সৈয়দ ফয়জুল আল আমীন
কবি, কলামিস্ট ও সাংবাদিক
পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম কর্তৃক ‘তারেক রহমান বাংলাদেশের নাগরিকত্ব বর্জন করেছেন’-এমন মন্তব্যের পর রাজনৈতিক অঙ্গনে আবার উত্তেজনা দেখা দিয়েছে। গত ২১ এপ্রিল যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগ আয়োজিত অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী জানান, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বাংলাদেশের নাগরিকত্ব বর্জন করেছেন।
পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী যে ডকুমেন্টের (তথ্য) ভিত্তিতে তারেক রহমানের নাগরিকত্ব নিয়ে বক্তব্য দিয়েছেন, তা দৈনিক প্রকাশ করা হয়েছে। পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমের ফেসবুক পেইজে ওই তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে।
পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমকে লিগ্যাল নোটিশ পাঠিয়েছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। এছাড়া প্রতিমন্ত্রীর ওই বক্তব্য প্রকাশ করায় দুটি দৈনিকের বিরুদ্ধে লিগ্যাল নোটিশ পাঠানো হয়েছে।
২৩ এপ্রিল তারেক রহমানের পক্ষে বিএনপির আইনবিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল রেজিস্ট্রি ডাকযোগে প্রতিমন্ত্রী, দৈনিক কালের কণ্ঠ ও বাংলাদেশে প্রতিদিন পত্রিকার সম্পাদককে লিগ্যাল নোটিশ পাঠান। নোটিশে ব্যারিস্টার কায়সার কামাল বলেছেন, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে এ বক্তব্য রাখা হয়েছে।
রাজনৈতিকভাবে হেয় করতেই এ বক্তব্য, এটি সম্পূর্ণ মিথ্যা ও বানোয়াট বক্তব্য। ১০ দিনের মধ্যে বক্তব্য প্রত্যাহার করে জাতির কাছে প্রকাশ্যে ক্ষমা চাইতে হবে। অন্যথায় তাদের সবার বিরুদ্ধে দেওয়ানি ও ফৌজদারি মামলা করা হবে।
এদিকে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের পাসপোর্ট হাইকমিশনে জমার বিষয়ে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী যে উড়ো খবর দিয়েছেন, তার জন্য আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানিয়েছেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। সরকারের উদ্দেশে বিএনপির এ নেতা বলেন, আপনারা ক্ষমতায় আছেন, হাইকমিশন তো সরকারের নিয়ন্ত্রণে। তাহলে তারেক রহমান পাসপোর্ট জমা দিয়ে থাকলে সেটি প্রদর্শন করে সবাইকে দেখান। কই, সেটি তো পারলেন না।
অন্যদিকে তারেক রহমান বাংলাদেশের নাগরিকত্ব বর্জন করেননি বলে জানিয়েছেন তার আইনজীবী ব্যারিস্টার কায়সার কামাল। তিনি বলেন, লন্ডন, যুক্তরাষ্ট্র বা পশ্চিমা বিশ্বে কেউ অবৈধভাবে বসবাস করতে পারে না। চিকিৎসার জন্য তিনি বিগত ৯ বছর ধরে ব্রিটেনে আছেন এবং বৈধভাবেই তিনি তার পরিবার নিয়ে সেখানে অবস্থান করছেন।
বাংলাদেশের নাগরিকত্ব নিয়েই তিনি বৈধভাবে ব্রিটেনে বসবাস করছেন। তিনি বাংলাদেশে সর্ববৃহৎ একটি দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। অতএব, অন্য কোনো দেশের নাগরিকত্ব গ্রহণের প্রশ্নই আসে না। তিনি ওই দেশের অভিবাসন আইন অনুযায়ী বৈধভাবে ওখানে আছেন। চিকিৎসা শেষ হলে তিনি আবার দেশে ফিরে আসবেন।
প্রশ্ন হচ্ছে, পাসপোর্টের সঙ্গে নাগরিকত্বের কোনো সম্পর্ক আছে কি? না, থাকার কথা নয়। কারণ হিসেবে বলা যায়, পাসপোর্ট ছাড়া প্রচুর লোক বাংলাদেশে বাস করছে না? এটা কি তাদের বাংলাদেশি নাগরিক হওয়ার পথে বাধা? অবশ্যই না।
তবে যতটা জানা গেছে, তারেক রহমানের এখন কোনো পাসপোর্ট নেই। যে পাসপোর্ট ছিল সেটি ২০১৪ সালে জমা দিয়েছেন। এরপর নতুন করে পাসপোর্টের জন্য কোনো আবেদন করেননি। পাসপোর্ট ছাড়াই তিনি যুক্তরাজ্যে অবস্থান করছেন। কীভাবে অবস্থান করছেন সেটি যুক্তরাজ্যের সরকার জানে।
প্রসঙ্গত, তারেক রহমান ২০০৮ সালে বাংলাদেশ ত্যাগ করেন। তখন তার পাসপোর্ট ছিল হাতে লেখা, মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট ছিল না। মেয়াদ শেষ হওয়ার পর ২০১৪ সালে তিনি ওই পাসপোর্ট সারেন্ডার করেন। এখন নতুন পাসপোর্ট নিতে ন্যাশনাল আইডি কার্ড লাগবে। ন্যাশনাল আইডিকার্ড তার নেই। এটা নিতে হলে অবশ্যই দেশে আসতে হবে। তারেক রহমান দেশে আসতে চাইলে বাংলাদেশ এম্বাসির মাধ্যমে তাকে ট্র্যাভেল পাস নিতে হবে।
আবার একথাও সত্য, প্রচলিত আইন অনুযায়ী যুক্তরাজ্যে অবস্থানরত বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নাগরিকত্ব বাতিল করতে পারে সরকার। কিন্তু নাগরিকত্ব বাতিল করার আগে তারেক রহমানকে কারণ দর্শানো নোটিস দিতে হবে। নাগরিকত্ব বাতিল করা হলে প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী তাকে দেশে ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে জটিলতা তৈরি হবে না বলে আইনমন্ত্রী বলেছেন।
আইন অনুযায়ী অবশ্য তারেক রহমান নিজেও বাংলাদেশের নাগরিকত্ব বর্জন করতে পারেন। সে ক্ষেত্রে তাকে সরকারের নিকট লিখিত আবেদন করতে হবে। স্বয়ংক্রিয়ভাবে নাগরিকত্ব বাতিল বা বর্জনের সুযোগ নেই।
১৯৫১ সালের দ্য সিটিজেনসিপ অ্যাক্ট-এর ১৬ (৬) ধারা অনুযায়ী উভয়পক্ষের এ সুযোগ রয়েছে। আইনের ১৬ (৪) উপ-ধারায় বলা আছে কেউ যদি একটানা দেশের বাইরে অন্য কোনো দেশে বসবাস করে তা যদি সরকারি কোনো কাজ বা আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কাজ না হয় তবে সরকার সেই ব্যক্তির নাগরিকত্ব রহিত বা বাতিল করতে পারে। আবার ওই ব্যক্তি লিখিত আবেদনের মাধ্যমে নাগরিকত্ব বর্জন করতে পারেন।
তবে সরকার যদি নাগরিকত্ব থেকে অব্যাহতি দিতে চান সে ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে কারণ দর্শানো নোটিস দিতে হবে তথা আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিতে হবে।
বাস্তবতা যখন এই, তখন তারেক রহমানের নাগরিকত্ব আছে বা নেই-নিয়ে রাজনীতির মাঠ গরম করা কতটা যৌক্তিক হতে পারে?
[email protected]
২৮ এপ্রিল ২০১৮