সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪ ।। ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬


অরক্ষিত সুন্দরবনের সুরক্ষার দায় কার?

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

সৈয়দ ফয়জুল আল আমীন

সুন্দরবন একক আয়তনে পৃথিবীর বৃহত্তম জোয়ার-ভাটার বনভূমি। ইউনেস্কো ঘোষিত বিশ্বঐতিহ্যের অংশ, দেশের দক্ষিণাঞ্চলের পাঁচ জেলার ১৭ উপজেলার তিন লাখ মানুষের রুটি-রুজির উৎস এ বন এখন অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় অরক্ষিত হয়ে পড়েছে।

ছয় হাজার বর্গকিলোমিটার আয়তনের বিশ্বের সর্ববৃহৎ এই অখণ্ড বনভূমিতে গত দেড় বছরে বেশ কয়েকবার তেল, কয়লা, পটাশ সারবাহী জাহাজ ডুবেছে। এতে ইকোসিস্টেমের ক্ষতি হওয়ায় ভেঙে পড়ছে বনের খাদ্যশৃঙ্খল। দ্রুত কমছে বিশ্বখ্যাত রয়েল বেঙ্গল টাইগারের সংখ্যা।

ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস থেকে জনপদের প্রাকৃতিক রক্ষাকবচ এ বনের পাশে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ নিয়েও চলছে বিতর্ক। এর সঙ্গে সাম্প্রতিক সময়ে যোগ হয়েছে ঘনঘন আগুন লাগার ঘটনা।

কিন্তু অবাক হতে হয়, সুন্দরবনের পাশে বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিষয়ে পরিবেশবাদীরা যতটা তৎপর, নদীতে তেলবাহী জাহাজ ডুবে যাওয়া কিংবা আগুন লাগার ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের দাবিতে ততটা তৎপরতা দেখা যায় না। এ নিয়ে তেমন কোনো আন্দোলন হয় না, বিবৃতিও আসে না।

যে কোনো বনের স্তরবিন্যাসের ধরন পর্যালোচনায় বলা যায়, সুন্দরবনে বারবার আগুন লেগে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির ধকল সইতে হচ্ছে বনতলকে। কারণ আগুন লাগছে মূলত বনপ্রান্তে এবং সেখানে হারগোজা, ধানচি, বাঘ-ফার্ন, সিংড়া, বলা, কালিলতা, গোলপাতা, কেয়া, হেন্তাল, আঙ্গুরলতা, বাওয়ালি লতারই আধিক্য বেশি থাকে।

আর সুন্দরবনের জন্য এই বনতল খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং এখানকার সকল প্রাণসম্পদ পুরো বনের টিকে থাকা ও বিকাশের সঙ্গে সম্পর্কিত। বিশেষত কাঁকড়া, শামুক, গুইসাপ, ব্যাঙ, সাপ, পতঙ্গ ও নানা জলচর পাখিদের।

সুন্দরবনের বনজীবী-বিজ্ঞানমতে, বলা গাছের ঝোপে বাটাং, ঘুঘু, বক ও কুকু পাখি বাসা বানায়। অস্ট্রেলিয়ার গ্রিফিথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শেখ জে উদ্দিন, ডারেন গ্রেস ও এভেলিন টিরালংগো ২০০৮ সালে বাংলাদেশের ১২টি ঔষধি উদ্ভিদের সাইটোটক্সিক প্রভাব নিয়ে গবেষণা করেন।

আরও পড়ুন: সুন্দরবনের বাঘের হাত থেকে বেঁচে ফিরলেন দুই ভাই

এতে দেখা যায়, বলা গাছের এই গুণ যথেষ্ট, যা ক্যানসার প্রতিরোধে ভূমিকা রাখতে পারে।

তাছাড়া যেখানে আগুন লাগে, সেখানকার মাটি উর্বরতা হারিয়ে ফেলে। কয়েক একর জায়গার নানা প্রজাতির প্রাণী মারা যায়। এমন অনেক প্রাণী আছে, যারা তাপ সহ্য করতে পারে না বলে এলাকা ছেড়ে চলে যায় বলে সেখানকার ইকোসিস্টেমে এক ধরনের শূন্যতা তৈরি হয়।

আগুন লাগার ঘটনায় বন বিভাগের নানা সময়ে গণমাধ্যমে দেওয়া বক্তব্য হলো, মূলত বনজীবী ও স্থানীয় লোকজনের বিড়ির আগুনে এটি ঘটে। যদিও প্রতিবার আগুন নেভাতে প্রাণবাজি রেখে এগিয়ে এসেছে বনজীবী ও স্থানীয় লোকজনই। প্রতিবছর ধানসাগর স্টেশনের বনে আগুন লাগার কারণ সম্পর্কে বন সংলগ্ন এলাকার বাসিন্দাদের অভিযোগের আঙুল বন বিভাগের দিকে।

যদিও প্রকৃত সত্য হচ্ছে, শরণখোলা উপজেলার উত্তর রাজাপুর ও ধানসাগর এলাকার কয়েকটি অসাধু মৎস্য শিকারি চক্র প্রতিবছর বনে আগুন লাগিয়ে থাকে। শুষ্ক মৌসুমে তারা আগুন লাগিয়ে বন পরিষ্কার করে মাছের বিল তৈরি করে। বর্ষা এলেই শুরু হয় ওই চক্রের মাছ ধরার উৎসব।

ধানসাগর স্টেশনের দায়িত্বে থাকা বন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে ওই চক্রের কাছে মৌসুমভিত্তিক অলিখিত ইজারা (লিজ) দেয় ওই বিলগুলো। কারেন্ট জাল পেতে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ শিকার করা হয়। প্রতি মৌসুমে লাখ লাখ টাকা আয় হলেও সরকারের ঘরে একটি টাকাও রাজস্ব জমা পড়ে না। পকেট ভারি হয় কর্মকর্তাদের।

তবে অনেকের মতে এমনটিও হয় যে, মৌয়ালিরা বনে মধু সংগ্রহে ধোঁয়া সৃষ্টির জন্য আগুন লাগায়। সেখান থেকে তা ছড়িয়ে পড়ে। আবার চোরাকারবারীরা সুন্দরীগাছ চুরি করে তা নেওয়ার পথ তৈরির জন্য আগুন লাগিয়ে দেয়। যাতে সবার মনোযোগ ওই দিকে থাকে।

তবে এসব আগুন লাগানোর সঙ্গে বন বিভাগের কর্মকর্তাদের জড়িত থাকার অভিযোগ দীর্ঘদিনের। অবশ্য এমন ধারণাও অমূলক নয় যে, এক্ষেত্রে দেশি ও বিদেশি চক্র যৌথভাবে কাজ করছে। তারাই এসব নাশকতা চালাচ্ছে।

সুন্দরবনের ১৫ বছরের আগুন লাগার ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, মূলত পূর্ব সুন্দরবনের শরণখোলা ও চাঁদপাই রেঞ্জে এ ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটছে। তার ভেতর চাঁদপাই রেঞ্জেই এর মাত্রা বেশি। ভৌগোলিকভাবে এটি তুলনামূলকভাবে উঁচু অঞ্চল এবং এখানকার নদীপ্রবাহগুলো উজানে আটকে আছে। যেসব অঞ্চলে আগুন বেশি লাগছে সেখানে নদী, খাল ও পানিপ্রবাহ কম। তবে এই আগুন এমনি এমনি লাগেনি। এটি বারবার লাগানো হচ্ছে।

বলা উচিত, সর্বগ্রাসী মুনাফার লোভে সুন্দরবনকে আগুনে পুড়িয়ে বাণিজ্যের ক্ষেত্র প্রস্তুত করার একটা বাহাদুরি। কেউ কেউ এ সময়টাতে আগুন লাগিয়ে সুন্দরবনের খাঁড়ি ও খালগুলো থেকে একতরফাভাবে মাছের বাণিজ্য করে। তবে অনেকে বলছেন, সুন্দরবন নিয়ে নানা বিনাশী প্রকল্প, তেল বিপর্যয় এবং বন্যপ্রাণী বাণিজ্যের মতো বিষয়কে আড়াল করতেই এ ঘটনা ঘটানো হচ্ছে।

কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হলো- ১৫ বছর ধরে বন বিভাগ সুন্দরবনের এই আগুন লাগার ঘটনার কোনো সুষ্ঠু তদন্ত ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে পারেনি। এমনকি আগুন নেভানোর জন্য বন বিভাগকে দক্ষ ও প্রশিক্ষিত করে তোলেনি রাষ্ট্র। আগুন লাগানোর বিরুদ্ধে রাষ্ট্র কার্যকর কোনো টহল তৈরি করতেও ব্যর্থ হয়েছে।

বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইন ২০১২ অনুযায়ী সংরক্ষিত বনাঞ্চলে আগুন দেওয়ার বিরুদ্ধে আইনি বিধান থাকলেও তা ১৫ বছর এসব আইনের পাতা কেউ উল্টাচ্ছে না।

প্রতিটি ঘটনার পর বন বিভাগ থেকে তদন্ত কমিটি গঠন করা হলেও আজ পর্যন্ত কোনো প্রতিবেদনই আলোর মুখ দেখেনি। এসব আগুন লাগার পেছনে যারা জড়িত, তদন্তে তাদের নাম আসে না। দায়সারা প্রতিবেদন দেওয়া হয়। ফলে প্রকৃত অপরাধীরা সব সময় ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকে।

কিন্তু এভাবে আর কতদিন? সুন্দরবনের আগুন বিপর্যয়ের সুষ্ঠু তদন্ত ও ন্যায়বিচার কি নিশ্চিত করা হবে না? প্রকৃতঅর্থে সুন্দরবনকে আগুন, রাসায়নিক দূষণ, করপোরেট বাণিজ্যসহ সকল নয়া-উদারবাদী মুনাফার আঘাত থেকে সুরক্ষায় আমাদের আরও সচেতন ও আন্তরিক হতে হবে।

লেখক : কবি, গবেষক ও সাংবাদিক
সহযোগী সম্পাদক, আওয়ার ইসলাম টোয়েন্টিফোর ডটকম

[email protected]
০৫ এপ্রিল ২০১৮


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ