ত্বরিকুল ইসলাম
রাজনৈতিক বিশ্লেষক
গত বছরের ডিসেম্বরে জেরুসালেমকে ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে ঘোষণা দিয়েছিল মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, যা আন্তর্জাতিক আইন অনুসারেই ছিল অবৈধ ডেক্লারেশন।
আর গতকাল ১৪ মে, আন্তর্জাতিক চাপ ও মুসলিম বিশ্বের তীব্র প্রতিবাদ উপেক্ষা করে তেলআবিব থেকে জেরুসালেমে আমেরিকার দূতাবাস স্থানান্তর করা হলো। এর প্রতিবাদে ফিলিস্তিনি মুসলিমরা বিক্ষোভ করছে। বিক্ষোভকারীদের পাখির মতো গুলি করে হত্যা করছে ইসরাইলি সন্ত্রাসী সৈন্যরা।
জেরুসালেম সঙ্কটকে ধর্মীয় ভাবাবেগের জায়গা বাদ দিয়ে শুধু রাজনৈতিক ইস্যু হিসেবে দেখার কথা যারা বলছেন, আমি তাদের সাথে একমত নই। ইন জেনারেল অবশ্যই আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক ইস্যু, কিন্তু একইসাথে ডিপ ইনসাইড এটা ধর্মীয় ইস্যুকেন্দ্রিকও, যেহেতু ফিলিস্তিন ও জেরুসালেম বা আল কুদস ঐতিহাসিকভাবে একটা ধর্মীয় রাজনৈতিক ইস্যু (historically a religio-political issue as well, not only a political one)।
রাজনৈতিক ইস্যু যেমন সত্য, তেমনি এটা ধর্মীয় ইস্যুও। মসজিদুল আকসা ও জেরুসালেম নিয়ে দ্বন্দ্ব-সংঘাত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর ও ঔপনিবেশিক যুগোত্তর আধুনিক রিপাবলিক রাষ্ট্রের প্রবর্তনকালেরও বহু আগের শত শত বছরের আলোড়িত ইস্যু।
আল আকসা মসজিদের দখল নিয়ে মুসলমানরা খ্রিস্টানদের ক্রুসেড মোকাবেলা করেছে অসংখ্যবার। খ্রিস্টানদের দখলেও ছিল আল আকসা। আবার মুসলমানরাও যুদ্ধ করে পুনরুদ্ধার করেছিল।
সুতরাং, ফিলিস্তিন ও জেরুসালেম সংকটকে শুধুমাত্র রাজনৈতিক ইস্যু হিসেবে ভাবার স্ট্যান্ডটাও একধরনের সেকুলার পজিশন, যা মুসলিম বিশ্বের জন্য বিপজ্জনক। কারণ ধর্মীয় ভাবাবেগের জায়গা বা ইস্যু বাদ দিয়ে এটাকে ধর্ম নির্বিশেষে নিরপেক্ষ আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখাটা ফিলিস্তিনের জনগণের ঔপনিবেশবিরোধী লড়াইয়ের পক্ষে কার্যত তেমন একটা কার্যকর ফল বয়ে আনবে না। আসলেই আনেনি; বরং ইসরাইলের আগ্রাসন, দখলবাজি ও ভূমি সম্প্রসারণের স্পর্ধা আরো বেড়েছে।
ভেবে দেখুন, জাতিসংঘ কর্তৃক ৬৭ সালে ইসরাইলের সীমানা নির্ধারণ করে দেওয়া সত্ত্বেও এবং এই আন্তর্জাতিক নিরপেক্ষ নীতিকে এতদিন অনুসরণ করা সত্ত্বেও ইসরাইলের দখলবাজিকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়নি, বরং ইসরাইল প্রায় ফিলিস্তিনের টু-থার্ড বা দুই-তৃতীয়াংশ ভূমি ইতোমধ্যে দখল করে ফেলেছে ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদ করে। ইসরাইলের অবৈধ উচ্ছেদাভিযান ও ভূমি দখলবাজি এখনো অব্যাহত রয়েছে।
দখলদার সন্ত্রাসী ইসরাইলের বিরুদ্ধে এবং জেরুসালেম দখলের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনিদের লড়াই-সংগ্রামকে ধর্মীয় চেতনার জায়গা বাদ দিয়ে শুধুমাত্র রাজনৈতিক ইস্যু হিসেবে দেখানোর চেষ্টার পেছনে মূল মতলবটা হলো- ইসলামের জিহাদনীতি বা প্রতিরক্ষানীতি সম্পর্কে মুসলমানদের ভুলিয়ে দেওয়া বা উদাসীন করে তোলা।
সেকুলার পজিশনের আড়ালে এটা একচুয়ালি ইঙ্গ-মার্কিন জায়নিস্টদের অপকৌশলের অবলম্বন। কারণ, ধর্মীয় চেতনা বা ইস্যু থেকে ফিলিস্তিন ইস্যুকে বিচ্ছিন্ন করা গেলে মুসলিম বিশ্বকে ঐক্যবদ্ধ সম্মিলিত জিহাদনীতি থেকে বিচ্যুত করা সম্ভব হবে।
এখানে জিহাদনীতি বলতে আমি বুঝাচ্ছি, ইসলাম প্রদত্ত সমরনীতি, প্রতিরক্ষানীতি বা যুদ্ধনীতি। যদি ইসলামকে আমরা কমপ্লিট কোড অফ লাইফ হিসেবে বিবেচনা করি, তাহলে ইসলামের প্রতিরক্ষানীতি বা জিহাদনীতিকে আমরা স্কিপ করে বা এড়িয়ে যেতে পারি না।
এই জিহাদনীতি মুসলিম বিশ্বকে ঐক্যবদ্ধ করে দখলদার ইসরাইল ও সহযোগী ইঙ্গ-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে একযোগে সশস্ত্র প্রতিরোধযুদ্ধ গড়ে তুলতে যথা-আজ্ঞা এবং কৌশল ও নির্দেশ প্রদান করে।
আর যদি সেকুলার পজিশনে বসে ফিলিস্তিন সংকটকে ধর্মীয় ইস্যু থেকে বাদ দিয়ে শুধুই রাজনৈতিক ইস্যুর মধ্যে রাখা এবং তথাকথিত নিরপেক্ষ আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে আবদ্ধ করে রাখা হয়, তাহলে ফিলিস্তিন সংকটকে স্রেফ একটা রাষ্ট্রের নিজস্ব সমস্যার মধ্যে যেভাবে আছে, সেভাবেই ফেলে রাখার শামিল।
এটা আধুনিক রিপাবলিক রাষ্ট্রদর্শনের সমস্যা। যার-যার রাষ্ট্র, তার-তার সমস্যা ও ভাবনা। কোনো রাষ্ট্রের নিজের একান্ত স্বার্থ থাকলেই তবে অন্য রাষ্ট্রকে যুদ্ধ-বিগ্রহে হেল্প করবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটেনকে আমেরিকার হেল্প করার কথা স্মরণ করুন।
ফিলিস্তিন সংকটকে শুধু আন্তর্জাতিক সেকুলার পজিশনের রাজনৈতিক ইস্যু হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা গেলে মুসলিম বিশ্বের সামগ্রিকতা থেকে এই ইস্যুকে বিচ্ছিন্ন করা সম্ভব হবে। যতই তথাকথিত আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দিকে তাকিয়ে থাকি না কেন, ইঙ্গ-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও জায়নিজমের আগ্রাসন প্রতিরোধ করতে হলে ইসলামপ্রদত্ত প্রতিরক্ষানীতি বা জিহাদনীতি অবলম্বন করেই মুসলিম বিশ্বকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে সশস্ত্র যুদ্ধে নামলে ইসরাইলকে দুনিয়ার বুক থেকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র।
ইসলামপ্রদত্ত জিহাদনীতি বা প্রতিরক্ষানীতিকে আজ কলুষিত করা হয়েছে। উদ্দেশ্যমূলকভাবে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের সাথে গুলিয়ে ফেলা হয়েছে। সেকুলার দর্শন দিয়ে মুসলমানদের মধ্য থেকে জিহাদের ভাবনা-চিন্তাকে ভ্যানিশ করে দেওয়া হয়েছে। সৌদি এখন মডার্নাইজেশনের পথে।
সুতরাং, সবই পশ্চিমাদের কূটচাল। আর মুসলমানরা বোকার হদ্দ একেকটা। অর্থ আছে, সম্পদ আছে; কিন্তু না আছে ঘিলু, আর না আছে প্রয়োজনীয় ঈমানি চেতনা। আর ঈমানি চেতনা কোথাও থাকলেও তা বুদ্ধিহীন ঈমানি চেতনা। ঈমানি চেতনার সাথে ঘিলুকেও কাজে লাগাতে হবে। মাথায় বুদ্ধি লাগবে।
আরবি ভাষার জ্ঞান প্রয়োগে ইংরেজি শেখার বিশেষ কোর্স
ধর্মীয় জ্ঞানার্জনের পাশাপাশি সমরবিজ্ঞানের জগতে তাদের আরো অংশগ্রহণ বাড়াতে হবে। অস্ত্র, যুদ্ধবিমান ও বোমাবিজ্ঞানে মুসলিম বিশ্বকে স্বাবলম্বী হতে হবে। ইহুদি-নাসারার আবিষ্কৃত এবং তাদের ষড়যন্ত্রমূলকভাবে সরবরাহকৃত বোমা ও অস্ত্র দিয়ে নিজেরা নিজেদের মধ্যে ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধ আর কতদিন চলবে? এবার নিজের পায়ে দাঁড়াও হে মুসলিম বিশ্ব!
মুসলিম বিশ্বের স্বার্থরক্ষার ক্ষেত্রে ওআইসি বা আরবলীগের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ। মুসলমানদের কোনো শক্তিশালী আন্তর্জাতিক কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষ না থাকার কারণে আজকে মুসলমানদের ওপর পরিচালিত একের পর এক অত্যাচার ও গণহত্যা ঠেকানো সম্ভব হচ্ছে না।
আর জাতিসংঘ হলো ইঙ্গ-মার্কিন নেতৃত্বাধীন তথাকথিত আন্তর্জাতিক সংগঠন। বরং বিশ্বব্যাপী মুসলমানদের ওপর অত্যাচার-নির্যাতন জারি রাখার ক্ষেত্রে ইঙ্গ-মার্কিন অপশক্তি এই সংগঠনটিকে কূটনৈতিকভাবে ব্যবহার করে থাকে।
বাস্তবতা হলো, শেষপর্যন্ত ইসলামপ্রদত্ত প্রতিরক্ষানীতি বা জিহাদনীতি বা সমরনীতিকে গ্রহণ করা ছাড়া মুসলিম বিশ্বের আর কোনো বিকল্প নাই। মুসলিম বিশ্বকে আজ ইসলামপ্রদত্ত জিহাদনীতি বা প্রতিরক্ষানীতি অনুসরণ করেই ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। তবেই ইঙ্গ-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও দখলদার ইসরাইলি জায়নিস্টদের বিরুদ্ধে সম্মিলিত প্রতিরোধ-যুদ্ধে জয়ী হওয়া সম্ভব হবে।
শুধুমাত্র সেকুলার পজিশনের রাজনেতিক ইস্যু বানিয়ে আর তথাকথিত আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকলে আল্লাহর পক্ষ থেকে কখনোই বিজয় আসবে না।
ফিলিস্তিনিদের বিজয় বা বেদনা মানে সেটা মুসলিম বিশ্বেরও, ইহুদি জায়োনিস্ট দানবের হাত থেকে আল কুদস বা জেরুজালেম পুনরুদ্ধারের লড়াইও সমগ্র মুসলিম বিশ্বের লড়াই। ফিলিস্তিনিদের ইন্তিফাদা মানে সমগ্র মুসলিম বিশ্বের ইন্তিফাদা! এক্ষেত্রে সমগ্র মুসলিম বিশ্ব সমানভাবে একাত্ম, ঐক্যবদ্ধ ও সক্রিয় কিনা সেটাই মূল বিষয়।
ধার্মিক হিন্দু রবীন্দ্রনাথ বনাম সেকুলারদের ফ্যালাসি!
-আরআর