আওয়ার ইসলাম : বাংলাদেশে জঙ্গি হামলার সবচেয়ে বড় আঘাত হয়েছে গুলশানে হলি আর্টিজানে। ভয়াবহ এ সন্ত্রাসী হামলা গোটা বিশ্ব দেখেছে। একসঙ্গে এত সংখ্যক বিদেশি হত্যার মাধ্যমে দেশের সার্বিক অর্থনীতির ওপর আঘাত হানার একটা চেষ্টা হয়েছিল। হামলা করে যাতে সরকারের পতন ঘটানো যায় সে ধরনের একটা ভ্রান্ত ধারণা ছিল জঙ্গিদের।
এ ধরনের ঘটনার পর বাংলাদেশ যেভাবে ঘুরে দাঁড়িয়েছে তা বিশ্ব দরবারে প্রশংসিত হয়েছে। বিশ্ব নতুন এক বাংলাদেশ দেখছে। পুলিশ সদর দফতরের এডিশনাল ডিআইজি (ইন্টেলিজেন্স অ্যান্ড স্পেশাল অ্যাফেয়ার্স) মো. মনিরুজ্জামানের জঙ্গি সংক্রান্ত একটি গবেষণা প্রতিবেদনে এমনই তথ্য পাওয়া গেছে।
হলি আর্টিজান আক্রমণ স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশে জঙ্গিদের সবচেয়ে বড় আক্রমণ বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। ঢাকার অত্যন্ত অভিজাত এলাকা গুলশানে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বিদেশি নাগরিক ও সম্ভ্রান্ত বাংলাদেশিরা বসবাস করেন। এখানে এ ধরনের হামলায় দেশি-বিদেশি মিডিয়া দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
বিশেষত যখন দেশের সামগ্রিক জিডিপির বাৎসরিক গড় বৃদ্ধির হার কমবেশি ৭.০ এর ওপরে, সে অবস্থায় এ আক্রমণ বাংলাদেশের উদীয়মান অর্থনীতি ও বিদেশি বিনিয়োগের ওপর অত্যন্ত নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছিল। এমনকি বিদেশি নাগরিকদের ওপর হামলায় বাংলাদেশে বিভিন্ন উন্নয়নমূলক মেগা প্রজেক্টে কর্মরত বিদেশি কনসালটেন্ট ও বিদেশি পেশাজীবীদের মধ্যে ভীতি ও নিরাপত্তাহীনতা তৈরি হয়েছিল।
এ ছাড়া আক্রমণ পরবর্তী সময়ে আমাক নিউজ এজেন্সির বরাতে আইএস কর্তৃক ঘটনার দায় স্বীকার এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে রেস্টুরেন্টের ভেতরে বিদেশি নাগরিকদের লাশের ছবি প্রকাশ, বিদেশি মিডিয়াতে বাংলাদেশ সম্পর্কে একটি বিভ্রান্তিকর চিত্র উপস্থাপন হয়। পরবর্তী সময়ে পুলিশি তদন্তে প্রমাণিত হয় যে, উক্ত হামলায় অংশগ্রহণকারী জঙ্গিদের সঙ্গে আইএসের কোনো সম্পৃক্ততা ছিল না।
সামগ্রিকভাবেই হলি আর্টিজান আক্রমণ বাংলাদেশের উদীয়মান অর্থনীতি, ক্রমবর্ধমান উন্নয়ন ও সার্বিক অগ্রগতির ওপর ছিল এক ধরনের বিশাল আঘাত। এ হামলার পর পরই সরকার নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করে। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ হলো সরকারপ্রধান কর্তৃক জঙ্গিবাদ সংক্রান্ত জিরো টলারেন্স নীতি ঘোষণা। এ ঘোষণার মাধ্যমে দ্বিধাহীন চিত্রে প্রধানমন্ত্রী ও তার সরকারের জঙ্গিদের বিরুদ্ধে অটল নীতি ঘোষিত হয়।
এই ঘোষণার মধ্য দিয়ে সব ধরনের জঙ্গিবাদ এবং জঙ্গি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বাংলাদেশ সরকারের দৃঢ় অবস্থান সুস্পষ্ট হয় বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
গবেষণা প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, জঙ্গিবাদ আজ যে কোনো দেশের ভৌগোলিক সীমা অতিক্রম করে একটি সার্বজনীন সমস্যা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। শুধুমাত্র যে কোনো দেশের ভৌগোলিক অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ও আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ করে জঙ্গিবাদ পুরোপুরি দমন সম্ভব নয়। কেননা তথ্য প্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত পৃথিবী আজ গ্লোবাল ভিলেজে পরিণত হয়েছে।
ফলে জঙ্গিবাদ দমনে পুলিশিং অতীতের যে কোনো সময় থেকে অনেক বেশি চ্যালেঞ্জিং হয়ে পড়েছে। এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ পুলিশ গত বছরের মার্চ মাসে দক্ষিণ এশিয়া ও প্রতিবেশী দেশগুলোর পুলিশ প্রধানদের সমন্বয়ে চিফ অব পুলিশ কনফারেন্স আয়োজন করে। এতে মূল এজেন্ডা ছিল জঙ্গিবাদ এবং ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম দমনে পারস্পরিক সাহায্য সহযোগিতার ক্ষেত্র সম্প্রসারিত করা। ওই কনফারেন্স শেষে অংশগ্রহণকারী দেশগুলো প্রতিনিধিদের সম্মতিতে এবং স্বাক্ষরে ঘোষিত হয় ‘ঢাকা ডিক্লারেশন’।
ঢাকা ডিক্লারেশনের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট ছিল, জঙ্গিবাদ দমনে অংশগ্রহণকারী দেশগুলোর মধ্যে পারস্পরিক যোগাযোগ বৃদ্ধি এবং জঙ্গিবাদ দমনে একটি সামগ্রিক কৌশলগত পরিকল্পনা গ্রহণ। ইতিমধ্যে ঢাকা ডিক্লারেশন নিয়ে ব্যাপক সাফল্য পেয়েছে বাংলাদেশ। বিশেষ করে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশ পুলিশের কর্মকর্তাদের আগের চেয়ে এখন বেশি করে আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে।
এই আমন্ত্রণের মূল বিষয়বস্তু হচ্ছে, কীভাবে বাংলাদেশ পুলিশ আভিযানিক তৎপরতা এবং গোয়েন্দা কৌশলের মাধ্যমে জঙ্গিদের দমন করছে, সে বিষয়ে শিক্ষা গ্রহণ। এরই মধ্যে আমেরিকা, ভারত কানাডা, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, মালদ্বীপ, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, জর্ডান ও চায়নাসহ আরো কয়েকটি দেশ বাংলাদেশ পুলিশকে আমন্ত্রণ জানিয়ে জঙ্গি দমনের কৌশল নিয়ে শিক্ষা গ্রহণ করেছে।
এর ফলে জঙ্গি দমনে নতুন এক বাংলাদেশ দেখছে বিশ্ব।
প্রতিবেদনে বলা হয়, জঙ্গিবাদ মোকাবিলা যাবতীয় কার্যক্রম মূলত দুটি ভাগে বিভক্ত ছিল। একটি ছিল সফট পর্যায় যার অংশ হিসেবে আইন প্রণয়ন, সংগঠন নিষিদ্ধ করা, ওয়াজ নসিহত করা, মানববন্ধন, জনসচেতনতা, জিরো টলারেন্স নীতি ঘোষণা এবং জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে সামাজিক জনসচেতনতা তৈরি, আলেমদের ফতোয়া এগুলো ছিল উল্লেখযোগ্য। জঙ্গিবাদ দমনে বাংলাদেশ পুলিশ টাফ পুলিশিংয়ের সিদ্ধান্ত নেয়।
এই টাফ এবং ইন্টেলিজেন্স পুলিশিংয়ের সমন্বয়েই দেশে পরিচালিত হয় ইন্টেলিজেন্স লেড সিরিজ অব অপারেশন্স।
পুলিশ সদর দফতরের এডিশনাল ডিআইজি (ইন্টেলিজেন্স অ্যান্ড স্পেশাল অ্যাফেয়ার্স) মো. মনিরুজ্জামানের জঙ্গিবাদ সংক্রান্ত গবেষণা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ২০১২ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশকে বিশেষ করে বাংলাদেশ পুলিশকে একটি চরম অস্বাভাবিক পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হয়।
রাজনৈতিক কর্মসূচির নামে নৈরাজ্য, নাশকতা, রেললাইন উপড়ে ফেলা, গাড়িতে অগ্নিসংযোগ, জীবন্ত অগ্নিদগ্ধ মানুষ এসব হয়ে দাঁড়ায় নিত্যদিনের ঘটনা। ঢাকাসহ বড় বড় শহর ছাড়িয়ে এটিকে ছড়িয়ে দেয়া হয় রাজপথ, রেলপথ, জেলা, উপজেলা এমনকি গ্রাম পর্যায়েও। সেই ভয়াবহ পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে গিয়ে পুলিশ এবং অন্যান্য সহায়তাকারী বাহিনীকে চরম ব্যস্ত থাকতে হয়।
দেশের শৃঙ্খলা ও জননিরাপত্তা নিশ্চিত করতে গিয়ে ১৭ পুলিশ সদস্যকে নিজেদের জীবন পর্যন্ত দিতে হয়। গুরুতর আহত হন সহস্রাধিক পুলিশ সদস্য। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ঠিক রাখতে গিয়ে পুলিশের অন্যান্য রুটিন কাজে ঘাটতি দেখা যায়।
পুলিশের নজরদারি ও আভিযানিক ঘাটতিসহ বিবিধ কাজে একটি ক্রিটিকাল পরিস্থিতিতে জঙ্গি ও তাদের মদদদাতারা কিছুটা অনুকূল পরিবেশ পেয়ে সংঘটিত হতে থাকে। অস্ত্র, অর্থ ও রিক্রুটমেন্টের পুরনো লিঙ্কগুলো সচল করে। জেএমবি, হিজবুত তাহরীর, এবিটিসহ অন্যান্য পথ ও পথের জঙ্গিরা ক্রমশ একক লক্ষ্য নিয়ে রিক্রুটমেন্ট, প্রশিক্ষণ, প্রপাগান্ডা, অর্থ ও অস্ত্র সংগ্রহসহ নানাবিধ কাজ করতে থাকে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, জঙ্গিবাদ মোকাবিলা একটি বিশেষায়িত কাজ। এ কাজটি সব পুলিশ সদস্য করেন না বা করতে পারেন না। পুলিশের বিশেষায়িত ইউনিটের দক্ষ, চৌকস, মেধাবী, উদ্যমী এবং ভিন্ন মাত্রায় ডেডিকেটেড অফিসারদের দিয়ে এ কাজটি করানো হয়ে থাকে। নৈরাজ্য নাশকতার ব্যপ্তি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে পুলিশের প্রায়োরিটিও পরিবর্তিত হয়ে যায়।
সবচেয়ে দক্ষ ও ডেডিকেটেড ও কমিটেড কর্মকর্তাদের তখন রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলায় রুটিন কাজে ব্যবহার করা শুরু হয়। এমনি এক জটিল পরিস্থিতিতে জঙ্গিরা কিছুটা ভিন্ন কৌশলে আবারো তাদের পুরনো পথে ফিরে আসে। শুরু হয় ব্লগারদের নাম ঘোষণা করে টার্গেট কিলিং।
জঙ্গিরা প্রস্তুত করে হিট লিস্ট। যেই হিট লিস্টে জঙ্গিরা টার্গেট করে ব্লগার, নন মুসলিম, দেশি-বিদেশি নাগরিক, অন্যান্য ধর্মাবলম্বী ও ধর্মগুরু। এমনকি আলেমদেরও জঙ্গিরা টার্গেট ঘোষণা করেই ক্ষান্ত হয়নি, একে একে সেগুলো এক্সজিকিউট শুরু করে।
ফলশ্রুতিতে ব্লগার রাজিব হায়দার হত্যা, ব্লগার ও লেখক অভিজিৎ রায় হত্যা, ব্লগার অনন্ত বিজয়, নিলাদ্রি নিলয়, ওয়াশিকুর রহমান বাবু, প্রকাশক ফয়সাল আরেফিন দীপন, সমকামীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন কর্মী জুলহাজ মান্নান হত্যা সংঘটিত হয়।
এসব হত্যায় নেতৃত্ব দেয় আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের (এবিটি) কিলাররা। এ ছাড়া একই সময়ে নব্য জেএমবি ৩৫টি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যভিত্তিক হত্যাকাণ্ড ও আক্রমণ চালায়। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য রংপুরে হোশি কুনিও হত্যা, ঢাকার এএসআই ইব্রাহীম হত্যা, ঢাকার হোসেনি দালানে হামলা, ইতালীয় নাগরিক ড. পায়েরো পারোলারিকে হত্যার চেষ্টা, বগুড়া শিয়া মসজিদে হামলা, দিনাজপুরে ঐতিহাসিক কান্তজির মেলায় হামলা, রাজশাহীতে আহমদীয়া মসজিদে হামলা, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে রেজাউল করিম হত্যা উল্লেখযোগ্য।
প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যভিত্তিক হত্যাকাণ্ড ও আক্রমণের মূল উদ্দেশ্য ছিল দেশে ভীতি ও নিরাপত্তাহীনতার পরিবেশ সৃষ্টি করা এবং সামগ্রিকভাবে দেশকে অস্থিতিশীল করে তোলা। জঙ্গিগোষ্ঠী উক্ত হত্যাকাণ্ডসমূহের মধ্য দিয়ে নিজেদের আইএসের সহযোগী সংগঠন হিসেবে দাবি করে, যা পরবর্তী সময়ে পুলিশি তদন্ত শেষে অসত্য ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে প্রমাণিত হয়।
এদিকে সরকারপ্রধানের ঘোষণার আলোকে জঙ্গিবাদ দমনে বিশেষায়িত কিছু ইউনিট প্রতিষ্ঠিত হয়। হলি আর্টিজানের ঘটনার পরে বিভিন্ন ইউনিটের চৌকস অফিসারদের সমন্বয়ে এসটিজি (স্পেশাল টাক্স ফোর্স) গঠিত হয়, যা জঙ্গিবাদ দমনে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখে। পরবর্তী সময়ে সুনির্দিষ্ট গোয়েন্দা তথ্যভিত্তিক মোট ৪০টি জঙ্গিবিরোধী অভিযান বাংলাদেশ পুলিশ সম্পন্ন করে।
গবেষণা প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, জঙ্গিবাদ দমনে গৃহীত পদক্ষেপের মধ্যে সব থেকে স্বতন্ত্র বিষয় হলো কমিউনিটি সম্পৃক্তকরণ কার্যক্রম। এককভাবে পুলিশের পক্ষে জঙ্গিবাদ দমন অসম্ভব। বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর সরকারি অংশগ্রহণ ছাড়া এ জাতীয় সামাজিক সমস্যা মোকাবিলা করা দুরূহ। এই বিবেচনা থেকেই জঙ্গিবাদ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির অন্যতম নিয়ামক ধরা হয়েছে কমিউনিটি পুলিশিং কার্যক্রম।
কমিউনিটি পুলিশিং কার্যক্রম বাংলাদেশ পুলিশের একটি বহুমাত্রিক জনসম্পৃক্তকরণ কর্মসূচি। জঙ্গিবাদের স্বরূপ ও মানসিকতা বিশ্লেষণে কমিউনিটির নির্বাচিত অংশ যেমনÑ ধর্মীয় সম্প্রদায় ও নেতৃবৃন্দ, ইসলামিক স্কলার, আলেম-ওলামা, শিক্ষক ও শিক্ষা সংশ্লিষ্ট নীতি নির্ধারক, মিডিয়া, ছাত্র-জনতাকে নানা প্লাটফর্মে একত্রিত করে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে একটি অর্থপূর্ণ জনসচেতনতা ও দুর্ণিবার গণপ্রতিরোধ গড়ে তোলা সম্ভব হয়েছে। এ কার্যক্রম সমন্বয় করা হচ্ছে পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স থেকে।
পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সের সাবেক কনফিডেন্সিয়াল শাখা বর্তমান ইন্টেলিজেন্স অ্যান্ড স্পেশাল এ্যাফেয়ার্স উইং এ কার্যক্রমের সমন্বয় করেছে। এ কার্যক্রমের অংশ হিসেবে সব ধর্মীয় নেতৃবৃন্দের সমন্বয়ে ধর্মীয় সম্প্রীতি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। যেখানে বাংলাদেশের নেতৃস্থানীয় সব ধর্মীয় নেতারা অংশগ্রহণ করেন। এ সম্মেলনে ধর্মের নামে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে সব ধর্মীয় নেতারা একাত্মতা ঘোষণা করেন এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন যে, স্ব স্ব ধর্মীয় ব্যাখ্যার মাধ্যমে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে ব্যাপক জনসচেতনতা গড়ে তোলা হবে।
এরই আলোকে মাওলানা ফরিদ উদ্দিন মাসুদের তত্ত্বাবধানে দেশের শীর্ষস্থানীয় এক লাখ আলেম ইসলামের দৃষ্টিতে জঙ্গিবাদ নিষিদ্ধ মর্মে একটি ঘোষণা দেন। বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে এটি ব্যাপকভাবে আলোচিত ও প্রশংসিত হয়।
এদিকে পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সের ইন্টেলিজেন্স উইং কর্তৃক জঙ্গি কার্যক্রমে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেফতারকৃতদের নিয়ে একটি সমীক্ষা চালানো হয়। ২৫০ জন গ্রেফতার জঙ্গি সদস্যদের তথ্য পর্যালোচনায় জানা যায় যে, অধিকাংশ জঙ্গিদের বয়সের সীমা ১৫ বছর থেকে ৩৫ বছর। তাদের সিংহভাগ রাজশাহী ও রংপুর বিভাগ থেকে আসা। বেশিরভাগের আয়সীমা প্রতিমাসে সর্বোচ্চ আট হাজার টাকা।
মাদরাসা এবং মূল ধারা শিক্ষা ব্যবস্থা (বাংলা মাধ্যম) হতে তারা এসেছে। বেশিরভাগ জঙ্গি ব্যক্তিগত এবং পারিবারিক কারণবশত তীব্রভাবে হতাশ ছিল। কিন্তু তাদের বেশিরভাগের কোনো পূর্ববর্তী অপরাধী ইতিহাস ছিল না। মোটিভেশনের একপর্যায় তারা নিজেদের জীবন বিসর্জন দিতেও রাজি। বেহেশতে যাওয়ার শটকার্ট রাস্তাই তাদের মোটিভেশনের মূল উৎস।
তারা মনে করে সমাজের সিংহভাগ এবং নিশ্চুপ অংশ তাদের খিলাফত আন্দোলনের নীরব সমর্থক এবং পরিশেষে এই আন্দোলনে যোগ দেবে। বাস্তবে কিন্তু তাদের কোনো সামাজিক সমর্থন নেই। অপর এক সমীক্ষায় দেখা যায় ৮২ শতাংশ জঙ্গির সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অ্যাকাউন্ট আছে। ৮০ ভাগ জঙ্গি সাংগঠনিক অভ্যন্তরীণ যোগাযোগের জন্য বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম অ্যাপস ব্যবহার করে। যেমন থ্রিমা, উই চ্যাট, উই সিকিউর, টেলিগ্রাম, পিটি ইত্যাদি।
সামগ্রিকভাবে ৮২ শতাংশ জঙ্গির জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হওয়ার পেছনে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ারকৃত বিভিন্ন অডিও, ভিডিও পুস্তক প্রভৃতি মূল ভূমিকা পালন করেছে।
এ ছাড়া, জঙ্গিদের মডাস অপারেন্ডিতে বিশাল পরিবর্তন সূচিত হয়েছে। তথ্য প্রযুক্তির উন্নতির পাশাপাশি তারা গতানুগতিক অস্ত্র, বোমার পরিবর্তে অত্যাধুনিক আইইডি, আধুনিক অস্ত্র (একে-২২ রাইফেল, একে-২২ এসএমজি, ৭.৬৫ এমএম পিস্তল), এক্সক্লুসিভ জেল, ডেটোনেটর ও হাতে বানানো গ্রেনেড ব্যবহার করছে।
জঙ্গিরা বর্তমানে ব্যাপকহারে আইইডি ব্যবহার করছে, কেননা এটি সহজলভ্য, দামে সস্তা ও সহজে বহনযোগ্য
প্রতিবেদন প্রসঙ্গে ঊর্ধ্বতন গোয়েন্দা কর্মকর্তা মো. মনিরুজ্জামান বলেন, বাংলাদেশ পুলিশ কর্তৃক পরিচালিত জঙ্গিবিরোধী অভিযানগুলোর প্রতিটি বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। পুলিশের নিজস্ব সুনির্দিষ্ট গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে সুনিপুণভাবে পরিচালিত এসব অভিযান শতভাগ সফল।
এসব অভিযান পরিচালনাকালে দেশের প্রচলিত আইন ও বিধি, মানবাধিকার, আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত মানদণ্ডসমূহ প্রতিপালিত হয়েছে। জঙ্গি আস্তানাসমূহে অভিযানকালে আশপাশের নাগরিকদের নিরাপত্তাকে সর্বাগ্রে বিবেচনা করা হয়েছে। এজন্যই এসব অভিযানে সারকামস্টেশিয়াল ক্যাজুয়ালটি শূন্যের কোঠায়। সাধারণ নাগরিক এমনকি জঙ্গি আস্তানায় অবস্থানরত নারী ও শিশুদের রক্ষায় আভিযানিক দল নিজেদের ব্যক্তি নিরাপত্তাকে অনিশ্চিত জেনেও তাদের অক্ষত অবস্থায় উদ্ধারে নিজেদের জীবনের ওপর যে ঝুঁকি নিয়েছেন তা বাংলাদেশ পুলিশকে নিয়ে গেছে মানবিক পুলিশিংয়ের এক অনন্য উচ্চতায়।
তিনি বলেন, প্যারিস বোস্টন ছাড়াও বিশ্বের অসংখ্য অভিযান পর্যালোচনা করে দেখা যায় যে, কোনো অভিযানে হামলাকারী বা তার সহযোগী আত্মসমর্পণ করেছে বলে এমন কোনো নজির নেই। শুধুমাত্র বাংলাদেশ পুলিশ জঙ্গিদের আত্মসমর্পণে রাজি করাতে সক্ষম হয়েছে। আমাদের পুলিশের এই সাফল্য ও সক্ষমতা ভিনদেশের গোয়েন্দাদের কাছে স্বীকৃতি পেয়েছে। আলোচনার মাধ্যমে জঙ্গিদের আত্মসমর্পণে রাজি করানো আধুনিক বিশ্বের জঙ্গিবাদ প্রতিরোধ কার্যক্রমে সবচেয়ে স্বপ্নের বিষয়বস্তু।
বাংলাদেশ ছাড়া বিশ্বের অন্য কোথাও এটি সম্ভব হয়েছে বলে এমন উল্লেখ করার মতো তথ্য নেই। এটি বাংলাদেশ পুলিশের একটি ইউনিক অর্জন। মারাত্মক অস্ত্রসজ্জিত সংগঠিত জঙ্গিদের আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে আত্মসমর্পণে রাজি করানো সারা বিশ্বের জঙ্গিবাদ নিয়ে কাজ করা পুলিশের জন্য একটি স্বপ্ন। এ স্বপ্ন ছুঁতে পারা একটি ল্যান্ড মার্ক।
প্রতিবেদনে আরো উল্লেখ করা হয়েছে, ঢাকার আশকোনায় ‘অপারেশন রিপল-২৪’ অভিযানটি বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। ঝুঁকির দিক বিবেচনা করে জঙ্গি দমন অপারেশন সাধারণত অস্ত্র ও গোলাবারুদ দিয়ে করা হয়ে থাকে। প্যারিস, বোস্টন, গুলশান ও কল্যাণপুরে এই পদ্ধতির প্রয়োগ দেখা যায়। ‘অপারেশন রিপল-২৪’ জঙ্গি অপারেশন পরিচালানার ক্ষেত্রে একটি ব্যতিক্রমী উদাহরণ।
দীর্ঘ প্রায় ১৬ ঘণ্টাব্যাপী পরিচালিত অভিযানে পুলিশ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে জঙ্গিদের কাছে গিয়ে আগ্নেয়াস্ত্র সমর্পণে উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করে। যেসব কারণে এই অভিযানটি জঙ্গি দমনে বিশেষ অপারেশন হিসেবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে স্বীকৃতি পেয়েছে। উদাহরণের প্রয়োগ দেখা যায় যশোরের জঙ্গি অভিযান চলাকালীন যেখানে জঙ্গি আস্তানার ভেতরে একজন নারী জঙ্গি তার দুই কন্যা এবং এক পুত্রসহ অবস্থান করছিলেন।
অভিযান পরিচালনাকারী পুলিশের ইউনিটসমূহ সমঝোতার মাধ্যমে আত্মসমর্পণের নীতি প্রয়োগ করে ও বলপ্রয়োগ ব্যতীত আত্মসমর্পণের সব প্রচেষ্টা চালায়। পরে উক্ত নারী জঙ্গি তার সন্তানদের নিয়ে বিনা শর্তে আত্মসমর্পণে রাজি হয়। গবেষণায় বলা হয়, জঙ্গিবাদ মোকাবিলায় বাংলাদেশ সরকার বহুমাত্রিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। এ সংশ্লিষ্ট দেশি-বিদেশি বিশ্লেষকদের মতে, বাংলাদেশ সঠিক পথেই আছে।
জঙ্গিবাদ মোকাবিলায় রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের এবং বাহিনী হিসেবে বাংলাদেশ পুলিশের সাফল্য আজ বিশ্ববিদিত। জঙ্গিবাদ মোকাবিলায় বাংলাদেশ পুলিশের সাফল্য পরীক্ষিত। এ কাজে আরো কিছু বিনিয়োগ দরকার বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ আছে। বলা হয়েছে, বাংলাদেশ পুলিশ দেশে-বিদেশে সবচেয়ে অল্প পয়সায় জাতিকে সবচেয়ে বেশি আউটপুট দেয়।
এখনো এ দেশে জনপ্রতি জননিরাপত্তা ব্যয় ৭০০/- (সাতশ’) টাকা যা উন্নত বিশ্ব তো বটেই সমঅর্থনীতির দেশের চেয়েও অনেক কম। তবে জঙ্গিবাদ নিয়ন্ত্রণে সরকার সত্যিকারের আন্তরিকতা থেকেই নানামুখী উদ্যোগ নিয়েছে। নতুন বিশেষায়িত ইউনিট গঠন, প্রশিক্ষণ ও সরঞ্জামের ব্যবস্থার গ্রহণ উল্লেখ করার মতো। বাংলাদেশ পুলিশ অর্থনৈতিক তথ্য-উপাত্তের মধ্যে ইতিমধ্যেই প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে পুলিশের জন্য বরাদ্দ ব্যয় নয় এটি বিনিয়োগ।
এসএস
সূত্র : মানবকণ্ঠ