সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪ ।। ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬


মহামারি ধর্ষণের শিকার শিশুরাও: নিরাপত্তার দায়ভার কার?

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

সৈয়দ ফয়জুল আল আমীন
কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক

গণমাধ্যমে প্রকাশ, পাঁচ বছর বয়সী এক শিশুকে ধর্ষণের অভিযোগে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ক্যান্টিনের পরিচালককে আটক করেছে পুলিশ। ১৯ এপ্রিল রাত সাড়ে ৮টার দিকে ক্যান্টিনের ভেতরে পরিচালক মো. আমিনুর (৫৬) শিশুটিকে ধর্ষণ করে বলে অভিযোগ করেছে কলেজ কর্তৃপক্ষ। এ ঘটনায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ মামলা করেছে।

এ ব্যাপারে ফরিদপুর কোতোয়ালি থানার ওসি এফএম নাছিম গণমাধ্যমকে জানান, পাঁচ বছর বয়সী শিশুটিকে ধর্ষণের অভিযোগে আমিনুর নামে একজনকে আটক করেছি। বিষয়টি তদন্ত চলছে। তদন্তের পরেই আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

কলেজের অধ্যক্ষ খবিরুল ইসলামের ভাষ্যমতে, শিশুটির মা ক্যান্টিনে কাজ করেন। প্রতিদিনের মতো সেদিনও শিশুটি মায়ের সঙ্গে সেখানে আসে। সন্ধ্যার পর প্রচণ্ড ঝড়-বৃষ্টি হওয়ায় ক্যান্টিনে লোকজন ছিল না। এই সুযোগে পরিচালক আমিনুর শিশুটিকে ধর্ষণ করে। পরে তার চিৎকারে এক ইন্টার্ন চিকিৎসক এগিয়ে গেলে আমিন পালানো চেষ্টা করলে লোকজন তাকে ধরে পুলিশে দেয়। প্রশ্ন হচ্ছে, মায়ের সাথেও যদি শিশু নিরাপদে থাকতে না পারে, তাহলে শিশুর নিরাপত্তা কোথায়?

সম্প্রতি প্রকাশিত বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের তথ্য বলছে, চলতি বছরের জানুয়ারি-মার্চ-এই তিন মাসে ১৭৬টি শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে ৫৫টি করে এবং মার্চ মাসে ৬৬টি শিশু ধর্ষণের ঘটনা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। অর্থাৎ প্রতি মাসে গড়ে ৫৫টির বেশি শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে, যা আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় অনেক বেশি!

১৫টি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত শিশু অধিকার লঙ্ঘনের সংবাদ পর্যবেক্ষণ এবং বিশ্লেষণ করে বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরাম এ তথ্য দিয়েছে। তথ্য বলছে, তিন মাসে ধর্ষণের শিকার ১৭৬টি শিশুর মধ্যে ২০টি শিশুই গণধর্ষণের শিকার হয়। আটজন প্রতিবন্ধী শিশু ধর্ষণের শিকার হয়। তিন মাসে ২৫ শিশুকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয় এবং তিনটি শিশু ধর্ষণের পর আত্মহত্যা করেছে। এ ছাড়া ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে ২১টি শিশুকে।

তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে, গত বছরের তিন মাসের চেয়ে শিশু ধর্ষণ বেড়েছে ১৮ শতাংশ। ধর্ষণের পর শিশুহত্যা বেড়েছে ১০০ শতাংশ।

এ ধরনের অপরাধের শিকার হচ্ছে অনেক শিশু। সৎবাবা, আপন চাচা, মামা, এমনকি আপন ভাই ও জন্মদাতা পিতা দ্বারাও শিশু ধর্ষণের শিকার হওয়ার খবর প্রকাশিত হচ্ছে পত্রিকায়। আবার অনেক অপরাধ পারিবারিক মান-সম্মানের দোহাই দিয়ে চেপে রাখা হচ্ছে চারদেয়ালের ভিতরে। ইনসেস্ট বা অজাচার বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই ঘৃণিত ও নিষিদ্ধ। আর তা যদি হয় শিশুর প্রতি তা হলে সেটা মানবিকতার ভয়াবহ বিপর্যয়।

এমন বাস্তবতায় প্রশ্ন, শিশুরা কি কোথাও নিরাপদ নয়? কিন্তু কেন? আমরা কি ভুলতে বসেছি যে, ফুল ও শিশুকে যারা ভালোবাসে না তারা অমানুষ অথবা মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন। নিজের শিশু সন্তান তো বটেই, অন্যের এমনকি জীবনের দুশমন হলেও তার শিশুসন্তানের প্রতি কেউ প্রতিশোধপরায়ণ হতে পারে না, যার সামান্যতম মানবতাবোধ থাকে। মানুষ তো বটেই, কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া পশুপাখিও নিজের সন্তানকে জীবনের বিনিময়ে হলেও রক্ষার চেষ্টা করে। এটাই হচ্ছে প্রকৃতির নিয়ম। মায়া, মমতা, সহানুভূতি এসব গুণ মহান আল্লাহ্ই দিয়েছেন তাঁর বান্দাদের।

একটি শিশু যদি নিজের ঘরে আপন আত্মীয় এমনকি আপন বাবার কাছে নিরাপত্তা না পায় তা হলে কোথায় সে নিরাপত্তা পাবে? কিছুদিন আগে সৎবাবার ধর্ষণের শিকার এক তরুণী পুলিশের কাছে অভিযোগ করে। পুলিশি তদন্তে তার অভিযোগের সত্যতাও পাওয়া যায়। জানা যায়, মেয়েটির সৎবাবা আরমান হোসেন মেয়েটি সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় থেকে দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে তাকে ধর্ষণ ও নির্যাতন করে আসছিল। এমনকি আপন বাবা কর্তৃক শিশুকন্যা ধর্ষণের খবরও সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে।

কিছুদিন আগের কথা, নিউইয়র্কের বাংলাদেশি কমিউনিটিতেও এমনই ঘৃণিত ঘটনা ঘটেছে। আপন বাবার ধর্ষণের শিকার হয়েছে একটি শিশু। সে অনেক দিন ধরেই নির্যাতনের শিকার হচ্ছিল। কিন্তু মাকে বারবার সে কথা বললেও মা তার কথা বিশ্বাস করেনি। অবশেষে স্কুল কর্তৃপক্ষের উদ্যোগে বিষয়টি প্রকাশ হয়। নিউইয়র্কের বাংলাদেশি কমিউনিটিতে আরেকটি ছেলে শিশুও বাবার যৌন হয়রানির শিকার হয়েছে। অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় ঘৃণিত ব্যক্তিটির শাস্তিও হয়েছে।

একজন আদর্শ ও চরিত্রবান শিশু একটি সুস্থ-সুন্দর সমাজ উপহার দিতে পারে। শিশুরা দেশের ভবিষ্যৎ জনশক্তি, আজকের শিশু আগামী দিনের নাগরিক এবং দেশের কর্ণধার। যে শিশু আগামীর নাগরিক, সে শিশুর জীবন যদি অরক্ষিত হয়ে যায় তবে আমাদের গোটা সমাজই বিপন্ন হয়ে পড়বে।

তাই কন্যা কিংবা ছেলে- যে কোনো শিশুকে বাঁচাতে হবে সকল প্রকার নির্যাতন থেকে। শিশুর জন্য বাইরের বিশ্ব তো বটেই সবার আগে ঘরকে করতে হবে নিরাপদ। মাকে শুনতে হবে শিশু কী বলতে চায়। শুধু অভিযোগ শুনলেই হবে না, সে বিষয়ে দ্রুত ব্যবস্থাও নিতে হবে। হয়তো এই দ্রুততার ওপর শিশুর জীবনও নির্ভর করতে পারে। আর আইনকেও এ বিষয়ে হতে হবে কঠোর।

[email protected]
২১ এপ্রিল ২০১৮


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ