আতাউর রহমান খসরু
মুসলিম সমাজের পবিত্রতম মাস রমজান সমাগত। সাধারণ মুসলমানের জীবনে রমজানে পরকালীন সমৃদ্ধি অর্জনের মাস হলেও কোনো কোনো অসাধু ব্যবসায়ী রমজানকে গ্রহণ করেন জাগতিক সমৃদ্ধির মাস হিসেবে।
তারা রমজানে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য বাড়িয়ে হাতিয়ে নেন বাড়তি টাকা। অন্যদিকে রমজান এলেই সাধারণ মানুষ হিমশিম খান সংসার চালাতে।
রমজানে দ্রব্যমূল্য বাড়া এখন বাংলাদেশের সাধারণ রীতিতে পরিণত হয়েছে। প্রতিবছর রমজানের একমাস আগ থেকেই নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বাড়তে থাকে। যা অপরিবর্তিত থাকে পরবর্তী কয়েক মাস পর্যন্ত।
সরকার প্রতি বছর রমজান সামনে রেখে বিপুল পরিমাণ ভোগ্যপণ্য আমদানি এবং বারবার বাজার দর নিয়ন্ত্রণ করার ঘোষণা দিলেও অজানা কারণে তা সম্ভব হয় না।
এ বছরও সরকারের বাণিজ্য ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় রজমানে ভোগ্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণের ঘোষণা দিয়েছেন। বাণিজ্যমন্ত্রী বলেছেন, রমজানের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ ভোগ্যপণ্য মজুদ আছে। তাই রমজানে পণ্যের দাম বাড়বে না।
রমজানে ভোগ্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণ বিষয়ক একটি পরামর্শ সভাও করেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল।
সভায় ব্যবসায়ী নেতারা দাবি করেছেন রমজানে পুলিশ ও দলীয় নেতারা চাঁদাবাজি বন্ধ করলে পণ্যের দাম স্বাভাবিক রাখা সম্ভব।
অন্যদিকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, ব্যবসায়ীরা সৎ হলে পুলিশ চাঁদাবাজির সুযোগ পাবে না।
উভয়পক্ষের আলোচনা থেকেই রমজানে ভোগ্যপণ্যের দামবৃদ্ধির কারণ সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়।
রমজান শুরু হওয়ার এখনও প্রায় এক মাস বাকি। বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যাচ্ছে এখনি বাজারে ভোগ্যপণ্যের দাম চড়তে শুরু করেছে।
প্রতিবেদক আজ নিজেও ঢাকার উত্তরা ও সাভারের একাধিক বাজারে যেয়ে বিষয়টির সত্যতা খুঁজে পেয়েছে। যেমন ডিমের হালিতে বেড়েছে ৫ টাকা, ছোলাতে ১০ টাকা ও চিনিতে ৫টাকা।
খুচরা দোকানদার ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের দাবি পাইকার ও আড়ৎদাররাই রমজানের আগেই পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেন। এ ক্ষেত্রে তাদের খুব বেশি কিছু করার নেই।
ব্যবসায়ীরা ব্যাপক চাঁদাবাজিরও অভিযোগ করেন। তাদের দাবি, আড়ৎ থেকে মাল কেনার পর দোকানে উঠানোর আগ পর্যন্ত রাস্তার পুলিশ থেকে শুরু করে কয়েক স্তরে তাদের চাঁদা পরিশোধ করতে হয়। আর তা প্রভাব পরে পণ্যের উপর।
তাহলে কি তারা রমজানে বাড়তি ব্যবসা করেন না? অবশ্যই করেন। তবে পণ্য বেশি বিক্রি হওয়ায় যে লাভ হয় ততোটুকু।
ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও দোকানদাররা পাইকারদের উপর দোষ চাপালেও গণমাধ্যমের দাবি ছোট-বড় সব ব্যবসায়ীই তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী রমজানের দুই থেকে তিন আগ থেকে পণ্য গুদামজাত করা শুরু করেন। ফলে রমজানের আগে বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি হয়।
নতুবা সরকারি ও বেসরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী বাংলাদেশের বাজারে ভোগ্যপণ্যের সরবারহে কোনো ঘাটতি নেই।
বাংলাদেশে রমজান আসলেই ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়ানোর এ প্রবণতা কেনো তৈরি হয়?
দৈনিক ইনকিলাবের সিনিয়র সহ-সম্পাদক ও চিন্তাবিদ আলেম মাওলানা উবায়দুর রহমান খান নদভি মনে করেন, মূল্য বৃদ্ধি করা বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের একটি মানসিক ব্যাধি। তারা মনে করে এক মাস ব্যবসা করে বড় লোক হয়ে যাবে।
অথচ সৎভাবে ব্যবসা করলেও অল্পতে বরকত হয়। বিশ্বের অন্য কোথাও রমজান মাসে পণ্যের দাম বাড়ে না। বরং মুসলিম বিশ্বের সবখানে রমজানে পণ্যের দাম কমানো হয়।
তিনি বলেন, আমাদের দেশের অধিকাংশ ব্যবসায়ী মুসলিম। অথচ তারা জানে না সুলভ মূল্যে পণ্য বিক্রি করে রোজদারকে সাহায্য করা ইবাদত। ব্যবসা করাই একটি ইবাদত। কারণ, এতে মানুষের কাছে পণ্য পৌঁছে।
ব্যবসায়ীরা এমন মানসিক ব্যাধিতে আক্রান্ত কেনো? মুসলিম হয়েও তারা কেনো পণ্যের দাম বাড়িয়ে মানুষকে কষ্টের মধ্যে ফেলে? আলেম এ সাংবাদিক মনে করেন, এসব ব্যবসায়ীদের দীনী শিক্ষার অভাব রয়েছে।
তারা আসলেও বোঝেন না তারা যা করছেন তা ধর্ম ও নৈতিকতার জায়গা থেকে অনুচিৎ।
ব্যবসায়ীরা দীন শেখে জুমার বয়ান, ওয়াজ-মাহফিল ও তাবলিগে যেয়ে। আর এসব জায়গায় তাদের এ শিক্ষা দেয়া হয় না। তারা ইসলাম বলতে যা জানে তাতে পণ্যের মূল্য ঠিক রাখার বিষয়টি নেই।
মাওলানা উবায়দুর রহমান খান নদভির মতে বাংলাদেশের সরকার বাজার নিয়ন্ত্রণে আন্তরিক নয়। দেশে এখন প্রয়োজনের চেয়ে বেশি পুলিশ সদস্য রয়েছে। প্রতিটি মহল্লায় মহল্লায় র্যাব টহল দিচ্ছে। তাহলে সরকার কেনো বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না?
আমি মনে করি, কোনো কিছুতেই বর্তমান সরকারের নিয়ন্ত্রণ নেই। তিনি প্রশ্ন ছুড়ে দেন, এই সরকারের বয়স ৯ বছর। সরকার কি বলতে পারবে কোনো রমজানে পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে ছিলো?
তাই বলা যায় হয়তো সরকারের আন্তরিকতা নেই অথবা তার দক্ষতার অভাব আছে।
তিনি আরও বলেন, সরকারের উচিৎ ছিলো পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণ করা। মুসলমান হিসেবে সরকার ও ব্যবসায়ী সবার দায়িত্ব রমজানে পণ্যের দাম সহনীয় পর্যায়ে রাখা।
তিনি রমজানে পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে সরকারকে হটলাইন চালু করার পরামর্শ দেন।
রমজানে পণ্যের দাম কমানোর বিষয়ে আওয়ার ইসলামের ভিডিওটি দেখুন
রজমানে পণ্যের দাম বাড়ানোর শরয়ি বিধান কি তা জানতে চেয়েছিলাম বসুন্ধরা ইসলামিক রিসার্চ সেন্টারের প্রধান মুফতি এনামুল হাসানের কাছে।
তিনি বলেন, ইসলাম মানুষকে পণ্য বিক্রি করে লাভ করার অনুমতি দিয়েছে। কিন্তু বাড়াবাড়ি রকমের লাভ করতে নিষেধ করেছে। এটা সারা বছরের কথা। আর রমজানের মতো পবিত্র একটি মাসে পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেয়া মানবিক ও শরয়ি উভয় দৃষ্টি থেকে নিন্দনীয়।
কারণ, পণ্যের দাম অসহনীয় পর্যায়ে বাড়িয়ে দেয়া হলে তা রোজাদারের জন্য কষ্টের কারণ হয়। তারা সংসারের ব্যয় মেটাতে হিমশিম খায়।
মুফতি এনাম মনে করেন, ‘ব্যবসায়ীদের মধ্যে দীনী শিক্ষা ও তাকওয়া সৃষ্টির মাধ্যমে এ সমস্যার সমাধান সম্ভব। ব্যবসায়ীদের বোঝাতে হবে ব্যবসা জান্নাত লাভের মাধ্যম হতে পারে। আর দীনী শিক্ষা বিস্তারের দায়িত্ব নিতে হবে সরকারকেই।’
তার মতে পণ্যের দাম বেঁধে দেয়া ইসলামের দৃষ্টিতে প্রসংশনীয় কিছু নয়।
তিরমিজি শরিফের হাদিসে এসেছে, রাসুল সা. এর যুগে একবার পণ্যের দাম বেড়ে গেলে সাহাবায়ে কেরাম রা. মূল্য নির্ধারণ করে দেয়ার দাবি করেন। কিন্তু রাসুল সা. তা অস্বীকার করেন।
তিনি বলেন, আল্লাহ তায়ালা তোমাদের একজনের মাধ্যমে অন্যজনের রিজিকের ব্যবস্থা করেন। এছাড়াও নানান কারণে একজন ব্যবসায়ীর খরচ সাধারণ খরচের চেয়ে বেশি পড়তে পারে।
তবে সরকারকে খেয়াল রাখতে হবে ব্যবসায়ীরা কোনো অসৎ পদ্ধতি অবলম্বন করছে কিনা? চক্র তৈরি করে মূল্য বৃদ্ধি করছে কিনা?
প্রতিবেদক সাভার হেমায়েতপুর বাজারে কয়েকজন সাধারণ ক্রেতার সঙ্গে কথা বলে জানতে পারেন ক্রেতারা আসন্ন রমজানে ভোগ্যপণ্যের দাম নিয়ে চিন্তিত। কারণ, রমজানে ব্যবসায়ীদের আয় বাড়লেও সাধারণ চাকরিজীবী মানুষের আয় বাড়ে না।
সরকারি চাকরিতে ঈদ বোনাসের ব্যবস্থা থাকলেও তা নেই অধিকাংশ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। তাই রমজানের খরচ তারা কিভাবে সামলাবেন তা নিয়ে যথেষ্ট চিন্তার কারণ রয়েছে।
রমজানে ভোগ্যপণ্যের মূল্য বাড়ার পেছনে কে দায়ী এমন প্রশ্নের উত্তরে ভোক্তাদের প্রায় সবাই বলেছেন, সরকারের সঙ্গে ব্যবসায়ীদের গোপন আঁতাতই পণ্যের মূল্য বৃদ্ধির কারণ। না হলে সরকার আন্তরিক হলে অবশ্যই পণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
রমজানের খবর যে ব্যক্তি আগে দেবে তার জন্য কি জাহান্নাম হারাম?
-আরআর