সৈয়দ ফয়জুল আল আমীন
কবি, গবেষক ও সাংবাদিক
আমাদের দেশে সড়কপথে প্রতিদিনই কিছু দুর্ঘটনা ঘটে থাকে। নানা কারণে যানজটও বেড়ে উঠেছে বিভিন্ন সড়ক ও মহাসড়কে। নিরাপত্তাহীনতা আর যানজটের ঝক্কি এড়াতে যাত্রীদের এক বড় অংশ তাই ট্রেনে যাত্রা করেন। সড়কপথের ওপর চাপ কমাতে ট্রেনযাত্রায় উৎসাহ জোগাতে বিভিন্ন সময় আমরাও পরামর্শ দিয়ে থাকি। এ লক্ষ্যে সরকারের পক্ষ থেকেও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
এমন বাস্তবতায়, ১৫ এপ্রিল টঙ্গী রেলওয়ে জংশনের অদূরে সংঘটিত হয়েছে এক দুর্ঘটনা। আর এই দুর্ঘটনার কারণ নিয়ে শোনা যাচ্ছে বিভিন্ন বক্তব্য। অবশ্য যথাযথ তদন্ত ছাড়া তা খুঁজে বের করা যে কঠিন-এই কথাও সত্য। শোনা যাচ্ছে, ইতিমধ্যেএ লক্ষ্যে তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে।
প্রকাশিত একাধিক সংবাদ প্রতিবেদনে প্রতীয়মান ওই দুর্ঘটনার পর এক ধরনের ভীতি সৃষ্টি হয়েছে যাত্রীদের মধ্যে। এটা ভালোভাবে দূর করা না গেলে এর চাপ গিয়ে পড়বে ওই দিক থেকে ঢাকায় প্রবেশের সড়কে। এজন্য চাইব, যাত্রীদের ভীতি দূর করার ব্যাপারে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া হয় যেন।
গাজীপুর ও এর আশেপাশের এলাকা থেকে সকালে রাজধানীতে এসে অফিস ধরার জন্য অনেক চাকরিজীবীই নির্ভর করেন ওই রুটে চলা ট্রেনের ওপর। দুর্ঘটনার কারণে সময়সূচিতে বিপর্যয় ঘটলে তাদের একাংশকে পড়তে হয় চরম ভোগান্তিতে। বিশেষ করে কমলাপুর থেকে জয়দেবপুর পর্যন্ত কোথাও ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটলে নারায়ণগঞ্জ ছাড়া রেলযোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে সারা দেশের সঙ্গে। যে কারণে রেলপথের এই অংশে দুর্ঘটনা এড়াতে বাড়তি সতর্কতা প্রয়োজন বলে মনে করি।
বাংলাদেশ রেলওয়ের তথ্যমতে, এরই মধ্যে ওই স্টেশনের আগে ও পরে সংকেত ব্যবস্থা স্বয়ংক্রিয় করা হয়েছে। এ ব্যবস্থায় কোনো ত্রুটি থাকলে ট্রেন চলার কথা নয় বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। এ অবস্থায় ভুল সংকেতের কারণে ট্রেনটি কীভাবে দুর্ঘটনায় পতিত হলো, সেটিও এক বড় প্রশ্ন।
খবরে প্রকাশ, শনিবার (১৪ এপ্রিল) রাতেও একই স্থানে দুর্ঘটনায় পড়েছিল আরেকটি ট্রেন। বড় ধরনের ক্ষতি না হলেও তাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ট্রেনের কিছু যন্ত্রপাতি। একই স্থানে পরপর দুদিন ট্রেন দুর্ঘটনাকে নিছক ‘দুর্ঘটনা’ হিসেবে দেখার উপায় আছে কি? তাই রেলপথের ওই অংশে বিশেষ কোনো কারিগরি ত্রুটি রয়েছে কি না- তা খতিয়ে দেখা জরুরি। তেমন ত্রুটি পরিলক্ষিত হলে সেটা দ্রুত সারানোর ব্যাপারে পদক্ষেপ নিতে হবে যাত্রী নিরাপত্তার স্বার্থেই।
এদিকে সরকারি পরিবহন রেল এখন যাত্রীদের মরণ বাহনে পরিণত হয়েছে বলেও অনেকের অভিযোগ। নিরাপত্তার এ বাহনটি কি না এখন চরম আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে রেলযাত্রীরা জান ও মাল নিয়ে চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। বাংলাদেশ রেলে চোর, ডাকাত, ছিনতাইকারী ও হত্যাকারীদের আনাগোনা বেড়েছে।
দেশের সকল সড়ক-মহাসড়কের যাত্রীদের নিরাপত্তা দেওয়ার দায়িত্ব সরকারের। হাইওয়ে পুলিশ ছাড়াও বিভিন্ন থানার টহল পুলিশ সড়কে পাহারা দেয়। তবুও প্রায়ই বাস-মিনিবাসে ডাকাতির ঘটনা ঘটে। কিন্তু বাস ডাকাতির ক্ষেত্রে যাত্রীদের হত্যা করার ঘটনা তুলনামূলক কম ঘটে থাকে। দেশের সকল সড়কপথে সার্বক্ষণিক পুলিশি পাহারা দেওয়া সম্ভব হয় না। এ কারণে ডাকাত দল ফাঁকা রোডে বাসে হানা দেয়। লুটে নেয় যাত্রীদের সর্বস্ব। কিন্তু ট্রেন সরকারি সম্পত্তি। রেলওয়ের জন্য আলাদা পুলিশ বাহিনী রয়েছে। তবে পুলিশ সদস্য সংখ্যা পর্যাপ্ত নয়। খাতা-কলমে যা আছে তার সবাই কর্মরত থাকেন না। নেই আধুনিক সরঞ্জামাদি।
এমনিতেই ট্রেন নানা কারণে লোকসান গুনে থাকে। তার ওপর যাত্রীদের জান-মালের নিরাপত্তা না থাকলে রেলযাত্রীর সংখ্যা কমতে থাকবে। আতঙ্কগ্রস্ত যাত্রীরা ট্রেন পরিহার করবে। এতে ট্রেন আরও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাই ট্রেনযাত্রীদের নিরাপদ-নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকারকে এখনই কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। গুরুত্বপূর্ণ রুট ও ট্রেনের প্রতিটি বগিতে কমপক্ষে দু'জন সশস্ত্র সদস্য নিয়োগ করতে হবে। এজন্য পুলিশ সদস্যদের আধুনিক অস্ত্র, ওয়ারলেস সেট ও লাইফজ্যাকেট সরবরাহ করতে হবে। বাড়াতে হবে পুলিশের সদস্য সংখ্যা।
আপাতত পুলিশের সংকট থাকলে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত আনসার সদস্য ও বিডিআর থেকে জনবল আনা যেতে পারে। প্রতিটি বগিতে দু’জন করে সশস্ত্র পুলিশ থাকলে অপরাধীরা কিছুটা আতঙ্কিত থাকবে। তাছাড়া কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে ওয়ারলেসের মাধ্যমে সংবাদ পেয়ে অন্যান্য বগির পুলিশ সদস্যরাও আক্রান্ত বগিতে পৌঁছাতে পারবে। প্রয়োজনে তারা ওয়ারলেসের মাধ্যমে ট্রেনচালককে বিষয়টি অবহিত করলে দ্রুত ট্রেনের গতিরোধ করা সম্ভব হবে।
গণমাধ্যমে প্রকাশ, টঙ্গীর উল্লিখিত দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত পাঁচজন; আহত ৩০ জনেরও বেশি। আমরা নিহতদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানাই। প্রত্যাশা থাকবে, আহতরা যেন দ্রুত সুস্থ হয়ে ফিরতে পারেন স্বাভাবিক জীবনে। নিহতদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার পাশাপাশি আহতদের চিকিৎসা ব্যয় বহনের ঘোষণা দিয়েছে সরকার। এতে যেন কোনো ব্যত্যয় না ঘটে, সেটিও নিশ্চিত করতে হবে।
তবে আশা করি, কমিটি নির্ধারিত সময়েই প্রতিবেদন দেবে এবং তার মাধ্যমে জানা যাবে এ ধরনের দুর্ঘটনার প্রকৃত কারণ। কিন্তু কথা হচ্ছে, এ ধরনের প্রতিবেদন শেষ পর্যন্ত আলোর মুখ না দেখার উদাহরণ যে দেশে অনেক রয়েছে। এ ক্ষেত্রে যেন তার পুনরাবৃত্তি না ঘটে, সে ব্যাপারেও কর্তৃপক্ষের পদক্ষেপ প্রত্যাশিত।
[email protected]
১৮ এপ্রিল ২০১৮