শাহনাজ শারমিন : একটি জাতির পুনর্গঠন ও সমৃদ্ধির জন্য মূল সম্পদ। জন্মের পর থেকে শিশুর বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সঠিক বৃদ্ধি হল শারীরিক বিকাশ। আর মানসিক বিকাশ হল আচার ব্যবহার, চিন্তা চেতনা, কথা বলা, অনুভূতি ও ভাবের আদান-প্রদানের ক্ষমতা অর্জন। একটি শিশুর জন্ম থেকে পাঁচ বছর বয়সের মধ্যেই এই তিনটি কাঠামো তৈরি হয়ে যায়। আর শিশুর এই বিকাশের পর আসে কিশোর বয়স তারপরই বয়ঃসন্ধির সময়।
বয়ঃসন্ধিকাল। ১০ বছর এবং ১৯ বছর বয়সের মাঝামাঝি সময়টাকে বয়ঃসন্ধিকাল বলে। মানুষের জীবন শুরুর অর্থাৎ সাধারণভাবে জন্ম থেকে ১০ বছর পর্যন্ত সময়টাকে শৈশব বলে। বয়ঃসন্ধিকাল জীবনের সন্ধিলগ্ন এবং যে কোনো সন্ধিলগ্ন পরিবর্তনের আভাস নিয়ে আসে। বয়ঃসন্ধিকালে দৈহিক বিকাশ ও পরিবর্তনের সঙ্গে মানসিক বিকাশও প্রায় সমান্তরালভাবে চলে।
এছাড়া বয়ঃসন্ধিকালে কিশোরের প্রাক্ষোভিক ও সামাজিক বিকাশেরও বহিঃপ্রকাশ ঘটে। বয়ঃসন্ধিকালই একজন ব্যক্তিকে যৌন পরিণতির দিকে ধাবিত করে শারীরিক, মানসিক ও প্রাক্ষোভিক বৈশিষ্ট্যের পরিবর্তনের ভিত্তিতে বয়স্ক ব্যক্তিরূপে চিহ্নিত করে।
শরীর-মনে নতুন কিছুর হাতছানি। নিজের পরিবর্তনে নিজেই চমকায়। বয়ঃসন্ধিকালের মতো এতো নাজুক সময় আর আসে না। বয়ঃসন্ধিকালের আগমনে দ্রুত শারীরিক পরিবর্তন ঘটে। বয়ঃসন্ধিকালের একজন কিশোর বা কিশোরী শিশুও নয় আবার বয়স্কও নয়। সে এক অদ্ভুত দশা। এ বয়সের কিশোর-কিশোরীরা জীবন ও জগতকে জানতে চায়।
বয়ঃসন্ধিকালে দেহের মাংসপেশি, হাড়, গ্রন্থি, মস্তিষ্ক, হৃৎপিণ্ড, বাকযন্ত্র, শরীরের ওজন ও দৈর্ঘ্য বাড়ে। এ সময় রক্ত সঞ্চালন, শ্বাস-প্রশ্বাস ও পাকস্থলীর ক্ষমতা বাড়ে। বয়ঃসন্ধিকালের দৈহিক পরিবর্তন কিশোর মনে বিপর্যয় আনে এবং চলনের ও মেলামেশার স্বাচ্ছন্দ্য নষ্ট হয়ে যায়। এ সময় তারা নিঃসঙ্গ বোধ করে এবং আত্মসচেতন, ভাবপ্রবণ ও অন্তর্মুখী হয়ে ওঠে। বয়ঃসন্ধিকালে ছেলেমেয়েদের বর্ধনের হার সমান হয় না। বয়ঃসন্ধিকালের প্রথমদিকে ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের বৃদ্ধি বেশি হয়।
বয়ঃসন্ধিকাল ছেলেমেয়েদের জন্য নতুন জগৎ। প্রত্যেক মানুষকেই এ অভিজ্ঞতা অর্জন করতে হয়। এ সময় ছেলেমেয়েদের মন মেজাজ খুব ওঠানামা করে। এই ভালোবাসতে ইচ্ছে করছে তো পরক্ষণেই আবার খুব খারাপ লাগছে। এক্ষুণি কোনো সিদ্ধান্ত নিলো তো পরক্ষণেই তার পরিবর্তন। মনে হয়তো দারুণ খুশি, কিন্তু একটু পরেই ঘন বিষাদ। আশঙ্কা, অনিশ্চয়তা ও অর্ন্তদ্বন্দ এ বয়সের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এ সব আবেগ কখনো কখনো সংঘাতের রূপ নেয়। দৈহিক ও মানসিক পরিবর্তনের ফলে কিশোর অনেক সময় অসহায় বোধ করে।
অনেক ক্ষেত্রে পরিবার উপযুক্ত মর্যাদা দেয় না। হঠাৎ করে এরা বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। অনেক সময় মা-বাবার আদেশ-উপদেশকেও গ্রাহ্য করতে চায় না। এছাড়াও এরা একাকী ঘরে দরজা বন্ধ করে সময় কাটাতে চায়। ফ্যাশন সচেতন হয়ে ওঠে। হঠাৎ করে রেগে যায়। নির্ঘুম রাত কাটায়। ঠিকমতো খেতে চায় না। কখনো কখনো হতাশা কাটাতে মাদকদ্রব্য, ফেসবুক, ইন্টারনেট ও পর্নো ছবিতে আসক্ত হয়ে পড়ে।
শুধু তাই না এদের অনেকেই অনিরাপদ দৈহিক সম্পর্কেও জড়িয়ে পড়ে। ফলে পড়ালেখার চরম অবনতির পাশাপাশি পুরো জীবনটাই সমস্যাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। ভেঙে যায় একটি পরিবারের স্বপ্ন। ধ্বংস হয়ে যায় সম্ভাবনাময় একটি কিশোরের জীবন।
এ বিশৃঙ্খলার পরিণাম হচ্ছে বিষাদগ্রস্ততা। ফলে অনেকের মধ্যে নিজেদের মাধ্যমে নিজেদের ক্ষতি করার ঝুঁকি বেড়ে যায়। আত্মহত্যার প্রবণতা জাগে। নিজেকে সবার কাছ থেকে গুটিয়ে রাখে। নিকটজনদের সাথে হিংসার আচরণ করে। স্কুল-কলেজে যাওয়া বন্ধ করে দেয়। এভাবেই একটি সম্ভাবনাময় জীবনের অপমৃত্যু ঘটে থাকে।
কাজেই এ কথা অবশ্যই বলা যায় যে, বয়ঃসন্ধিকাল মানব জীবনের অতি গুরুত্বপূর্ণ এক অধ্যায়। আমরা কি পারি না এ সমাজটাকে পরিবর্তন করতে? বয়ঃসন্ধিকাল নিয়ে আমাদের পরিবার, সমাজ, স্কুল-কলেজ, রেডিও, টেলিভিশন, মসজিদ, মাদরাসা, সংবাদপত্র, কোথাও তেমন কোনো প্রোগ্রাম নেই। আমাদের পরিবারগুলো এখনো কুসংস্কার আর অন্ধ শাসনের যাঁতাকলে নিষ্পেষিত। অভিভাবকদের অতি শাসনে সন্তানরা অনেক ক্ষেত্রে বিপথগামী হয়ে যায়।
বর্তমান সময়ে দিনে দিনে যৌথ পরিবারের সংখ্যা কমে যাচ্ছে এবং একক পরিবারের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। আবার বাবা-মা দুজনই চাকরি করার সুবাদে হয়তো সন্তানকে খুব বেশি সময় দিতে পারছেন না। এ কারণে পারিবারিক বন্ধন ও সন্তানের সাথে বাবা-মায়ের মানসিক যোগাযোগও কমে যাচ্ছে। তাই শিশু-কিশোরের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ ছাড়া শিশু তথা মানুষের পরিপূর্ণ বিকাশ সম্ভব নয়।
বাবা-মায়ের প্রভাব রয়েছে শিশুর মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর। নতুন এক গবেষণায় বলা হচ্ছে- যেসব পিতা-মাতা বিষণ্নতায় ভোগেন, তাদের সন্তানদের ওপর এর ব্যাপক প্রভাব পড়ে। বিশেষ করে মায়েদের তুলনায় বাবার হতাশা বা বিষণ্নতার প্রভাব বেশি পড়ে।
দু’টি একাডেমিক জার্নাল Early Childhood Research Quarterly ও Infant and Child Development এ প্রকাশিত গবেষণায় এ তথ্য জানানো হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, সন্তানের আচরণগত বহিঃপ্রকাশ ও সামাজিক আচরণে বাবা-মায়ের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বয়ঃসন্ধিকালে সন্তানের প্রতি মা-বাবার আচরণ কেমন হওয়া উচিত
বিভিন্ন গবেষণায় বলা হয়েছে, বয়ঃসন্ধিকালের সময়ে সন্তানের সবচাইতে বেশি প্রয়োজন বন্ধুত্ব। এ সময়ে কোনো বাধা-ধরা রূটিন কিংবা শাসন সন্তানের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। বাবা মায়ের এ সময় সন্তানের বিশ্বস্ত বন্ধু হওয়া প্রয়োজন। খুবই আবেগ প্রবণ মন থাকে এ সময়, তাই ভুলের মাত্রাটাও বেশি হয়ে থাকে।
অভিভাবক হিসেবে আপনাকেই এগিয়ে আসতে হবে, তাকে বোঝাতে হবে কোনটি সঠিক আর কোনটি সঠিক নয়। খুব অল্পতেই হতাশ হয়ে পড়ে মন এ সময়। বন্ধুত্বের হাতটি বাড়িয়ে তার মনের কথাগুলো শুনতে হবে, যে কথাগুলো সে হয়তো বলবে বলেও বলতে পারছে না সেই কথাগুলো শোনার পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে।
নিজেকে নিজের সন্তানের কাছে দুর্বোধ্য নয়, বরং সহজ সাবলীল করে গড়ে তুলুন। শাসনের পাশাপাশি বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখুন, যেন যেকোনো ধরনের গোপনীয়তা আপনার কাছে ধরা পড়ে। সন্তান যতো বেশী ভয় পাবে ততো বেশী দূরত্ব তৈরি হবে, অন্যদিকে শাসন না থাকলে সন্তান বিপথে পা দিতে ভয় পাবে না। তাই দুইয়ের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রেখে সন্তানের সাথে ঘনিষ্ট সম্পর্ক গড়ে তুলুন।
সন্তানের বয়ঃসন্ধিকালকে কখনোই নিজের বয়ঃসন্ধিকালের সঙ্গে তুলনা করে নৈমিত্তিকভাবে দেখতে যাবেন না। তাহলে নিজের সাথে ঘটা তিক্ত অভিজ্ঞতাগুলোও হয়ত সন্তানের সাথে ঘটবে। বয়ঃসন্ধিকালকে গুরুত্বের সাথে নতুন করে দেখুন এবং যতটুকু সম্ভব সন্তানকে মানসিক প্রশান্তিতে রাখার চেষ্টা করুন।
মনে রাখতে হবে যে, সন্তানের ব্যক্তিত্ব, মূল্যবোধ, আদর্শ গঠনে বাবা-মায়ের ভূমিকা অপরিসীম। তাই সন্তানকে আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে তাকে পর্যাপ্ত সময় দিন, তাকে আপনি কতটা ভালবাসেন এবং তাকে নিয়ে যে আপনি চিন্তা করেন এটা তাকে বুঝতে দিন। সন্তানের চলার পথে প্রতিটি পদক্ষেপে তার সঙ্গে চলার চেষ্টা করুন। আরএম/