সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪ ।। ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬


রানা প্লাজা ট্রাজেডি ও পোশাকশিল্পের নিরাপত্তাব্যবস্থা

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

সৈয়দ ফয়জুল আল আমীন
কবি, কলামিস্ট ও সাংবাদিক

রক্তের দাগ শুকালেও শুকায়নি চোখের পানি। ভয়াল সেই রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির পঞ্চম বার্ষিকী ছিল গতকাল মঙ্গলবার। চার বছর আগে ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল প্রতিদিনের মতো সকাল ৮টার দিকে সাভারের রানা প্লাজার নয়তলা বিশিষ্ট ভবনে থাকা পাঁচটি পোশাক কারখানায় শ্রমিকরা প্রবেশ করেন। তারা কেউই জানতেন না কী ভয়াবহ পরিণতি তাদের জন্য অপেক্ষা করছে!

হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে যায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই সকাল আনুমানিক পৌনে নয়টায় একযোগে চালু করা হয় ওই ভবনে থাকা ডজন খানেক জেনারেটর। জেনারেটর চালু করার কিছুক্ষণের মধ্যেই বিকট আওয়াজে ধসে পড়ে ভবনটি। ভবনের ধ্বংসস্তুপ থেকে একে একে বের করা হয় ১ হাজার ১৩৬ জন শ্রমিকের লাশ।

সেদিন জাতি দেখেছে ইতিহাসে বিবর্জিত এক কালো অধ্যায়, দেখেছে হাজারও লাশের স্তুপ। স্ত্রী হারিয়েছেন স্বামীকে, স্বামী হারিয়েছেন স্ত্রীকে, ভাইকে ফেরত না পাওয়ার বেদনায় কাতর বোন, বোনের লাশের প্রতীক্ষায় ভাই, সন্তানের মৃত্যু শোকে ব্যাকুল মা-বাবা।

দুঃখজনক হলেও সত্য, ভয়াবহ ওই দুর্ঘটনার পাঁচ বছর পার হলেও দায়ের করা মামলাগুলোর কোনো অগ্রগতি নেই। নির্মম পঙ্গুত্ব বরণ করা শ্রমিকরা সুবিচার পাওয়ার আশায় থাকলেও ৫ বছরে অভিযুক্তদের বিচারে তেমন কোনো অগ্রগতি নেই।

অবহেলাজনিত মৃত্যু ও ইমারত নির্মাণ আইনে দায়ের করা দুই মামলাসহ ১৮টি মামলা বিভিন্ন আদালতে বিচারাধীন। যার মধ্যে জেলা ও দায়রা জজ আদালতে ২টা, যুগ্ম জেলা দায়রা জজ আদালতে ১টা, শ্রম আদালতে ১১টা আর হাইকোর্টে চারটা মামলা।

আইনজীবীরা বলছেন, সরকারি বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে সমন্বয়ের অভাবে মামলাগুলো গতি পায়নি। ‘অবহেলা ও ত্রুটিজনিত হত্যা’ মামলায় ভবনের মালিক সোহেল রানাসহ ৪১ জন আসামির মধ্যে আবু বক্কর সিদ্দিক ও আবুল হোসেন নামে দুইজন মারা গেছেন। তাদের বাদ দিয়ে ৩৯ জন আসামির মধ্যে ৭ জন পলাতক রয়েছেন। বাকিরা সবাই জামিনে মুক্ত। মামলাটিতে সাক্ষী আছেন ৫৯৪ জন।

কোন অদৃশ্য ইশারায় বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম এই শিল্প দুর্ঘটনার বিচারকাজ থমকে আছে? এত বড় একটা ট্র্যাজেডির মামলা নিষ্পত্তি করতে বিশেষ কোনো তৎপরতা যে দেখছি না। সরকারের বিভিন্ন আচরণে মনে হচ্ছে তারা আসামিদের বাঁচানোর চেষ্টা করছে। ভয়াবহ ওই দুর্ঘটনার পর থেকে সচেতন মহল পোশাক শিল্পে নিরাপদ কর্ম পরিবেশ তৈরির দাবি জানিয়ে আসলেও সরকার সেটাও এখনো পুরোপুরিভাবে তৈরি করতে পারেনি!

প্রকৃতঅর্থে, দেশের তৈরি পোশাকশিল্পের নিরাপত্তাব্যবস্থা কতটা দুর্বল, তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিল সাভারে রানা প্লাজা ধস। কিন্তু এখনো পোশাকশিল্পের নিরাপত্তার গলায় কাঁটা হয়ে আছে ১ হাজার ৪৬৩ কারখানা। ওই দেড় হাজার কারখানার মধ্যে জাতীয় ত্রিপক্ষীয় কর্মপরিকল্পনার (এনটিএপি) অধীনের পরিদর্শন কার্যক্রমে ৮০৯ পোশাক কারখানার অগ্নি, বৈদ্যুতিক ও কাঠামোগত ত্রুটি চিহ্নিত হয়েছে।

তবে ত্রুটিগুলো সংস্কারে কারখানার মালিকেরা গড়িমসি করছেন। ফলে দুই বছরের বেশি সময় পার হলেও মাত্র ২৭ শতাংশ ত্রুটি সংশোধনকাজ শেষ হয়েছে। অন্যদিকে ৬৫৪ কারখানাকে পরিদর্শন কার্যক্রমের আওতায় আনা সম্ভব হয়নি। পোশাকশিল্পের মালিকদের দুই সংগঠন বিজিএমইএ ও বিকেএমইএর সদস্য না হওয়ায় এই কারখানাগুলোর দায়দায়িত্ব কেউই নিচ্ছে না। সব মিলিয়ে তৈরি পোশাকশিল্পের নিরাপত্তাব্যবস্থায় এখনো বড় রকমের ত্রুটি রয়ে গেছে।

অবশ্য ব্যবসা হারানোর ভয় থাকায় ক্রেতাদের দুই জোট অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্সের অধীনে থাকা ২ হাজার ২৯৫ কারখানার ত্রুটি সংশোধনকাজে ভালো অগ্রগতি হয়েছে। গত জানুয়ারি পর্যন্ত ইউরোপীয় ক্রেতাদের জোট অ্যাকর্ডের সদস্য ১ হাজার ৬৩১ কারখানার অগ্নি, বৈদ্যুতিক ও কাঠামোগত ত্রুটির ৮৩ শতাংশ সংশোধন কাজ শেষ। তার মধ্যে ৬৯৯ কারখানার ত্রুটির সংশোধন কাজ সম্পন্ন হয়েছে ৯০ শতাংশ।

অন্যদিকে উত্তর আমেরিকার ক্রেতাদের জোট অ্যালায়েন্সের ৬৬৪ কারখানার ত্রুটির ৮৯ শতাংশ সংশোধনকাজ শেষ করেছেন পোশাকশিল্পের মালিকেরা।

রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় নিহত শ্রমিক পরিবার ও আহত ব্যক্তিদের ক্ষতিপূরণ দিতে গঠিত হয় রানা প্লাজা ডোনারস ট্রাস্ট ফান্ড। তহবিলের অর্থ থেকে ভুক্তভোগী ৩ হাজার ১২০ জনকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়। তাতে সর্বোচ্চ একজন নিহতের পরিবারের সদস্যরা পান ৭৮ লাখ টাকা। ২৫ লাখ টাকা করে পান ৬১ নিহত শ্রমিকের পরিবার। নিহত শ্রমিকের পরিবার সর্বনিম্ন হলেও ১০ লাখ টাকা করে পেয়েছেন। আহত শ্রমিকেরাও বিভিন্ন অঙ্কের অর্থ পান।

এদিকে সাভারে ভবন ধসের ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের বিশেষ ব্যবস্থায় ক্ষতিপূরণ দেওয়া হলেও সেটিকে আইনি কাঠামোতে আনা যায়নি। রানা প্লাজা ধসের পরপরই আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক), বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্টসহ (ব্লাস্ট) কয়েকটি মানবাধিকার সংগঠন হাইকোর্টে চারটি রিট আবেদন করে।

একই সঙ্গে ক্ষতিপূরণের বিষয়ে আদালত স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে একটি রুল দেন। রুল শুনানির একপর্যায়ে উচ্চ আদালত বলেন, রানা প্লাজা ধসের ঘটনা কোনো দুর্ঘটনা নয়, অপরাধ। এ জন্য আইন অনুসারে দোষীদের যেমন ফৌজদারি অপরাধের বিচার হতে হবে, তেমনি দোষীদের অপরাধের জন্য ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।

তখন রানা প্লাজা ধসে ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতির মাত্রা ও ক্ষতিপূরণের হার নির্ধারণ করতে আদালত একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠনের নির্দেশনা দেন। ২০১৩ সালের আগস্টে ১৪ সদস্যের বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা হয়। সেই কমিটি ক্ষতিপূরণের হার নির্ধারণ করে ২০১৫ সালের এপ্রিলে একটি প্রতিবেদন আদালতে জমা দেয়। এতে বলা হয়, ভবন ধসের ঘটনায় নিহত, নিখোঁজ শ্রমিকের পরিবার ও স্থায়ীভাবে পঙ্গু হওয়া শ্রমিকের ক্ষতিপূরণ সাড়ে ১৪ লাখ এবং আহত শ্রমিক পাবেন দেড় লাখ থেকে সাড়ে সাত লাখ টাকা।

তবে বিজিএমইএ শুরু থেকেই এটির বিপক্ষে অবস্থান নেয় বলে অভিযোগ রয়েছে। যদিও এর কারণ আজও প্রকাশ হয়নি।

[email protected]
২৫ এপ্রিল ২০১৮


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ