সৈয়দ ফয়জুল আল আমীন
খুবই ইতিবাচক একটা ব্যাপার-বিউটি হত্যার পর সারা দেশে প্রতিবাদ-বিক্ষোভ সংঘটিত হচ্ছে। আমরা বিশ্বাস করি হত্যা, ধর্ষণের মতো অপরাধের বিরুদ্ধে সামাজিকভাবে প্রতিরোধ গড়ে তোলা খুবই জরুরি। পরিবারে, সমাজে কোথাও যেন ধর্ষণকারী-খুনিরা প্রশ্রয় না পায়।
বিউটি হত্যার দুই সপ্তাহ পর গত শনিবার গ্রেফতার হয়েছে বাবুল মিয়া। প্রত্যাশা থাকবে, বাবুল মিয়াকে বাঁচাতে যেন সুরক্ষার দেয়াল হতে না পারে তার ইউপি সদস্য গর্ভধারিণী মা।
তার মাঝখানে যেন সুরক্ষা দেয়াল হয়ে পার্টির ক্ষমতাবান নেতা, গ্রামের প্রভাবশালী ব্যক্তি, বড় ভাই, প্রভাবশালী মামা-চাচারা দাঁড়াতে না পারে। যাদের সুরক্ষা প্রাচীরের আড়ালে নিশ্চিতে, নির্বিঘ্নে, আরামে বিউটিকে ধর্ষণ, হত্যা করেছে বাবুল মিয়া ও তার ধর্ষণসঙ্গীরা!
কেন জানি, বিউটির পা ছড়ানো ছবিটি আজ ফেলানীর কথা মনে করিয়ে দিল। সাত বছর আগে ফেলানীকে মেরে ঝুলিয়ে রেখেছিল ভারতের সীমান্তরক্ষীরা। কাঁটাতারের বেড়ায় ফেলানীর ঝুলন্ত শরীরের ছবি গণমাধ্যমে প্রকাশ হওয়ার পর বিশ্বজুড়ে সমালোচনা হয়।
যদিও সে হত্যার বিচার এখনো হয়নি, কারণ ভারতের সুপ্রিম কোর্ট ফেলানী হত্যার অভিযোগ নিষ্পত্তি করছেন না। ধরে নিলাম ফেলানীর হত্যাকারীরা অন্য দেশের, অন্য ভূখণ্ডের। কিন্তু বিউটির বাড়ি তো বাংলাদেশের হবিগঞ্জে।
জানা যায়, গত ২১ জানুয়ারি হবিগঞ্জের শায়েস্তাগঞ্জ উপজেলার ব্রাহ্মণডোরা গ্রামের সায়েদ আলীর মেয়ে বিউটি আক্তারকে বাড়ি থেকে অপহরণ করে নিয়ে যায় বাবুল মিয়া ও তার সহযোগীরা।
এক মাস তাকে আটকে রেখে ধর্ষণ করে। এক মাস নির্যাতনের পর বিউটিকে কৌশলে তার বাড়িতে রেখে পালিয়ে যায় বাবুল। এ ঘটনায় বিউটির বাবা সায়েদ আলী অপহরণ ও ধর্ষণের মামলা দায়ের করেন। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে বাবুল মিয়া প্রতিনিয়ত হুমকি দিতে থাকে। এক পর্যায়ে মেয়েকে বাঁচাতে তার নানার বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
এরপর ১৬ মার্চ সেখান থেকে জোর করে বিউটিকে তুলে নিয়ে যায় বাবুল মিয়া ও তার সহযোগীরা। পুলিশ পরদিন সকালে শায়েস্তাগঞ্জের পুরাইকলা বাজার সংলগ্ন হাওর থেকে বিউটির মরদেহ উদ্ধার করে।
এ ঘটনায় ওই দিনই বিউটিকে ধর্ষণের পর হত্যার অভিযোগে তার বাবা সায়েদ আলী বাদী হয়ে বাবুল মিয়াকে প্রধান আসামি করে শায়েস্তাগঞ্জ থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলা দায়েরের পরও প্রধান অভিযুক্ত বাবুল মিয়াকে গ্রেপ্তারে ১৫ দিন লেগেছে পুলিশের।
মনে পড়ে গেল, কোহিনূরকে ধর্ষণ ও হত্যার অভিযোগে শাস্তি হওয়া চার আসামির মধ্যে একজনের যাবজ্জীবন ও দুজনের সাত বছরের সাজা হয়। তারা সাজা খেটে ফিরে আসার পর গ্রামের বাজারে ওদেরকে কোনো চায়ের দোকানে ঢুকতে দেখলে অনেকেই উঠে চলে যেত।
হতে পারে-ওই মানুষগুলো কোহিনূরের জায়গায় নিজের কন্যা, সহোদরা, স্বজনকে ভেবে উঠে যেত। প্রসঙ্গটা টানলাম এই কারণে যে, আমাদের চুরি যাওয়া চেতনা, বোধগুলো ফেরাতে হবে।
কথা আরও আছে-নারীকে উপস্থাপনের ভঙ্গি ও দৃষ্টিভঙ্গিগুলো বদলানো দরকার। সাধারণ মানুষ থেকে গণমাধ্যম, সংবাদপত্র, টিভি চ্যানেল, বিলবোর্ড, চলচ্চিত্র- সবক্ষেত্রে এ দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হওয়া চাই।
নারী শরীরী, তাই তাকে বিলবোর্ডে, বিজ্ঞাপনে, ছবিতে রমণীয়, লোভনীয় করে উপস্থাপন করার প্রাচীন এ মিথ বদলাতে হবে। কারণ নারীকে ক্রমে বস্তুতে, পণ্যে পরিণত করে উপস্থাপনের যে বেহিসাবি ভুল, তারই মাশুল দিতে হয় বিউটি-তনুদের।
বলার অপেক্ষা রাখে না যে, অপরাধের বিচার না হলে, অপরাধীরা শাস্তি না পেলে তা অপরাধপ্রবণতাকে আরও উসকে দেয়। তাই অপরাধের দ্রুত বিচার ও শাস্তি নিশ্চিত করার কোনো বিকল্প নেই।
যখন একটি ধর্ষণ, খুন বা এরকম অপরাধের ঘটনা ঘটে তার সঙ্গে যারাই জড়িত থাকুক না কেন অপরাধীদের দ্রুত আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
লেখক : কবি, কলামিস্ট ও সাংবাদিক
সহযোগী সম্পাদক, আওয়ার ইসলাম টোয়েন্টিফোর ডটকম
[email protected]
০৩ এপ্রিল ২০১৮