
তবে স্থানীয় নেতারা বলেছেন, ভোট প্রদানের ক্ষেত্রে তাদের ভোটারদের প্রশিক্ষণের অভাব আছে। কেউ কেউ হয়তো সঠিক নিয়মে ভোট প্রদান এবং ব্যালট পেপার ভাজ করতে পারেনি। কারণ খুলনার মেয়র নির্বাচনের ব্যালটে সবার উপরে ছিল নৌকা প্রতীক এবং সর্ব নিচে ছিল হাতপাখা।
ভোট প্রদানের পর ব্যালট পেপার নিয়ম মাফিক ভাজ করতে না পারায় এক প্রতীকের ছিলের রং অন্য প্রতীকে লেগে ভোট নষ্ট হতে পারে।
ইসলামি কিতাব, বয়ান ও মালফূযাতের অন্যন্য অ্যাপ
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে হাঙ্গামার ভয়ে অথবা অন্য কোনো কারণে ইসলামী আন্দোলনের অনেকে ভোট দিতে যাননি। বিশেষ করে ভোট কেন্দ্রে তাদের নারী ভোটারদের উপস্থিতি কম দেখা গেছে।
আমি ব্যক্তিগতভাবে জেনেছি- ইসলামী আন্দোলনের সমর্থক একটি পরিবারের মোট ছয় জন ভোটারের মধ্যে চারজনই ভোট দিতে যাননি।
ইসলামী আন্দোলনের রাজনীতির প্রতি নজর রাখেন এমন অনেকে মনে করেন দলের আভ্যন্তরীণ জটিলতা এবং যোগ্য প্রার্থীর অভাবের কারণেও হাতপাখার প্রত্যাশিত ভোট কমতে পারে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে- বাগেরহাটের ধার্মিক এক ব্যবসায়ী খুলনার মেয়রপ্রার্থী মাওলানা মুজাম্মিল হকের সকল নির্বাচনী খরচ বহন করার প্রতিশ্রুতি দেন। বিনিময়ে তিনি খুলনার ইসলামী আন্দোলনে আধিপত্য বিস্তার করতে চান। যা ভালো চোখে দেখেননি দলের একজন গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রীয় নেতা।
তারা বাগেরহাটের ওই ব্যবসায়ীর টাকায় খুলনায় নির্বাচন করতে বাধা প্রদান করেন। এতে ভোটের আগেই অনেকটা মুচড়ে যান হাতপাখার প্রার্থী মুজাম্মিল হক। এ ছাড়া ওই ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে আরো কিছু মারাত্মক অভিযোগ প্রকাশ পায়। এর মধ্যে অন্যতম হলো তিনি নির্বাচনের আগে খুলনার শেখ পরিবারের (শেখ হাসিনার ঘনিষ্ট আত্মীয়) সাথে গোপন বৈঠক করেছেন। যার ছবিসহ গুরুত্বপূর্ণ তথ্য কেন্দ্রীয় নেতার কাছে পৌঁছে যায় নির্বাচনের আগেই।
এসব বিষয়ে কেন্দ্রীয় নেতা মুজাম্মিল হকের কাছে জানতে চাইলে তিনি গোছালো কোনো উত্তর দিতে পারেননি। ধারণা করা হচ্ছে বাগেরহাটের ওই ব্যবসায়ীর সাথে অতি সখ্যতা, কাউন্সিলর প্রার্থী মনোনয়নের ক্ষেত্রে স্বেচ্ছাচারিতাসহ বিভিন্ন অভিযোগে মাওলানা মুজাম্মিল হক দলের মধ্যে বড় ধরনের চাপের মুখে পড়তে পারেন। তার দলীয় পদ এবং জাতীয় নির্বাচনের জন্য মনোনয়ন প্রভাবিত হতে পারে।
উল্লেখ্য, বাগেরহাটের ওই ব্যবসায়ী বাগেরহাট ইসলামি আন্দোলনে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করছেন। তিনি খুলনায় একটা জুট মিল কিনে এবং আন্দোলনের আমিরকে দিয়ে তা উদ্বোধন করিয়ে বেশ বিতর্ক সৃষ্টি করেন।
ভোটের রাজনীতিতে ইসলামি আন্দোলন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠলেও দেশের জাতীয় রাজনীতিতে তারা এখনো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারেনি। প্রত্যাশিত পর্যায়ে যেতে হলে তাদের এখনো অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে।
দলীয় শৃংখলা ধরে রাখা এবং সাধারণ ভোটারদের দৃষ্টি আকর্ষণে আরো বেশি মনোযোগী হতে হবে। এর জন্যে দলের আমির অথবা নায়েবে আমির কোনো একজনকে সবসময় ঢাকায় থাকতে হবে। নিয়মিত রাজনৈতিক অফিসে বসতে হবে।
লেখক: প্রডিউসার, রেডিও বেইস ইতালি
[উপসম্পাদকীয় বিভাগে প্রকাশিত প্রতিটি মতামত লেখকের নিজস্ব]