আসাদুযযামান: মিরপুরে ঢাকা চিড়িয়াখানায় ঢোকার মুখেই ‘মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স’। দুই কদম ভেতরে গেলেই বাঁ দিকে পুলিশ ক্যাম্প।
সেখান থেকে ঢিল ছোড়া দূরত্বে বাঁশপট্টি বস্তি। এখানে দিনরাত চলছে মাদকের কারবার। স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, এভাবে পুলিশের নাকের ডগায় মাদক ব্যবসা হলেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না।
এভাবে প্রকাশ্যে মাদক ব্যবসা হচ্ছে কী করে, জানতে চাইলে শাহ আলী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আনোয়ার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘সেখানে ছোটখাটো মাদক থাকতে পারে।
তবে কাল থেকে সেখানে উঠান বৈঠক শুরু হবে। মাদক আর থাকবে না।’ গত দুই দিন মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্সে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে প্রায় ১৫ হাজার মানুষের বসবাস। সরু আঁকাবাঁকা পথের দুই পাশে আধা পাকা ও বাঁশের দেয়ালের ওপর টিনের ছাপরাঘর। পশ্চিম-দক্ষিণ কোণে রূপনগর থানার পুলিশ ক্যাম্প।
মুক্তিযোদ্ধা পুনর্বাসন কমপ্লেক্সের একজন দোকানি প্রথম আলোকে বলেন, বাঁশপট্টির ঝুপড়িতে প্রতিদিন সন্ধ্যার পর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত ইয়াবা কেনাবেচা ও গাঁজার আসর বসে। পরিবহনশ্রমিক ও পোশাক কারখানার শ্রমিকেরাই মূলত মাদকের ক্রেতা।
মাঝেমধ্যে পুলিশ এসে ইয়াবা, গাঁজাসহ দু-একজনকে আটক করলেও টাকা নিয়ে ছেড়ে দিয়ে যায়। এক তরুণ এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘বাবা লাগবে নাকি, পুরোনো লোক অইলে রাতে আইসেন।’
মাদক ব্যবসায়ীদের নিয়োগ করা এক যুবক প্রথম আলোকে বলেন, মাদক বিক্রি করার সঙ্গে জড়িত থাকায় স্ত্রী তাঁকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। তাই তিনি মাদক বিক্রির পথ থেকে সরে এসেছেন। তিনি বলেন, ঢাকা মহানগর উত্তরের ৯৩ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের একজন শীর্ষ নেতার তত্ত্বাবধানে ফারুক, আনু, জহির, নান্নু, নবীন, বাবুল ও ইমরান মুক্তিযোদ্ধা পুনর্বাসন কমপ্লেক্সে মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করেন।
এই আওয়ামী লীগের নেতা থানা-পুলিশ ম্যানেজ করেন। পুলিশ কাউকে আটক করলে তিনি ছাড়িয়ে আনেন। এ জন্য মাদক বিক্রির টাকার একটি অংশ তাঁকে দিতে হয়। তিনি বলেন, ওই আওয়ামী লীগ নেতা স্থানীয় সাংসদের লোক বলে তাঁকে সবাই ভয় পায়।
ইয়াবা বহনকারী ওই যুবক বলেন, দুই পন্থায় মাদক ব্যবসা হয়। ইয়াবা ব্যবসায়ীরা তাঁদের পরিচিত গ্রাহকদের চাহিদামতো ইয়াবা বাসায় পৌঁছে দেন। সে ক্ষেত্রে প্রতিটি ইয়াবার দাম নেওয়া হয় ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা। এ ছাড়া মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্সের ছোট্ট খুপরিতে রাতভর মাদক বেচাকেনা হয়। বাসায় বাসায় ইয়াবা পৌঁছানোর জন্য তাঁদের ১৫ জন লোক আছে।
তাদের প্রতিদিন ৫০০ টাকা করে দেওয়া হয়। তিনি বলেন, এভাবে প্রতিদিন আড়াই হাজার ইয়াবা বড়ি বেচাকেনা হয়। বাসায় বসে ইয়াবা কেনা ক্রেতাদের বেশির ভাগই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, চিকিৎসক, আইনজীবী ও ব্যবসায়ী।
মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্সের বাঁশপট্টিতে দৈনিক দুই-তিন হাজার ইয়াবা বড়ি বেচাকেনা হয় বলে তিনি জানান। অর্থাৎ এখান থেকে প্রতিদিন প্রায় পাঁচ হাজার ইয়াবা বড়ি বিক্রি হয়।
মিরপুর যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা শহীদ পরিবার পুনর্বাসন পল্লি কল্যাণ বহুমুখী সমবায় সমিতি লিমিটেডের সভাপতি সাইফুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, একবার ইয়াবা বিক্রির সময় নবীন নামের এক যুবককে ধরে গণধোলাই দেওয়ার পর পুলিশে সোপর্দ করা হয়েছিল। ইয়াবাসহ বাবুল নামের আরেক ব্যক্তি গ্রেপ্তার হওয়ার পর জামিনে বেরিয়ে এসেছিলেন। এই দুই ইয়াবা ব্যবসায়ী এখন কারাগারে।
সাইফুল ইসলাম বলেন, মুক্তিযোদ্ধা পুনর্বাসন কমপ্লেক্সে কারা মাদক ব্যবসা করছেন, তা শাহ আলী থানার পুলিশ জানে। প্রশাসন ইচ্ছা করলেই মাদক নির্মূল করতে পারে।
মিরপুর যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ পরিবার বাসস্থান কমপ্লেক্স বহুমুখী সমবায় সমিতি লিমিটেডের তৎকালীন সভাপতি আইয়ুব আলী খান রেজা মাদকবিরোধী প্রচারণা করেন।
তিনি গত শুক্রবার রাতে প্রথম আলোকে বলেন, মাদকের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ায় ২০৮ সালে তিনি হামলার শিকার হয়েছিলেন। এরপরও তিনি মাদক ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে শাহ আলী থানায় একের পর এক সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। তিনি বলেন, মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্সে মাদক ব্যবসা বন্ধ করতে হলে পুলিশকে তৎপর হতে হবে।
আরো পড়ুন- শ্রমজীবি সাহাবিদের গল্প