সাদিকুল ইসলাম
প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট
প্রথমেই বলে রাখি কোনো সন্ত্রাসী সংগঠনের গুকীর্তন আমার লেখার বিষয় নয়। কোন সংগঠন সন্ত্রাসী আর কোনটা নয় সে তত্ত্ব উদঘাটন করাও আমার উদ্দেশ্য নয়। প্রত্যেক স্বাধীনতাকামী ও মতাদর্শ প্রতিষ্ঠার লড়াইরত ব্যক্তিই তার বিরোধী পক্ষের কাছে সন্ত্রাসী ও অরাজকতা সৃষ্টিকারী। পশ্চিমারা যাকে হিরো বানায় প্রয়োজনে তাকেই ভিলেন বানিয়ে ফাঁসি দেয়।
তাদের নিয়ন্ত্রিত মিডিয়াগুলো ‘সাদা হাতি’। হিরোকে ভিলেন আর ভিলেনকে হিরো বানাতে যাদের পাঁচ মিনিটের ভিডিও শুটিংই যথেষ্ট। গত ২ এপ্রিল আফগানিস্তানের কুন্দুজ প্রদেশের দাস্তি আর্চি জেলার একটি হাফিজিয়া মাদরাসায় আফগান বিমানবাহিনীর হামলায় ১১ থেকে ১২ বছরের ১৫০ জন হাফেজের মৃত্যুর ঘটনা দিয়ে শুরু করছি। যাদের একজনও তালেবান ছিাল না।
পবিত্র কুরআন হেফজ করার সনদ ও পাগড়ি পড়ার সময় শহিদ হন ১৫০ জন হাফেজে কুরআন। যে অনুষ্ঠান হচ্ছিল সেটা তালেবানদের যুদ্ধের প্রস্তুতি মিটিং ছিল না। কিশোর বয়সের কিছু ছেলেদের শিক্ষার সনদ প্রদান অনুষ্ঠান ছিল আর সেখানেই বিমান হামলা হলো তালেবানদের অস্তানা সন্দেহে।
সভ্য পৃথিবীর ঘাড়ে এখন এ ঘটানর বিচার ভার। এখন এ ঘটনাকে কিভাবে দেখবে এবং কোন দৃষ্টিকোন থেকে মূল্যায়ন করবে? সে মূল্যায়ন ২০০১ সালে আফগানিস্তানের বামিয়ান প্রদেশে বৌদ্ধ মূর্তি ভাঙার পর যেভাবে মানবাধিকারের স্বর চড়েছিল তার সমপরিমাণ হবে কি?
তালেবান দমনের নামে আফগানিস্তানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে হামলা এটা প্রথম নয়। অনেক ঘটনার মাঝে এটা একটা। এর আগেও অনেকবার এমন স্থাপনাগুলোতে হামলা হয়েছে যা তালেবানদের আস্তানা বা ‘মিটিং প্লেস’ নয়।
এমন মানুষের উপর হয়েছে যারা তালেবান বা কোন সন্ত্রাসী সংগঠনের সাথে জড়িত নয় বা সন্ত্রাসীও না। ২০১৫ সালের অক্টোবরে ফ্রান্সের এনজিও সংস্থা কর্তৃক পরিচালিত কুন্দুজের ডক্টরস উইদাউট বার্ডাসের হাসপাতালে মার্কিন বোমারু বিমান এসি-১৩০ থেকে বোমা ফেলে চিকিৎসকসহ ৪২ জনকে হত্যা করা হয়। যাদের একজনও তালেবান ছিলো না।
এর আগে ২০১১ সালের ১১ মার্চে এক মার্কিন সেনার গুলিতে ১৬ জন নিরীহ আফগানী প্রাণ হারায়। হত্যাকারী সৈনিকের লঘু শাস্তি ও ন্যাটো জোট এর জন্য দুঃখ প্রকাশ করে নিহতদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়ে দ্বায় সাড়ে।
২০১৬ সালে ৩ নভেম্বর কুন্দুজে মার্কিন বিমান হামলায় ৩৩ বেসামরিক নাগরিক প্রাণ হারায়। সে বারও ন্যাটো জোট গতানুগতিক দুঃখ প্রকাশ ও সমবেদনা জানায়। ২০১১ সালে কুনারে ন্যাটো বাহিনীর হামলায় ৬৫ জন বেসামরিক নাগরিক প্রাণ হারায় যার মধ্যে ৪০ জনই শিশু।
২০১৩ সালের জুন মাসে পূর্বাঞ্চলের পাকশিয়া প্রদেশের একটি বাজারে মার্কিন বিমান হামলায় ১০ স্কুল শিক্ষার্থী প্রাণ হারায়। চলতি বছরের জানুয়ারিতে মার্কিন হামলায় প্রাণ হারায় ৬ শিশু। আর প্রত্যেক বারের মতো দুঃখ প্রকাশ করে বিবৃতি দেয় ন্যাটো।
বার্তা সংস্থা এএফপি’র তথ্যমতে ২০০১ সাল থেকে এ পর্যন্ত আফগানিস্তানে তালেবান দমনের জন্য চালনো হামলায় নিহতদের মধ্যে ৬০ ভাগ সাধারণ মানুষ। আর এর মধ্যে ২৭ শতাংশ মানুষ প্রাণ হারায় ন্যাটো জোটের হামলায়। উপরোল্লেখিত নিহতদের কেউই তালেবান বা সন্ত্রাসী না।
আমি যে হামলাগুলোর কথা বললাম এর বাইরে আরও অনেক বেসামরিক মানুষ হত্যার তথ্য আছে। সব হত্যার পরেই গতানুগতিক দুঃখ প্রকাশ ছাড়া আর কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। এতোগুলো সাধারণ মানুষের জীবনের মূল্য একটা দুঃখ প্রকাশের বিবৃতি?
সাম্রাজ্যবাদীদের কাছে সাধারণ মানুষের জীবনের মূল্য কতটা সে দৃষ্টান্তের অভাব নেই। ইরাকের কাছে বিপুল বিধ্বংসী অস্ত্রের দোহায় দিয়ে ২০০৩ সালে ইরাক আক্রমণ চালায় আমেরিকা ও ব্রিটেন। সে যুদ্ধে ৩ লাখ মানুষ প্রাণ হারায়। যার মধ্যে ৫০ হাজার শিশু হত্যার শিকার হয়েছে। বুশ-টনি ব্লেয়ার টিভি সাক্ষাতকারে দুঃখ প্রকাশ করেই ৩ লাখ মানুষের জীবনের মূল্য শোধ করেছে।
৫০ হাজার শিশুর মধ্যে কত জন সন্ত্রাসী ছিলো? একজনও না। তাহলে কেন তাদের হত্যা করা হলো? প্রত্যেকটা হামলার ঘটনাই ভুলবশত হয়েছে। এবারও আফগানিস্তানে মাদরাসায় যে হামলা করেছে সেটাও ভুলবশত। হামলার পর আফগান সিনেটর বিবৃতি দিয়ে ভুলের কথা জানিয়েছে। যারা এই বারংবার ভুলের শিকার হয় এখন যদি তারা ভুলের প্রতিশোধ নেয় সেটা কি অন্যায় হবে?
সন্ত্রাস দমনের জন্য দু দেশের মধ্যে দৃঢ় অঙ্গিকার ও চুক্তিনামা হয়। সময়ের দাবী অনুযায়ী এমন চুক্তি হওয়া দরকার , কেন সাধারণ মানুষ সন্ত্রাসী হয়, কেন তারা সন্ত্রাসের পথ বেছে নেয়, তালেবান, আল-কায়দা, আইএস, আল শাবাব, বোকো হারামো, ভারতের মাওবাদী, তামিলে এলটিটি, কাশ্মীরে হিজবুল মুজাহেদিন, ফিলিস্তিনে হামাস এসব দল কেন তৈরি হলো এবং কারা সৃষ্টির ইন্দন দেয় এ উৎসগুলো খোঁজা।
এতো হামলা আর এতো সন্ত্রাসীর মৃত্যু! তারপরও দশকের পর দশক রক্তপাত চলছে সন্ত্রাসী এবং সভ্যতাবাদী শান্তিকামীদের মধ্যে। কিন্তু সন্ত্রাসীদের বিনাশ হচ্ছে না কেন? প্রশ্নগুলোর উত্তর জানতে আমি পাঠকদের ম্যানবুকার জয়ী ভারতীয় লেখিকা অরুন্ধতী রায়ের ‘দ্যা ব্রোকেন রিপাবলিক’ বইটা পড়তে বলবো।
কেন সন্ত্রাস দমন হয় না, সন্ত্রাস দমন অভিযান কেন ব্যর্থ হয়, বরং সন্ত্রাসের প্রজনন কেনো বৃদ্ধি পায়? এসব প্রশ্নের যুতসই উত্তর বইটার পরতে পরতে প্রমাণসহ দেওয়া আছে। যেখানে লেখিকা মাওবাদীদের সাথে সরাসরি কথোপকথনের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন কেন মাওবাদীরা সন্ত্রাস করে।
এ রকম আরও কিছু বই লেখা দরকার সিরিয়া, ইয়েমেন, ফিলিস্তিন, নাইজেরিয়া, লিবিয়া ও আফগানিস্তানের সন্ত্রসীরা কেন সন্ত্রাস করছে তার উত্তর দিয়ে। টুইন টাওয়ারে বিমান হামলায় ৩ হাজার মানুষের প্রাণহানীর জন্য যদি আমেরিকা আফগানিস্তানের স্বাধীন ভূমিতে প্রতিশোধ নিতে হামলা চালাতে পারে। শতশত তালেবান, আল-কায়দাকে হত্যা করতে পারে। তাহলে ৩ লাখ নিরীহ মানুষ হত্যার প্রতিবাদে ৩ লাখ মসানুষের স্বজনরাও সন্ত্রাসী হতে পারে কি?
সিরিয়াতে আজ যারা বিনা কারণে প্রাণ হারাচ্ছে এ কারণেই হয়তো আগামী দিনে এই নিহত মানুষের স্বজনরা সন্ত্রাসী হতে পারে। সন্ত্রাসী হতে পারে নিহত ১৫০ জন হাফেজের স্বজনরা। শান্তিকামীরা যাদের সন্ত্রাসী বলছে তাদের কাছে আবার শান্তিকামীরা সন্ত্রাসী। কারণ সন্ত্রাসীরা নিজেদের ভূমিকে রক্ষার জন্য লড়ছে বা নিজেদের মতাদর্শ নিজের ভূমিতে প্রতিষ্ঠার জন্য লড়ছে।
যেমনটা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য গণতন্ত্রবাদীরা বিশ্বব্যাপী প্রচারণা চালাচ্ছে। সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য বিপ্লবীরা নানা জায়গায় যেমনভাবে বিপ্লব করেছে, করছে। গণজাগরণের নামে স্বাধীন, সার্বভৌম ও আর্থিক স্বচ্ছল ও শান্তিপূর্ণ একটা দেশে রক্তপাত শুরু করছে।
যদি শান্তিকামীদের রক্তপাত শান্তির জন্য হয় তাহলে মাওবাদীদের রক্তপাত কেন সন্ত্রাস হবে? যারা নিজেদের ভূমি রক্ষার জন্য দশকের পর দশক ধরে ভারতে কেন্দ্র সরকারের সাথে যুদ্ধ করছে।কাশ্মীরীদের কেন সন্ত্রাসী বলা হচ্ছে? যারা মাতৃভূমির স্বাধীনতার দাবীতে জীবন দিচ্ছে? স্বাধীনতাকামী ফিলিস্তিনিদের কেন সন্ত্রাসী বলা হচ্ছে?
এখন সময় সন্ত্রাসের উৎস খোঁজার, কেন সন্ত্রাস প্রজনন বন্ধ হচ্ছে না সে বিষয়ে ভাবার সময়। আর আমরা যাদের সন্ত্রাসী বলছি সত্যিই কি তারা সন্ত্রাসী? না কি শান্তিকামীরা তাদের সন্ত্রাসী বানিয়েছে? বিষয়গুলো ভাবতে হবে।
যে ১৫০ জন হাফেজ প্রাণ হারাল তাদের স্বজনরা যদি এবার প্রতিশোধ নিতে উদ্ধত হয় তাহলে আমরা তাদের কি উপাধি দেব? সন্ত্রাসী না কি প্রতিশোধ গ্রহণকারী; যেমনটা আমেরিকা নাইন ইলেভেনের পর নিয়েছে।
এসব দাবি আমি একাই করছি না। সব সচেতন মহলেই উঠছে এমন যুক্তিভিত্তিক। বিভিন্ন ভাষার গল্প, উপন্যাস, শিল্পসাহিত্যসহ নাটক-সিনামাতেও এজাতীয় দাবি উত্থাপিত হচ্ছে। দেখানো হচ্ছে সন্ত্রাসীদের সন্ত্রাসী হয়ে উঠে আসার গল্প। এ দাবি দিনদিনই শক্তিশালী হচ্ছে।এ শক্তির বিস্ফোরণ ঘটার আগে সংশ্লিষ্ট্রগুলোর সতর্ক হওয়া প্রয়োজন বলে আমি মনে করছি।
মানবতার আদিম অমানবিক রূপ প্রকাশ পওয়ার আগেই টেনে ধরার পরামর্শ থাকবে দুনিয়ার নাবালেগ আর প্রতিবন্ধী শক্তিগুলোর প্রতি। এবার তো বালেগ হওয়ার বোধ জাগ্রত করুন বিবেকে!
শিক্ষার্থী
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া
আরো পড়ুন : নববর্ষ : উন্মোচিত হোক সাংস্কৃতিক জাগরণের নতুন দিগন্ত