সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪ ।। ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬


আসিফা বানু ধর্ষণ-হত্যা; কাশ্মিরিরা কি এভাবেই পঁচে মরবে?

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

সৈয়দ ফয়জুল আল আমীন
কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক

জম্মু ও কাশ্মিরে আট বছরের এক শিশুকে দলবেঁধে ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনায় আবারও ভারতজুড়ে বিক্ষোভ শুরু হয়েছে। কারণ, এই ঘটনায় গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা হিন্দু হওয়ায় হিন্দু অধ্যুষিত জম্মুর কয়েকটি হিন্দু অধিকার গ্রুপ তাদের মুক্তির দাবিতে বিক্ষোভ শুরু করেছিল।

অভিযুক্তদের নির্দোষ প্রমাণ করতে পুলিশকে মোটা অংকের ঘুষের প্রস্তাবও দেওয়া হয়েছিল। এমনকি প্রমাণ লোপাট করতে পুলিশের উপ-পরিদর্শক আনন্দ দত্ত এবং প্রধান কনস্টেবল তিলক রাজ গুরত্বপূর্ণ প্রমাণ সংগ্রহ করেননি এবং আসিফার পোশাক ধুয়ে ফেলেন বলেও অভিযোগপত্রে বলা হয়।

উল্লেখ্য, গত ১০ জানুয়ারি কাশ্মিরের কাঠুয়া শহরের কাছে মুসলমান যাযাবর সম্প্রদায়ের আসিফা বানু নিখোঁজ হয়। এর সাত দিন পর কাছের একটি জঙ্গলে তার মৃতদেহ খুঁজে পাওয়া যায়। ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনায় জড়িত সন্দেহে পুলিশ ১৯ বছরের এক তরুণকে গ্রেপ্তার করেছে।

গ্রেপ্তার হওয়া তরুণের জবানবন্দির ভিত্তিতে তার চাচা মন্দিরের (যে মন্দিরে আসিফাকে আটকে রেখে ধর্ষণ ও হত্যা করা হয়) পরিচালক সাবেক সরকারি কর্মকর্তা সানজি রাম এবং পুলিশ কর্মকর্তা দীপক খাজুরিয়াকে গ্রেপ্তার করে।

এ ঘটনায় জড়িত সন্দেহে গ্রেপ্তার চতুর্থ ব্যক্তি স্পেশাল পুলিশ অফিসার সুরিন্দর কুমার। তাকে প্রত্যক্ষদর্শীরা ঘটনাস্থলে দেখছিল। ওই তরুণের বন্ধু প্রবেশ কুমারও শিশুটিকে ধর্ষণ করেছে। তাকে খুঁজছে পুলিশ।

এ নিয়ে ১২ এপ্রিল রাতে রাজধানী দিল্লিতে আসিফা হত্যা মামলায় ন্যায়বিচারের দাবিতে ইনডিয়া গেট অভিমুখে ‘ক্যান্ডেললাইট মার্চের’ নেতৃত্ব দেন ভারতের প্রধান বিরোধীদল কংগ্রেস পার্টির প্রধান রাহুল গান্ধী।

তিনি বলেন, ‘আমরা কী দেখছি, এদেশে নারী ও শিশুরা ক্রমাগত ধর্ষণ ও হত্যার শিকার হচ্ছে। আমরা সরকারের কাছে এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানাচ্ছি। এটা কোনো রাজনৈতিক বিষয় নয়, এটা জাতীয় বিষয়।’ সোনিয়া গান্ধী এবং প্রিয়াংকা ভদরা গান্ধীও ওই প্রতিবাদ মিছিলে যোগ দেন।

গণমাধ্যমে প্রকাশ, গ্রেপ্তার তরুণের জবানবন্দিতে ভয়ংকর নৃশংসতার কথা ওঠে এসেছে। ওই তরুণ একটি ঘোড়া খুঁজে দিতে সাহায্য করার কথা বলে আসিফাকে জঙ্গলে ডেকে নিয়ে যায়। পরে সে আসিফাকে জোর করে গ্রামের একটি ছোট্ট মন্দিরে নিয়ে নেশাদ্রব্য খাইয়ে দেয়।

এরপর ওই তরুণ মন্দিরের পরিচালক সানজি রাম ও পুলিশ কর্মকর্তা দীপক খাজুরিয়া শিশুটিকে তিন দিন ধরে আটকে রেখে ধর্ষণ করে।

ওই তিনদিন শিশুটিকে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে রাখা হয়েছিল এবং কিছু খেতে দেওয়া হয়নি। পরে তারা ভারী পাথর দিয়ে মাথায় আঘাত করে আসিফাকে হত্যা করে তার লাশ জঙ্গলে ফেলে দেয়। হায়রে সভ্যতা! এসব করবে বলেই কি ভারত কাশ্মিরের দখল ছাড়তে চায় না?

ইনস্টল করুন ইসলামী যিন্দেগী

এদিকে সম্প্রতি ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং বলেছেন, Kashmir is, was, and always be ours। এই বক্তব্যের মাধ্যমে তিনি বিশ্ববাসীকে জানিয়ে দিলেন- কাশ্মির ভারতের আছে, ছিল ও ভবিষ্যতেও ভারতেরই থাকবে! রাজনাথ সিংয়ের বক্তব্যের প্রেক্ষাপটে প্রশ্ন হচ্ছে, কাশ্মিরিদের পরিচয়সত্তা কী?

১৯৪৭ সালে ভারতীয় বাহিনী যখন দখলদার হিসেবে কাশ্মির ভূমিতে পা রাখে, তখন থেকে কাশ্মিরিরা ভারতের কাছে এই ধরনের বক্তব্য একাধিকবার শুনেছে। যদিও ইতিহাস পর্যালোচনায় বলা যায়, কাশ্মিরিদের তা শোনার কথা নয়।

কাশ্মিরিরা কয়েক হাজার বছরের পুরানো এক জাতি। রেকর্ডকৃত ইতিহাসের আগেও ‘কাশ্মিরি’ নামে একটি জনগোষ্ঠীর অস্তিত্ব ছিল। এই জাতিটি বিশ্বের অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর মতো একটি স্বতন্ত্র জাতি হিসেবে বসবাস করে আসছিল কাশ্মির নামের ভূখণ্ডে। পাঁচ হাজার বছরেরও আগে কাশ্মিরি জাতির ইতিহাস লিখে গেছেন কাশ্মিরের প্রতিথযশা সন্তান কালহানা।

সময়ের ব্যবধানে কাশ্মিরিরা গড়ে তুলেছে তাদের নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি। হিমালয় অঞ্চলে একটি আলাদা রাষ্ট্র এবং অন্যান্য জাতি হিসেবে কাশ্মিরিদের অস্তিত্বের কথা অনেক গ্রিক, চীনা ও আরব ক্রনিকলেও দেখতে পাওয়া যায়।

কাশ্মির যে একটি স্বাধীন সর্বভৌম রাষ্ট্র ছিল তার প্রথম প্রমাণ মিলে গ্রিক সূত্র থেকে। টলেমির ভূগোলে কাশ্মিরকে দেখানো হয়েছে KASPEIRA নামের এক স্বাধীন সার্বভৌম দেশ হিসেবে। আর সেই দেশটির অন্তর্ভুক্ত ছিল পাঞ্জাবের অংশবিশেষ, উত্তর-পশ্চিম প্রদেশ ও মধ্য-ভারত।

ইতিহাসের জনক হেরোডেটাস ‘KASPATYROS’ নামে যে দেশটির কথা উল্লেখ করেছেন, সেটি হচ্ছে কাশ্মির।

গ্রিকদের পর চীনা ইতিহাসেও কাশ্মিরের কথা উল্লেখ পাই। তাদের ইতিহাসে সর্বপ্রথম কাশ্মিরের কথা উল্লিখিত হয় ৫৪১ সালে। চীনা রেকর্ডে কাশ্মিরের প্রথম উল্লেখের ৯০ বছর পর বিশ্বখ্যাত পর্যটক হিউয়েন সাং সফর করেন কাশ্মির উপত্যকা। তাঁর বর্ণনায়ও আছে কাশ্মিরের উল্লেখ।

সময়ের পালাবদলে কাশ্মিরিদের মধ্যে ধর্মীয় পরিবর্তন ঘটেছে। সেখানে ছিল কিছু শিববাদী হিন্দু, এর পর এরা বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত হয়, আবার এরা হয় সাইভাইট হিন্দু। তারও পর এরা নিজেদের ধর্ম হিসেবে গ্রহণ করে ইসলামকে। বর্তমানে কাশ্মিরিদের বেশির ভাগই ইসলাম ধর্মের অনুসারী।

প্রসঙ্গত, কাশ্মিরি হিন্দুদের ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তর ঘটেছে অনেকটা ব্যাপক হারে। আসলে তাদের এই ব্যাপক হারে ইসলাম গ্রহণের পেছনে একটি বড় কারণ ছিল ইসলাম ধর্ম ও শিববাদী হিন্দুধর্মের মৌল নীতিদর্শনগত কিছু মিল থাকার বিষয়টি।

যতদূর জানা যায়, ডোগরা রাজারা লাদাখ দখলের পর ব্রিটিশদের কাছ থেকে কাশ্মির উপত্যকা কিনে নেয়। এর মাধ্যমে সৃষ্টি হয় জম্মু-কাশ্মির রাজ্য। এর আগে এই রাজ্যে দুই শত বছর ধরে তিন সংস্কৃতির মানুষ বসবাস করে আসছে। আজকের দিনে কেউ যখন কাশ্মিরের কথা বলে, তখন তারা পুরো জম্মু ও কাশ্মিরের কথাই বোঝাতে চান।

কাশ্মিরের বর্তমান সমস্যার শুরু ৭ দশক আগে, ব্রিটিশরাজের হাতে ভারত উপমহাদেশ বিভাগের সময়। উপমহাদেশ বিভাজনের সময় স্বাধীন কাশ্মির গড়ার কোনো সম্ভাবনা না দেখে কাশ্মিরিরা চেয়েছিল পাকিস্তানের কনফেডারেশনে যোগ দিতে।

কিন্তু, জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কাশ্মিরকে ভারতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। আর জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে সেই অকোপেশনের সুযোগটা ভারতকে করে দিয়েছিলেন তৎকালীন জম্মু-কাশ্মিরের মহারাজা হরি সিং।

১৯৪৭ সালের ২৭ অক্টোবর নেহেরু ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর কাছে বার বার টেলিগ্রাম পাঠিয়ে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন কাশ্মিরের পরিস্থিতি একটু শান্ত হলেই সেখান থেকে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহার করে গণভোটের মাধ্যমে বিতর্কিত এই সমস্যার সমাধান করবেন।

কিন্তু তিনি এবং তার উত্তরসূরি ভারতীয় কোনো শাসকই কখনোই কাশ্মিরিদের সেই গণভোটের সুযোগ দেননি। বরং নানা কূটকৌশলে কাশ্মিরকে ভারতে পদানত করে রাখার অপচেষ্টা চালিয়ে আসছে, কাশ্মিরের স্বাধীন সত্তার ইতিহাসকে অস্বীকার করে।

ধরে নেওয়া যায়, ভারত উপমহাদেশ বিভাজিত না হলে, কাশ্মির হয়ত অনেক আগেই আবার পুনরুদ্ধার করতে পারত এর স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব। এমনকি ভারত উপমহাদেশ বিভাগের পরও কাশ্মির হতে পারত দুই পরস্পরবিরোধী আদর্শের ধারক-বাহক বৈরী দেশ ভারত ও পাকিস্তানের দ্বন্দ্ব নিরসনের একটি মিটিং প্লেস।

যদি এই দুই দেশের নেতারা সু-বুদ্ধি ধারণ করত এবং তাদের নিজ নিজ জনগণের প্রতি আন্তরিক হতো, তবে এই কাশ্মির হতে পারত এমন একটি স্বাধীন দেশ যেখানে থাকত না কোনো সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্ব-সংঘাত।

তবে আজও সমূহ সুযোগ রয়েছে, ইউরোপের সুইজারল্যান্ডের মতো কাশ্মির উপত্যকাকে ভারতীয় উপমহাদেশের একটি বাফার স্টেট হিসেবে রূপ দেওয়ার। তাহলে কাশ্মির এই উপমহাদেশের দেশগুলোর নানা দ্বন্দ্বে, বিশেষ করে ভারত-পাকিস্তান দ্বন্দ্বে কাশ্মির পালন করতে পারত সেই ভূমিকা, যে ভূমিকা সুইজারল্যান্ড পালন করেছে দুটি বিশ্বযুদ্ধের সময়ে।

অবশ্য কাশ্মির গড়তে ভারত পাকিস্তানের ভূমিকা হতে হবে আন্তরিক। বিশেষ করে ভারতের ভূমিকা এখানে মুখ্য। কারণ, কাশ্মিরিদের লড়াই প্রধানত ভারতীয় দখলদারিত্বের বিরুদ্ধেই। আজকের কাশ্মির সমস্যার স্থায়ী সমাধান চাইলে কাশ্মিরিদের নেহেরুর দেওয়া প্রতিশ্রুতিও স্মরণে আনতে হবে বৈকি!

সবশেষে প্রশ্ন হচ্ছে, কাশ্মিরিরা কি আবার ফিরে পাবে তাদের জাতীয়তা, স্বাধীন সার্বভৌম দেশ- যেমনটি অস্তিত্বশীল ছিল কয়েক হাজার বছর আগে? কাশ্মির কি আবার হয়ে উঠতে পারবে আগের মতো একটি জাতি-রাষ্ট্র?

কাশ্মিরিরা কি আবার কখনো সুযোগ পাবে প্রতিবেশীর সাথে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রেখে মর্যাদা ও সম্মানের সাথে নিজভূমে বসবাসের?

১৫ এপ্রিল ২০১৮


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ