সৈয়দ ফয়জুল আল আমীন
কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক
আবারও চরম অশান্ত হয়ে ওঠেছে পাহাড়ি এলাকা। রাঙ্গামাটির নানিয়ারচর উপজেলা চেয়ারম্যান শক্তিমান চাকমাকে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যার ২৪ ঘণ্টা পার হতে না হতেই প্রাণ গেছে পাঁচজনের।
গত ১৮ মার্চ রাঙ্গামাটিতে ইউপিডিএফ সমর্থিত হিল উইমেন্স ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক মন্টি চাকমা ও রাঙ্গামাটি শাখার সাধারণ সম্পাদক দয়াসোনা চাকমা অপহরণের ঘটনা সংঘাতে জড়িত দলগুলোর মধ্যে আরও প্রতিহিংসা তৈরি করে। ওই অপহরণের ঘটনায় ইউপিডিএফ-গণতান্ত্রিককে দায়ী করেছে হিল উইমেন্স ফেডারেশন।
এমনই উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে গত ১৫ এপ্রিল রাঙ্গামাটির বাঘাইছড়ি ও মারিশ্যা দীঘিনালার জোড়া ব্রিজ এলাকায় ইউপিডিএফের দুই নেতা তপন চাকমা (৪০) ও বিজয় চাকমাকে (৩২) গুলি করে হত্যা করা হয়।
এমন বাস্তবতায় বলা যায়, ৩ মে জেএসএস (এমএন লারমা) নেতা ও নানিয়ারচর উপজেলা চেয়ারম্যান শক্তিমান চাকমা এবং ৪ মে তার শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে যাওয়ার পথে আরও পাঁচজনকে হত্যার ঘটনায় তিন পার্বত্যাঞ্চলকে চূড়ান্ত অশান্তি ও অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিল। তাছাড়া এ ঘটনার পর থেকেই পার্বত্যাঞ্চলের সাধারণ পাহাড়ি ও বাঙালি অধিবাসীরা চরম উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠায় রয়েছেন বলে গণমাধ্যমে প্রকাশ।
পার্বত্য অঞ্চলের পারস্পরিক বিরোধ এবং এর ফলে সৃষ্ট সহিংসতা নতুন কোনো ঘটনা নয়। জমি নিয়ে বিরোধ ও আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টাই এ সহিংসতার মূল কারণ। এর আগে গত পাঁচ মাসে পার্বত্য অঞ্চলে বিভিন্ন সহিংসতার ঘটনায় ১৮ জন নিহত ও ১৫ জন আহত হয়েছিলেন। অপহরণের ঘটনাও ঘটেছে একাধিক।
১৯৯৭ সালে সরকার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মধ্যে পার্বত্য চুক্তির পর চুক্তির বিরোধিতা করে জন্ম নেওয়া ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ)। সেই থেকে দুই দলের বিরোধে ২০১৬ সাল পর্যন্ত সশস্ত্র সংঘাতে মারা গেছে প্রায় এক হাজার নেতাকর্মী। কিন্তু ২০১৬ সালে দুই দলের মধ্যে অলিখিত ও অপ্রকাশ্য এক চুক্তির ফলে সশস্ত্র সংঘাত বন্ধ হয়। ফলে স্বস্তির নিঃশ্বাস নেমে আসে পাহাড়ে।
তবে ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ২০ বছর পূর্তি উপলক্ষে রাজধানীতে এক আলোচনাসভায় পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় (সন্তু) লারমা চুক্তি বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রতার অভিযোগ এনে ‘পাহাড়ে আবার আগুন জ্বলবে’ বলে হুঁশিয়ারি দেন।
কাকতালীয়ভাবে তাঁর এ ঘোষণার মাত্র দুই দিন পর ৫ ডিসেম্বর অনাধি রঞ্জন চাকমা (৫৫) নামের এক ইউপিডিএফ সমর্থক ইউপি সদস্যকে হত্যা করা হয়। এ হত্যার জন্য ইউপিডিএফ-গণতান্ত্রিককে দায়ী করে ইউপিডিএফ।
পাহাড়ি এলাকার দ্বন্দ্ব-সংঘাত কেন্দ্রীভূত হয়েছে মূলত পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর দুটি দলের বিরোধে। জমি নিয়ে অবৈধ বাণিজ্য, আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা, চাঁদাবাজি ইত্যাদি জন্ম দিয়েছে এই বিরোধের। লক্ষ করা গেছে, পার্বত্য শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর এই চুক্তিকে অকার্যকর করার একটা অপচেষ্টাও চলছে।
পরপর দু’দফায় সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের পর এমন আশঙ্কাও দেখা দিয়েছে যে, পরিস্থিতির আরও অবনতি হতে পারে। সরকারকে বিষয়টি বিশেষ গুরুত্বসহকারে আমলে নিতে হবে। একজন উপজেলা চেয়ারম্যানকে গুলি করে হত্যার পরপরই আবারও কীভাবে ব্রাশফায়ারে পাঁচজনকে হত্যা ও আরও অনেককে আহত করা সম্ভব হলো, তা গভীর উদ্বেগের বিষয়।
তবে কি পাহাড়ি উত্তেজনার প্রশমন বলে কিছু নেই? পার্বত্য শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নে কী কী বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে, সেগুলো খতিয়ে দেখার প্রয়োজন রয়েছে বৈকি।
বলা যায়, পার্বত্য অঞ্চলের রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক বাস্তবতা দেশের অপরাপর অঞ্চলের চেয়ে ভিন্ন, ফলে এখানকার সংকটের চরিত্রও ভিন্ন। এ ভিন্ন পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য দরকার বিশেষ অন্তর্দৃষ্টি।
বিবদমান পক্ষগুলোর মধ্যে কীভাবে ঐকমত্য সৃষ্টি করা যায়, তা নিয়ে ভাবার যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে। ভবিষ্যতে পার্বত্য চট্টগ্রামে যাতে আর কোনো হত্যাকাণ্ড ও অপহরণের মতো ঘটনা সংঘটিত না হয় সে জন্য স্থানীয় প্রশাসন ও সরকারকে এ বিষয়ে আরও সোচ্চার থাকতে হবে।
[email protected]
৮ মে ২০১৮