সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪ ।। ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬


ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ে গ্রাহকের তথ্য কতটা নিরাপদ?

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

সৈয়দ ফয়জুল আল আমীন
কবি, গবেষক ও সাংবাদিক

তথ্যপ্রযুক্তির আশীর্বাদে গোটা ব্যাংকিং খাত এখন হাতের মুঠোয়। অনলাইন সেবায় সাধারণ ব্যাংকিং পরিবর্তিত হয়েছে ‘ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ে’। আলোচনার বিষয় হচ্ছে, ব্যাংকিং সেবা আজ গ্রাহকের দোড়গোড়ায় পৌঁছালেও ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ে যে দিন দিন তথ্য নিরাপত্তা ঝুঁকি বেড়েই চলেছে।

বিশেষ করে সম্প্রতি এটিএম বুথে ‘স্কিমিং ডিভাইস’ বসিয়ে ব্যাংকের ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ড ক্লোনিং করে অর্থ আত্মসাতের একাধিক ঘটনায় গ্রাহকদের মধ্যে এ উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে। এছাড়া মোবাইল ব্যাংকিংয়ে সিম ডুপ্লিকেট, ক্লোনিং, ব্লুক, কল ডাইভার্ট করে প্রতারক চক্র অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে বলেও অভিযোগ ওঠেছে। প্রশ্ন হচ্ছে, এসব ঘটনায় ব্যাংক-কর্মকর্তাদের সংশ্লিষ্টতা ও অদক্ষতা রয়েছে কি? যদি থেকে থাকে তো কার্যকর কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে?

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট (বিআইবিএম)-এর এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের ব্যাংকগুলোর ৫২ শতাংশই তথ্য নিরাপত্তা ঝুঁকিতে রয়েছে। যার মধ্যে ১৬ শতাংশ খুবই উচ্চ নিরাপত্তা ঝুঁকিতে এবং ৩৬ শতাংশ উচ্চ নিরাপত্তা ঝুঁকিতে রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির পৃথক এক গবেষণায় বলা হয়েছে, তথ্যপ্রযুক্তি নিরাপত্তা সম্পর্কে ৫০ শতাংশ ব্যাংক কর্মকর্তাই অজ্ঞ। যার মধ্যে ২৮ শতাংশ খুবই অজ্ঞ এবং ২২ শতাংশ কিছুটা কম অজ্ঞ। এ ছাড়া সামান্য ধারণা রয়েছে ২০ শতাংশ কর্মকর্তার। আর এমন বাস্তবতায় গ্রাহকদের ব্যাংক হিসাব কতটা নিরাপদ?

প্রসঙ্গত, বাংলাদেশের ৫৭টি ব্যাংকে প্রায় ২ লাখ কর্মকর্তা রয়েছে। গ্রাহকদের মধ্যেও একই জরিপ চালিয়েছে বিআইবিএম। এতে দেখা গেছে, ৫৪ শতাংশ গ্রাহক সাইবার নিরাপত্তা সম্পর্কে অজ্ঞ।

গণমাধ্যমে প্রকাশ, দেশে ৫৭টি ব্যাংকের প্রায় ১০ হাজারের অধিক শাখা এবং প্রায় ৭ হাজার ৩০০ এটিএম বুথ রয়েছে। এগুলোর মাধ্যমে গ্রাহকরা অনলাইনে লেনদেন করছেন। একই সাথে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের অ্যাকাউন্ট রয়েছে প্রায় ছয় কোটি। ফলে ব্যাংকিং খাতের একটি বড় অংশই চলে গেছে অনলাইনের সেবায়। এভাবেই গত এক দশকে ‘ডিজিটাল ব্যাংকিং’ ব্যবস্থা পরিবর্তিত হয়েছে। অবশ্য ব্যাংকিং খাতকে ডিজিটাল করতে কাড়ি কাড়ি অর্থ খরচ করতে হয়েছে। কিন্তু যথাযথ সুফল মিলছে কি?

বেসরকারি ও বিদেশি ব্যাংকগুলোর প্রায় সব শাখা ইতিমধ্যে প্রযুক্তিনির্ভর হওয়ায় জালিয়াতির ঘটনাও আশঙ্কাজনক হাওে বেড়েছে বলেও শোনা যাচ্ছে। বিশেষ করে ঋণ জালিয়াতি ও চেক জালিয়াতির ঘটনা বেড়েছে। অবশ্য এর আগে মোবাইল ব্যাংকিং ও ইন্টারনেট ব্যাংকিংয়ে জালিয়াতির ঘটনা ঘটলেও গ্রাহকদের মাঝে তেমন আতঙ্ক দেখা দেয়নি। কিন্তু ২০১৬ সালে এটিএম বুথে স্কিমিং ডিভাইস বসিয়ে ক্রেডিট কার্ড ক্লোন করে অর্থ লোপাটের ঘটনায় আতঙ্কিত হয়ে পড়েন গ্রাহকরা।

দুই বছর পার না হতেই চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে। খোয়া যায় ৪৯ গ্রাহকের ২০ লাখ টাকা। অবশ্য এসব ঘটনায় প্রযুক্তিগত নিরাপত্তার পাশাপাশি ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের জড়িত থাকার বিষয়টি বেরিয়ে আসে।

এ ঘটনার পর এটিএম বুথে জালিয়াতি প্রতিরোধে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে বেশ কয়েকটি নির্দেশনা জারি করা হয়। বলা হয়, এক মাসের মধ্যে চুরি প্রতিরোধক অ্যান্টি স্কিমিং ও পিন শিল্ড ডিভাইস স্থাপন, স্বয়ংক্রিয় এসএমএসের মাধ্যমে লেনদেনের তথ্য প্রদান করতে হবে। কিন্তু বেশিরভাগ ব্যাংক এত দিনেও কার্যকর করেনি এমন উদ্যোগ।

২০১৬ সালে সংঘটিত বাংলাদেশের ব্যাংকিং ইতিহাসে আলোচিত বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ চুরির ঘটনার তদন্ত এবং অর্থ উদ্ধারÑকোনোটারই ইতি টানতে পারেনি কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ ঘটনার পেছনে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তাদের প্রযুক্তিগত গাফিলতি এবং সংশ্লিষ্টতা ছিল বলে তথ্য দিয়েছে দেশি-বিদেশি গণমাধ্যম।

যতদূর জানা যায়, ব্যাংকে প্রত্যেক কর্মকর্তার জন্য একটি করে কম্পিউটার নির্ধারিত রয়েছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ছাড়া তার পাসওয়ার্ড অন্য কারও পক্ষে জানা অসম্ভব। তাই ব্যাংক কর্মকর্তারা এ বিষয়ে সচেতন হলে অপরাধ খুব সহজে ঘটানো সম্ভব নয়। তবুও গত পাঁচ বছরে অপরাধ যে হারে বেড়েছে, তাতে প্রযুক্তির উদ্ভাবন ও হালনাগাদের পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদেরও আপডেট হওয়া জরুরি নয় কি?

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টর (বিআইবিএম) এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৬ শতাংশ ব্যাংক মনে করে তাদের বর্তমান তথ্য নিরাপত্তা যথেষ্ট নয়। তারা খুবই উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে। ৩৬ শতাংশ ব্যাংক মনে করে, যে কোনো মুহূর্তে তাদের তথ্য চুরি হতে পারে। এ ছাড়া ৩২ শতাংশ ব্যাংক কিছুটা কম ঝুঁকিতে রয়েছে। তবে ১২ শতাংশ ব্যাংক কম ঝুঁকিতে রয়েছে। আর ৪ শতাংশ মনে করছে তথ্যপ্রযুক্তিতে তাদের ব্যাংক কোনো ঝুঁকিতে নেই।

এক্ষেত্রে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, আমাদের ব্যাংকগুলো দেশীয় সফটওয়্যার ব্যবহার না করে অহেতুক বিদেশি সফটওয়্যারের দিকে ঝুঁকছে। ব্যাংকের অর্থে অহেতুক বিদেশ ভ্রমণ কিংবা অন্যকোনো লাভের আশায় ব্যাংকের কিছু কর্মকর্তারা এ কাজ করছেন। এছাড়া ব্যাংকগুলোর কল সেন্টারের অবস্থাও খারাপ। গ্রাহকের সেবার মান বাড়াতে এ অবস্থার পরিবর্তন দরকার।

[email protected]
২২ এপ্রিল ২০১৮


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ