সৈয়দ ফয়জুল আল আমীন
আজ ২৫ মার্চ বাঙালি জাতির জীবনে এক ঐতিহাসিক বিভীষিকাময় বেদনাবিধুর রাত। ১৯৭১ সালের আজকের রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নিরস্ত্র, নিরপরাধ ও ঘুমন্ত সাধারণ বাঙালির ওপর যে নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে, যা পৃথিবীর ইতিহাসে এক ঘৃণ্যতম গণহত্যার নজির হয়ে আছে।
বর্বর হত্যাযজ্ঞের এ দিনটি গত বছর থেকে ‘গণহত্যা দিবস’ হিসেবে পালিত হচ্ছে। দিবসটি আন্তর্জাতিকভাবে পালনের জন্য স্বীকৃতি আদায়ের কাজও চলছে। একাত্তরের ২৫ মার্চ কালরাত স্মরণে আজ রাত ৯টা থেকে ৯টা ১মিনিট পর্যন্ত জরুরি স্থাপনা ব্যতীত সকল জায়গায় ‘ব্ল্যাক-আউট’ কর্মসূচি পালন করা হয়।
এক মিনিটের জন্য অন্ধকার হয়ে যায় পুরো বাংলাদেশ। সারাদেশ এক মিনিটের জন্য স্তব্ধ হয়ে যায়। চলন্ত গাড়ি ওই সময় থেমে যায়। হেঁটে চলা মানুষ থেমে যায়। অবশ্য সব ধরনের জরুরি সেবা যেমন হাসপাতাল, ফায়ার সার্ভিস ইত্যাদি এ কর্মসূচির আওতার বাইরে ছিল।
১৯৭১ সালের এই রাতে মুক্তিকামী নিরস্ত্র বাঙালির ওপর বর্বরোচিত হামলা চালায় রক্তপিপাসু হিংস্র পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে এ রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী মৃত্যুপুরীতে পরিণত করেছিল পুরো ঢাকা শহরকে।
দেশের বিভিন্ন স্থানে নিরীহ, নিরস্ত্র মানুষদের ওপর চালায় গণহত্যা ও বর্বর নির্যাতন। তাদের হাত থেকে রেহাই পাননি শিক্ষক, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী, নারী, শিশু, দিনমজুরসহ কোনো শ্রেণি-পেশার মানুষ। মুক্তিকামী বাঙালি জাতির স্বাধীনতা ঘোষণার ঠিক আগ মুহূর্তে হায়েনার হিংস্র নখরে ক্ষতবিক্ষত হয়েছিল মানবতা।
১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ জনগণের ভোটে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের পরও তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ক্ষমতা হস্তান্তরে গড়িমসি করতে থাকে।
বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধুর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে আলোচনার নামে গোপনে সামরিক প্রস্তুতি নিতে থাকে।
কিন্তু ক্ষোভে ফেটে পড়ে বাংলার মানুষ। বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যান) স্বাধীনতার দিক-নির্দেশনামূলক ঐতিহাসিক এক ভাষণ দেন। যা প্রকৃতপক্ষে ছিল বাঙালির মুক্তি সংগ্রামের মূলমন্ত্র। শুরু হয় বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে অসহযোগ আন্দোলন।
এরই ধারাবাহিকতায় এই রাতে নৃশংস এক হত্যাযজ্ঞের পরিকল্পনা করে হানাদার বাহিনী। এ রাতে ইয়াহিয়ার লেলিয়ে দেওয়া বাহিনী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাস, শিক্ষক কলোনি, রাজারবাগ পুলিশ লাইন্স, ইপিআর (ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস) ব্যারাকসহ বিভিন্ন আবাসিক এলাকা এবং বস্তিবাসী, ঘুমন্ত মানুষের ওপর আক্রমণ চালিয়ে শুরু করেছিল বিশ্ব ইতিহাসের এক নজিরবিহীন গণহত্যা, নিপীড়ন ও অত্যাচার।
২৫ মার্চ রাতের হত্যাযজ্ঞে স্তম্ভিত হয়ে পড়েছিল বিশ্ববিবেক। তবে, বর্বরতার বিপরীতে প্রতিরোধে জেগে ওঠতে বেশি সময় নেয়নি অদম্য বাঙালি। বাঙালি জাতির এগিয়ে যাওয়ার মুহূর্তে স্বাধীনতার আকাক্সক্ষাকে ধূলিসাৎ করতে হানাদার বাহিনী এ হত্যাযজ্ঞ শুরু করলেও নির্যাতিত মানুষের প্রতিরোধ স্পৃহার স্ফূলিঙ্গ এ রাত থেকেই দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে।
সাধারণ মানুষের পাশাপাশি প্রতিরোধে এগিয়ে আসে সেনাবাহিনী ও পুলিশের বাঙালি সদস্যরা। শুরু হয় প্রতিরোধ যুদ্ধ। এরই ধারাবাহিকতায় নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধে অর্জিত হয় স্বপ্ন সাধের স্বাধীনতা। বিশ্বের মানচিত্রে মাথা উঁচু করে দাঁড়ায় লাল-সবুজের স্বাধীন ভূখণ্ড, স্বাধীন বাংলাদেশ।
প্রসঙ্গত, পরিকল্পনা অনুযায়ী অপারেশন সার্চলাইট শুরুর জন্য ২৫ মার্চ রাত সাড়ে ১১টায় ছাউনি থেকে বেরিয়ে আসে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। ফার্মগেটের মুখে হানাদার বাহিনী প্রথম প্রতিরোধের মুখোমুখি হয়। সেখানেই তারা চিৎকার করে পুরো ঢাকায় কারফিউ ঘোষণা করে। ছাত্র-জনতা বাধা দিলে পাখিরমতো গুলি করে হত্যা করে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের। ডিনামাইটের মাধ্যমে ব্যারিকেড উড়িয়ে দিয়ে শহরে প্রবেশ করে সেনারা। রাস্তায় রাস্তায় শুরু হয় ব্যারিকেড।
প্রতিরোধকারী বাঙালি যোদ্ধাদের বিরুদ্ধে ট্যাংক, মর্টার, রকেট ব্যবহার করে সেনাবাহিনী। শুরু হয় চারদিকে গোলাগুলির বিস্ফোরণ, মানুষের আর্তচিৎকার। এরই মধ্যে হানাদাররা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাসভবনে হানা দেয়। বাসভবনে ঢুকে এলোপাতাড়ি গুলি চালাতে থাকে। রাতেই বঙ্গবন্ধুকে বন্দি করে সেনানিবাসে নিয়ে যাওয়া হয়। অবশ্য গ্রেপ্তারের আগেই বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ও সশস্ত্র মুক্তি সংগ্রামের ঘোষণা দেন।
মধ্যরাতে সেনাবাহিনী পিলখানা, রাজারবাগ ও নীলক্ষেত আক্রমণ করে। হানাদার বাহিনী পিলখানা ও নীলক্ষেতে প্রচণ্ড প্রতিরোধের মুখোমুখি হয়। পাকিস্তানি সেনারা ট্যাংক, মর্টারের মাধ্যমে নীলক্ষেতসহ বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা দখল করে ফেলে।
প্রচণ্ড লড়াইয়ের পর পিলখানার ইপিআর ব্যারাকের পতন হয়। রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে হানাদার বাহিনীর সঙ্গে প্রতিরোধযুদ্ধে নিহত হন অসংখ্য পুলিশ সদস্য। সেনাবাহিনীর মেশিনগানের গুলিতে, ট্যাংক-মর্টারের গোলায় আগুনের লেলিহান শিখায় একদিকে নগরীর রাত হয়ে ওঠে বিভীষিকাময়।
‘পদ্মা অববাহিকার আকাশ ছেয়ে গেছে শকুনে শকুনে। ইতিমধ্যেই আড়াই লাখ বাঙালির লাশ তারা পেয়েছে খাদ্য হিসেবে। কুয়োর জলে, খানা খন্দে, কচুরিপানার নিচে শিশু সন্তানের চোখের সামনে পচছে পিতা-মাতার লাশ।’ ঢাকা থেকে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের গণহত্যার চিত্র এভাবেই তুলে ধরেছিলেন এপির সংবাদদাতা।
শুধু এপিই নয়, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের গণহত্যার খবর প্রথম ছড়িয়ে দিয়েছিল বেশ কয়েকটি প্রভাবশালী গণমাধ্যম। তারাই বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরেছিল সেই সময়ের পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর নৃশংসতার চিত্র।
যে কারণে ইয়াহিয়ার জারি করা ৭৭ নম্বর সামরিক বিধির মাধ্যমে প্রথম রাশ টেনে ধরা হয় গণমাধ্যমের। এটা ছিল কেবল শুরু মাত্র। এরপরই সেই সময়ে শুরু হয় একের পর এক আইন প্রণয়ন। যেগুলো ক্ষতিগ্রস্ত করতে থাকে সঠিক তথ্যসংগ্রহ ও প্রকাশ প্রক্রিয়া।
প্রকৃতঅর্থে, এ রাতের বিসর্জিত রক্তের ওপর দিয়েই পরদিন সূর্যোদয়ের মধ্য দিয়ে সূচিত হয় নতুন প্রতিজ্ঞার ইতিহাস, শুরু হয় মুক্তির জন্য যুদ্ধ। নয় মাস বাঙালির মরণপণ যুদ্ধে অর্জিত হয় রক্তের পতাকা।
স্বাধীনতাকামী মানুষের রক্তভেজা ২৫ মার্চ তাই বাংলাদেশের মানুষের কাছে তাৎপর্যপূর্ণ একটি ক্ষণ। এ দিনে শুরু হওয়া রক্তের স্রোতে ভেসেই জন্ম হয় স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের।
লেখক : কবি, কলামিস্ট ও সাংবাদিক
সহযোগী সম্পাদক, আওয়ার ইসলাম টোয়েন্টিফোর ডটকম
[email protected]
২৫.০৩.২০১৮