সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪ ।। ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬


মাওলানা কামরুজ্জামান কবীরের ইন্তেকাল; এক আদর্শিক প্রতিষ্ঠানের সমাপ্তি

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মুফতি মোহাম্মদ তাসনীম

আজ ১১ এপ্রিল। এই দিনটি আমার জন্য আনন্দের এবং বেদনার। এক বছর আগে এই দিনেই গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তিন শতাধিক আলেমের উপস্থিতিতে গণভবনে কওমি মাদরাসার সনদের সরকারি স্বীকৃতির কথা ঘোষণা করেন।

দীর্ঘদিনের প্রচেষ্টার ফসল এই কওমি সনদের স্বীকৃতি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার এক বছর পূর্ণ হলো। কিন্তু এখন সনদের স্বীকৃতির ঘোষণা- ঘোষণাতেই আটকে আছে। তা আইন কিংবা বাস্তবায়ন হয়নি। আশা করি, অচিরেই ঘোষণা বাস্তবায়িত হবে।

দিনটি বেদনার হওয়ার কারণ, এক বছর আগে এই ১১ এপ্রিলে (২০১৭) হারিয়েছিলাম আমার সব থেকে কাছের উস্তাদ, অভিভাবক ও সাংগঠনিক গুরু মাওলানা কামরুজ্জামান কবীরকে।

হুজুরের এতটা প্রিয় ছিলাম হুজুর চলে যাওয়ার পরে বুঝতে পেরেছি। হুজুরের সঙ্গে পরিচয় সেই ২০০১ সাল থেকে।

২০০১ সালে হুজুরের এক সাথী ভাই যার কাছে কুরআন শরিফের সবক পড়েছি। তিনি আমাকে গওহরডাঙ্গা মাদরাসায় ভর্তি হওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করেন। তার দিক-নির্দেশনায় ৯ শাওয়াল বুধবার গওহরডাঙ্গা মাদরাসায় গিয়ে কাচনার হুজুরকে খুজে বের করলাম।

বাবড়ি চুল, সাদা পাঞ্জাবি গায়ে চেহারায় ব্যক্তিত্বের ছাপ। তিনি এমন ব্যবহার করলেন মনে হলো- হুজুরের অনেকদিন আগের পরিচিত। প্রথম সাক্ষাতেই তার ব্যবহারে মুগ্ধ হলাম। ভর্তির সব কার্যক্রম সমাপ্ত করে বিদায় নেওয়ার জন্য তার কাছে গেলাম।

হুজুর মোজাহেদে আজম আল্লামা শামছুল হক ফরিদপুরী সদর সাহেব রহমাতুল্লাহি আলাইহির জীবনী ও মাদরাসার একটা ক্যালেন্ডার হাদিয়া দিলেন। বললেন, মাদারাসায় আসার আগে এটা পড়ে শেষ করবে।

বাড়িতে খুব আগ্রহের সঙ্গে সদর সাহেব হুজুর রহমাতুল্লাহি আলাইহিরর জীবনী পড়লাম। তার হাতেই খাদেমুল ইসলাম ছাত্র পরিষদের ফরম পূরণ করে মোজাহেদে আজম আল্লামা শামছুল হক ফরিদপুরী রহ.-এর অরাজনৈতিক সংগঠনের শপথ গ্রহণ করি।

মাওলানা কামরুজ্জামান কবীর ১৯৫৬ সালে বাগেরহাট জেলার মোল্লারহাট থানাধীন কাচনা গ্রামেন এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। প্রাথমিক শিক্ষা শেষে খুলনা জেলার ঐতিহ্যবাহী সেন্ট জোসেফ মিশনারি স্কুল থেকে ১৯৭৬ কৃতিত্বের সঙ্গে এসএসসি পাস করে এইচএসসি ভর্তি হন।

স্কুলে পড়াকালীন সময় তিনি মোজাহেদে আজম আল্লামা শামছুল হক ফরিদপুরী সদর রহ. -এর জীবনী পড়ে দিনি ইলম শিক্ষা গ্রহণের ব্যপারে উদ্বুদ্ধ হন। পরে ১৯৭৭ সালে গওহরডাঙ্গা মাদরাসায় ভর্তি হন।

১৯৮৮ সালে গওহরডাঙ্গা মাদরাসা থেকে দাওরায়ে হাদিস শেষ করে মাওলানা উপাধী লাভ করেন। তিনি গওহরডাঙ্গা মাদরাসায় খেদমতের মাধ্যমে তার কর্মজীবন শুরু করেন। মৃত্যু পর্যন্ত তিনি গওহরডাঙ্গা মাদরাসার খেদমতে নিয়োজিত ছিলেন।

তিনি শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি বিভিন্ন সমাজ সেবামূলক সংগঠন প্রতিষ্ঠিত করেন।

১৯৯৭-৯৮ সালের ভয়াবহ বন্যায় তিনি গরিব দুঃস্থ মানুষের জন্য ত্রাণ কার্যক্রম সুষ্ঠভাবে পরিচালনার ও বন্যা পরবর্তী পুনার্বসন কাজের জন্য দুঃস্থ মুসলিম কল্যাণ সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন।

শিক্ষকদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি তানজিমুল মুদাররিস নামে শিক্ষক সংগঠন প্রতিষ্ঠিত করেন। তিনি ছিলেন এ সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা সেক্রেটারি জেনারেল।

এ ছাড়া তিনি দেশের আলেম-উলামাদের মাঝে ঐক্যগঠন প্রক্রিয়ায় উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন। বিশেষ করে সর্বোচ্চ উলামা পরিষদ গঠন, ফতোয়া বিরোধী আন্দোলন, কওমি মাদরাসা সনদের সরকারি স্বীকৃতি আন্দোলন, কওমি মাদরাসা শিক্ষা কমিশন গঠনসহ কওমি মাদরাসার সকল আন্দোলন সংগ্রামে তিনি ছিলেন সামনের সারির এক জন।

তিনি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কওমি মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড গওহরডাঙ্গার নির্বাহী কমিটির সদস্য ছিলেন।

খাদেমুল ইসলাম ছাত্র পরিষদের মাধ্যমে তার সাংগঠনিক হাতেখড়ি হয় এর পর তিনি যুব পরিষদের সভাপতি মূল সংগঠনের জয়েন্ট সেক্রেটারি এবং ২০০৫ সালে খাদেমুল ইসলাম বাংলাদেশের সেক্রেটারি জেনারেলের দায়িত্ব পালন করা অবস্থায় ১১ এপ্রিল ২০১৭ রাতে রফিকে আলার ডাকে সাড়া দিয়ে ইহলোক ত্যাগ করেন।

মৃত্যুকালে তিনি ৩ মেয়ে ১ ছেলে এবং অগণিত ছাত্র, ভক্ত ও শুভানুধ্যায়ী রেখে যান। হজরত সদর সাহেব রহ.-এর কবরের পাশে মাকবারায়ে শামসিয়াতে তাকে দাফন করা হয়।

মাওলানা কামরুজ্জামান কবির রহ.-এর প্রতিটি লিখনী, বক্তৃতা ও কর্মের মাঝে হজরত সদর সাহেব রহ.-এর চিন্তা-চেতনা, আদর্শের নমুনা ফুটে উঠত। তিনি ছিলেন গওহরডাঙ্গা মাদরাসা এবং সদর সাহেব রহ.-এর জন্য নিবেদিত প্রাণ একজন মানুষ।

তিনি কখনও নিজের বা পরিবারের কথা ভাবেননি। যতবার দেখা হয়েছে, ততবার খাদেমুল ইসলাম এবং গওহরডাঙ্গার কথা বলেছেন। আমার জন্য তার শেষ নসিহত ছিলো- ‘পৃথিবীর যেখানে থাকো, গওহরডাঙ্গার সাথে সম্পর্ক রাখবে।

গওহরডাঙ্গা মাদরাসার মোহতামিম সাহেবকে মুরুব্বি মেনে চলবে। খাদেমুল ইসলামের কাজের সঙ্গে লেগে থাকবে। হজরত সদর সাহেব হুজুরের চিন্তা-চেতনা বাস্তবায়নে নিজেকে নিয়োজিত রাখবে। সবসময় আমিরের সিদ্ধান্ত মেনে চলবে। সিনিয়রদের যথাযথ সম্মান করবে।

আজ এক বছর পূর্ণ হলো- আমাদের এতিম করে দরদী এ অভিভাবক চলে গেছেন। আজকের দিনে আল্লাহতায়ালার দরবারে মোনাজাত করি, হে আল্লাহ! আপনি আমাদের পরম শ্রদ্ধেয় অভিভাবককে জান্নাতের উচুঁ মাকাম দান করুন। আমাদেরকে তার দেখানো পথে পরিচালিত করুন। আমিন।

লেখক: প্রেস সচিব, খাদেমুল ইসলাম বাংলাদেশ।

আরার


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ