সৈয়দ ফয়জুল আল আমীন : দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি নেই বহুল আলোচিত ও প্রত্যাশিত তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সম্ভাব্য সফর বিষয়ে। যদিও বাংলাদেশ আগেই বলে দিয়েছে, তিস্তা ইস্যুতে বল ভারতের কোর্টে। কিন্তু সেই তিস্তা চুক্তি সইয়ের জন্য ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার ওই দেশটিতে অভ্যন্তরীণ ঐক্য সৃষ্টির প্রয়োজনীয়তার কথা বলে আসছে। জোরাল উদ্যোগের অভাবে যে ঐকমত্য এখনো অর্জিত হয়নি।
গত মাসে ভারতের একটি ইংরেজি দৈনিকে চলতি বছরে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশসহ প্রতিবেশী কয়েকটি দেশে সফরের কথা প্রকাশিত হলেও সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা এ বিষয়টি নিশ্চিত করেননি।
ঢাকা ও দিল্লির কূটনীতিকরা বলেছেন, গত বছর এপ্রিল মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের পর ফিরতি সফরে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশে আসার কথা। এ সফর থেকে কী ফলাফল আসে সেদিকে দুই দেশেরই দৃষ্টি থাকবে, বিশেষ করে তিস্তার বিষয়ে অগ্রগতি দেখার প্রত্যাশায় থাকবে বাংলাদেশ।
ভারতের সিকিম ও পশ্চিমবঙ্গ হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে তিস্তার জলধারা। বাংলাদেশের দাবি, গরমের সময় তিস্তার পানি প্রয়োজনীয়। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আগেই জানিয়েছেন, বাংলাদেশের প্রতি আবেগ থাকলেও কোনো পরিস্থিতিতে এই পানি দেওয়া সম্ভব নয়। কারণ তিস্তাতে এমনিতেই কি না পানির ঘাটতি আছে। শুকনো মওসুমে ঘাটতি আরও বেড়ে যায়। অবশ্য এর পরিবর্তে তিনি বাংলাদেশকে তোর্ষার জল নিতে অনুরোধ করেছেন।
উল্লেখ্য, গত বছর এপ্রিল মাসে শেখ হাসিনার নয়াদিল্লি সফরের সময় নরেন্দ্র মোদি বলেছিলেন, শুধু তাঁর ও শেখ হাসিনার সরকারই তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি করতে পারে। এদিকে, সম্প্রতি নয়াদিল্লিতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি মো. আব্দুল হামিদকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী জানিয়েছেন, তিস্তা জলবণ্টন চুক্তিতে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে রাজি করাতে কেন্দ্রীয় সরকার বিশেষ উদ্যোগ নিচ্ছে। প্রকৃতঅর্থে, এ উদ্যোগের শেষ হবে কবে তা বলা মুশকিল।
গণমাধ্যমে প্রকাশ, এ মাসে যুক্তরাজ্যের লন্ডনে অনুষ্ঠেয় কমনওয়েলথ সরকারপ্রধান পর্যায়ের সম্মেলনে বাংলাদেশ ও ভারতের প্রধানমন্ত্রীরা যাচ্ছেন। তবে কি সেই সম্মেলনের ফাঁকে দ্বিপক্ষীয় কোনো বৈঠক হতে পারে? অবশ্য এর আগে আগামী ৮ এপ্রিল দ্বিপক্ষীয় সফরে বাংলাদেশে আসছেন ভারতের পররাষ্ট্রসচিব বিজয় কেশব গোখলে। ওই সফরের সময় দুই দেশের মধ্যে পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের বৈঠকে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক পর্যালোচনার পাশাপাশি পারস্পরিক প্রত্যাশা তুলে ধরা হবে বলে শোনা যাচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে, তাতে কি তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তির কোনো অগ্রগতি হবে?
প্রসঙ্গত, ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ নদী কমিশন গঠনের পর তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। ১৯৮৩ সালের জুলাই মাসে দুই দেশের মন্ত্রিপরিষদের এক বৈঠকে তিস্তার পানি বণ্টনে শতকরা ৩৬ ভাগ বাংলাদেশ ও ৩৯ ভাগ ভারত এবং ২৫ ভাগ নদীর জন্য সংরক্ষিত রাখার বিষয়ে একটি সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। কিন্তু ওই সিদ্ধান্তে তিস্তার পানিপ্রবাহের পরিমাণ, কোন কোন জায়গায় পানি ভাগাভাগি হবে-এসব বিষয় উল্লেখ না থাকায় তা আর আলোর মুখ দেখেনি।
২০০৭ সালের ২৫ থেকে ২৭ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত একটি বৈঠকে বাংলাদেশ তিস্তার পানির ৮০ ভাগ দুই দেশের মধ্যে বণ্টন করে বাকি ২০ ভাগ নদীর জন্য রেখে দেয়ার জন্য প্রস্তাব দেয়। কিন্তু ভারত সেই প্রস্তাব গ্রহণ না করে উল্টো তিস্তার কমান্ড এরিয়া তাদের বেশি-এই দাবি তুলে বাংলাদেশ তিস্তার পানির সমান ভাগ পেতে পারে না বলে যুক্তি দেখায়। শুধু তাই নয়, ভারত তিস্তা ব্যারেজ প্রকল্পের সেচ এলাকা কমিয়ে দ্বিতীয় প্রকল্প বাতিল করার জন্য চাপ দেয়।
পরবর্তী সময়ে ভারত এক চিঠিতে তিস্তার মাত্র ২০ ভাগ পানি ভাগাভাগি করার বিষয়টি জানিয়ে দিয়ে চরম হটকারিতার আশ্রয় নেয়। ফলে শুষ্ক মৌসুমে পানিশূন্য হয়ে তিস্তা হয়ে যায় মরুভূমি। আর কারণে- অকারণে বর্ষাকালে গাজলডোবার গেট খুলে তিস্তায় পানি ছেড়ে দিলে বন্যায় তিস্তার তীর ও আশপাশের অর্ধকোটি মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়ে।
যতটা জানা গেছে, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তিস্তা চুক্তি ইস্যুতে এক চুলও নড়েননি। তাই মমতার সম্মতি ছাড়া মোদির পক্ষে তিস্তা চুক্তি করা অসম্ভব। মমতা এখন মোদির বিরুদ্ধে রাজনৈতিক লড়াই জোরদারের চেষ্টা চালাচ্ছেন। তাই খুব শিগগিরই এ বিষয়ে অগ্রগতির সম্ভাবনা ক্ষীণ।
তাছাড়া মমতা যে মোদিকে তিস্তার কৃতিত্ব দেবেন না তা এক প্রকার নিশ্চিত বলেই ধরে নেওয়া যায়! কারণ বাংলাদেশের সঙ্গে অমীমাংসিত ইস্যু নিষ্পত্তি করার কৃতিত্ব নেওয়ার চেষ্টা ভারতের রাজনৈতিক দলগুলোতেও আছে। যেমন, মনমোহন সিংয়ের নেতৃত্বাধীন ভারতের ইউপিএ সরকার অনেক চেষ্টা করেও বাংলাদেশের সঙ্গে স্থলসীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়ন করতে পারেনি। তখন ভারতের পার্লামেন্টে মূল বাধা সছিল বিজেপি। পরে ক্ষমতায় এসে বিজেপি সেই বিলের পক্ষে অবস্থান নেয় এবং তা সর্বসম্মতিক্রমে পাস করায়।
বলতে চাচ্ছি, বাংলদেশের সাথে স্থলসীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নের মূল কৃতিত্ব নিয়েছেন নরেন্দ্র মোদি। এমন বাস্তবতায় ভারতে বর্তমান রাজনৈতিক যে সমীকরণ, তাতে মমতা তিস্তা চুক্তি সইয়ের কৃতিত্ব মোদিকে দেবেন কেন? আর এ প্রশ্নের জট যতদিন না খুলছে, ততদিন হতে পারে আমাদের অপেক্ষাই করে যেতে হতে পারে!
লেখক : কবি, কলামিস্ট ও সাংবাদিক
সহযোগী সম্পাদক, আওয়ার ইসলাম টোয়েন্টিফোর ডটকম
[email protected]
০১ এপ্রিল ২০১৮