সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪ ।। ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬


মোশাররফ করিমের বিতর্কিত বক্তব্য; পেছনের দৃশ্যে কারা?

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

এম ওমর ফারুক আজাদ
আলেম ও সাংবাদিক

ছোট পর্দার অভিনেতা মোশাররফ করিম। যে কোন চরিত্রে যুতসই নাটক করে কেড়েছেন দর্শক জনপ্রিয়তা। কিন্তু হঠাত করে তিনি হয়ে উঠলেন সমালোচিত।

চ্যানেল২৪ এ জাগো বাংলাদেশ নামের একটি লাইভ প্রোগ্রামে অংশগ্রহণ করেন এ অভিনেতা। অনুষ্ঠানটির স্পন্সর করেছে স্টিল কোম্পানি বিএসআরএম।

এতে মোটিভেশন স্পিচ দিতে গিয়ে এক সময় মোশাররফ করিম ধর্ষণের কারণ নিয়ে আলোচনা করেন। আলোচনার এক পর্যায়ে তিনি যুক্তি পেশ করেন ধর্ষণের জন্য মানুষের মানসিকতাই দায়ী। পোশাক এতে একেবারেই দায়ী নয়।

তিনি বলেন, একজন নারী কি স্বাধীনভাবে তার পোশাকটিও পরতে পারবে না?

ধর্ষণের জন্য যদি পোশাকই দায়ী হয় তাহলে সাত বছরের শিশুটির ক্ষেত্রে আপনি কি জবাব দিবেন? যে নারীটা বোরকা পরেন তার ব্যাপারে কী যুক্তি দিবেন? অথচ তারাও ধর্ষিতা হচ্ছেন।

তিনি বলেন, ধর্ষণের জন্য মানুষের মানসিকতাই দায়ী তার পক্ষে তিনি ইমাম গাজালী রাহ. এর একটি উদ্বৃতি দিয়ে বলেন, মানুষের ভেতরে তেরোটি শত্রু রয়েছে। আর সর্বপ্রথম এগুলোর বিরুদ্ধে জিহাদের কথা বলা হয়েছে।

তিনি তার এই বক্তব্যের মাধ্যমে সু কৌশলে পর্দার বিপক্ষে অবস্থা নিয়েছেন। তাই তার এই আলোচনা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চলছে তুমুল আলোচনা ও সমালোচনা। তার অনেক ভক্তকে অনাস্থা প্রকাশ ও ভালোবাসা তুলে নেবার ঘোষণার মতো পোস্টও করতে দেখা গেছে।

অবশ্য তিনি বিষয়টি নিয়ে পরে তার ভেরিফাইড ফেসবুক পেজে ক্ষমা চেয়েছেন।

প্রদত্ত বক্তব্য নিয়ে সবাই মোশাররফ করিমের সমালোচনা করলেও আড়ালে রয়েছে গেছে কারা তার দ্বারা এসব বলিয়েছে ও অসংখ্য সেলিব্রিটি দিয়ে বলাচ্ছে।

অনুষ্ঠানের আয়োজক ছিলো জাগো বাংলাদেশ আর স্পন্সর করেছিলো স্টিল কোম্পানি BSRM।

একটা বিষয় আমাদের বুঝতে হবে গ্লোবালাইজেশনের যুগে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো পন্যের ব্যবসার পাশাপাশি সংস্কৃতি ও মতবাদেরও সওদা করে। গ্লোবালাইজেশন এর প্রবক্তাদের দর্শন, সংস্কৃতি ও মতবাদ প্রচারে ব্রতি হলেই কেবল গ্লোবাল অবাধ বাণিজ্য তাদের জন্য উন্মুক্ত।

তাই তারা নাটক, সিনেমা, ক্রিড়া ও মডেলিং জগতে আগে কিছু মানুষ তৈরি করে। ক্রমান্বয়ে তাদের প্রমোট করে জনপ্রিয় করে তোলে। তারা ভক্তদের আস্থার এমন স্থানে নিয়ে যায় যে ভক্তরা তাদের অনুসরণ করতে থাকে।

পর্দা নিয়ে যা বলেছিলেন মোশাররফ করীম

এভাবে জনপ্রিয়তার শীর্ষে নিয়ে যাওয়ার পর তাদের মাধ্যমে কোম্পানি ও গ্লোবাল মোড়লদের অপসংস্কৃতি ও মতবাদের বিষবাষ্প গলধকরণ করায়।

এভাবে তারা যুব সমাজকে মোটিভেট করে থাকে। মোশাররফ করিমও তাদের সেই এজেন্ডার একজন।

আজ তাকে দিয়ে এমন বক্তব্য দেয়ানো হয়েছে কাল দেখবেন ক্রিকেট, নাটক, সাহিত্যে আপনার জনপ্রিয় কাউকে দিয়েও এসব কথা বলানো হচ্ছে। আজ যেভাবে অবাক হয়েছেন সেদিনও অবাক না হয়ে পারবেন না।

তিনি বলেছেন ধর্ষণের জন্য মানসিকতা দায়ী। হ্যাঁ আমরা স্বীকার করি মানসিকতা দায়ী? কিন্তু মানসিকতার জন্য কে দায়ী? এ জিনিসটা ক্লিয়ার করেননি তিনি।

মানসিকতার জন্য কে/কি/কারা দায়ী তা স্পষ্ট হলেই পোশাক বা পর্দা নারীদের সম্ভ্রমের কতটা রক্ষা কবচ তা বুঝে আসবে। আমরা মানি ধর্ষণের জন্য পোশাক দায়ী। কিন্তু এই মানসিকতার জন্য অনেকাংশে দায়ী মিডিয়া ও চলচিত্রও।

এখন মিডিয়া ও চলচিত্র নারীদের উপস্থাপন করছে পুরুষের চিত্ত বিনোদন হিসেবে। সিনেমা ও নাটকে এখন পোশাকের কোনো শালিনতা বজায় রাখা হয় না। যে মডেল বা অভিনেত্রী যত বেশি যৌন আবেদনময়ী হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করবে সে ততো পপুলার হয়ে যায়।

সুন্দরী প্রতিযোগিতার নামে চলছে রমরমা দেহ প্রদর্শনী। ‘দেখিয়ে দাও তোমার অদেখা’ স্লোগানে নারীর সেই অদেখা অঙ্গগুলো সুড়সুড়িমূলক উপস্থাপন করা হয়। ফিল্মে যৌন উন্মাদনাময় দৃশ্যের অবতারণা ইত্যাদি পুরুষদের মানসিকতায় কামোদ্দিপনা সৃষ্টি করে।

স্বভাবত জেগে উঠে যৌন উন্মাদনা। তখন সে নাটক ফিল্মে যে লাবণ্যময়ীনিকে দেখছে তাকে তো আর কাছে পাচ্ছেন না তার এই চাহিদা নিবারণের জন্য। ফলে ক্রমশ সে উদ্যত হয়ে উঠে, পাগল হয়ে উঠে যৌন চাহিদা মেটাতে। যার কারণে সে সুযোগ খুঁজতে থাকে শিকারের।

স্বভাবতই যারা অর্ধবসনে রাস্তায় বের হয় তারাই তার টার্গেটে থাকে। তাদের দেখে তার প্রবৃত্তি আরো উসৃঙ্খল হয়ে উঠে। যদিও তাতেও সুবিধা না হয় তবে সে আরো লাগামহীন উন্মাদ হয়ে উঠে।

ফলে তার কাছে কার পোশাক কেমন, কে বোরকা পরলো, কোন মেয়ের বয়স কত তা তখন তার কাছে ধর্তব্য থাকে না। বরং সে একজন নারী, সেই যৌন চাহিদা মেটানোর বিপরীত লিঙ্গ এটা তার কাছে মূখ্য। ফলে সমাজে ঘটে নারী নির্যাতন ও ধর্ষণের হিড়িক।

আবার পোশাকও অধিকাংশ দায়ী ধর্ষণের জন্য। বিড়ালের সামনে মাছ রেখে এসে বিড়ালকে মাছ খাওয়ার জন্য দোষারুপ করা ও অর্ধবসনে বের হয়ে যৌন নিগ্রহের জন্য পুরুষকে দায়ী করা একই ধরনের বোকামি। কারণ মানুষের ভেতর কামভাব এক প্রকৃতিগত বিষয়। একে নিয়ন্ত্রণের জন্য অবশ্যই কিছু ফর্মূলা মানা জরুরি।

আল্লাহ রাব্বুল আলামীন নারীদের বলেছেন, পর্দাবৃত অবস্থায় থাকতে আর আপনি মনের পর্দা আসল পর্দা বলে বস্তুত কুরআনের বিপক্ষে অবস্থান নিচ্ছেন।

আল্লাহ বলেন, ‘হে নবী (সল্লাল্লাহু আলাইহিওয়া সাল্লাম)! মুমিন পুরুষদের বলে দিন, তারা যেন নিজেদের দৃষ্টি সংযত করে রাখে এবং নিজেদের লজ্জাস্থানের হেফাজত করে। এটি তাদের জন্য পূত-পবিত্র পদ্ধতি।  তারা যা কিছু করে, আল্লাহ তা জানেন। সুরা নূর, আয়াত-৩০

আর মুমিন মহিলাদের বলে দিন, তারা যেন তাদের দৃষ্টি সংযত করে রাখে এবং নিজেদের লজ্জাস্থানের হেফাজত করে। আর তারা যেন স্বীয় সাজসৌন্দর্য না দেখায়, তবে যা নিজে নিজে প্রকাশ হয়ে যায়।

তা ছাড়া তারা যেন তাদের মাথার ওড়না বক্ষদেশে ফেলে রাখে। এবং তা কারো সামনে তাদের সাজসৌন্দর্য প্রকাশ করবে না এই মাহরাম আত্মীয়গণ ব্যতীত যথা স্বামী, পিতা, শ্বশুর, পুত্র, ভ্রাতা ভ্রাতুষ্পুত্র, ভগ্নিপুত্র, স্ত্রীলোক, অধিকারভুক্ত, বাঁদী, নারীর প্রতি স্পৃহাহীন সেবক, ওই সব বালক যারা নারীর গোপনীয় বিষয় সম্পর্কে অবহিত হয়নি।

তারা যেন পথচলার সময় এমন পদধ্বনি না করে যাতে তাদের অপ্রকাশিত সৌন্দর্য পদধ্বনিতে প্রকাশিত হয়ে পড়ে। ‘হে মুমিনগণ! তোমরা সবাই আল্লাহর কাছে তওবা কর যাতে তোমরা সফলকাম হও।’ সুরা নূর, আয়াত-৩১।

লক্ষণীয়, আয়াতের এ অংশে আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন তারা যেন বক্ষদেশে নিজদের ওড়না ফেলে রাখে।’ ‘খুমুরুন’ শব্দটি ‘খিমার’ শব্দের বহুবচন। ‘খিমার’ ওই কাপড়কে বলা হয় যা নারীরা মাথায় ব্যবহার করে এবং তাদ্বারা মুখ, গলা ও বক্ষ পানি ভরা কুপের মতো আবৃত হয়ে যায়।

সুতরাং,মুখ, গলা আবৃত করার নির্দেশের দ্বারা চেহারা আবৃত করার র্নিদেশ প্রমাণিত হয়। কারণ, নারীর মুখমন্ডল তার যাবতীয় রূপ ও সৃষ্টিগত সৌন্দর্যের মূল উৎস ও আকর্ষণ।

কেউ যখন বিয়ের জন্য পাত্রী দেখে তখন মুখই দেখে। তাহলে এ মুখ কিভাবে পরপূরুষের সামনে উম্মুক্ত রাখা যেতেপারে?

মূলত: খুমুরুন শব্দ দ্বারা মুখ থেকে বক্ষদেশ পর্যন্ত ঢেকে দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। মাথার ওড়না দিয়ে বক্ষদেশ পর্যন্ত ঢাকতে হলে অবশ্যই মুখ ঢাকতে হবে। যা নিম্মে বর্নিত দলীল সমূহ দ্বারা আরো স্পষ্ট হবে।

মহান আল্লাহপাক এরশাদ করেন, ‘(হে নারীগণ!) তোমরা আপনগৃহে অবস্থান করো এবং জাহেলিয়াতের যুগের মতো সাজসজ্জা সহকারে অবাধে চলাফেরা করো না।’ সুরা আহজাব আয়াত-৩৩।

মহান আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন, ‘আর যখন তাদের কাছে তোমরা কিছু চাইবে, তখন (তারা) তোমাদের দৃষ্টির অন্তরালে হিজাব বা পর্দার ভেতরে অবস্থান করবে, আর তোমরা তাদের কাছে পর্দার বাইরে থেকে চাইবে। তোমাদের এ কাজ তোমাদের অন্তর ও তাদের অন্তরকে কুচিন্তার আবরণ থেকে উত্তমভাবে পাক-পবিত্র রাখার উপায় হবে।’ সুরা আহজাব; আয়াত-৫৩।

উম্মুল মু’মিনীন হযরত উম্মে সালমা আলাইহাস সালাম থেকেবর্ণিত হয়েছে, ‘আমি এবং মায়মুনা আলাইহাস সালাম রাসূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহিওয়া সাল্লাম -এর কাছে থাকাকালীন হঠাৎ অন্ধ সাহাবী আবদুল্লাহ্ ইবনে উম্মে মাকতুম তথায় আগমন করলেন। তিনি আমাদের বললেন, আপনারা কাছে পর্দা করো। এই ঘটনার সময়কাল ছিল পর্দার আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার পর। উম্মুল মু’মিনীন উম্মে সালমা আলাইহাস সালাম আরজ করলেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহিওয়া সাল্লাম তিনি তো অন্ধ, আমাদের দেখতে পাবেন না এবং আমাদের চেনেনও না।

রাসূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহিওয়া সাল্লাম বললেন, তোমরা তো অন্ধ নও, তোমরা তাকে দেখছো। (আবু দাউদ শরীফ, তিরমিযী শরীফ)

হজরত আলী আলাইহিস সালাম থেকে বর্ণিত রাসুলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘হে আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু প্রথম দৃষ্টির পর দ্বিতীয় দৃষ্টি যেন নিক্ষেপ করা না হয়। প্রথমটি ক্ষমার যোগ্য কিন্তু দ্বিতীয়টি নয়।’

উপরোল্লিখিত কুরআন ও হাদিসের ব্যাখ্যাকে অমান্য করে ‘ধর্ষণের জন্য পোশাক কোনোভাবেই দায়ী নয়, মানসিকতাই আসল পর্দা এমন স্লোগান দিয়ে সু কৌশলে ইসলামের ফরজ বিধানের বিরোধিতা করে যাচ্ছে তারা মূলত ইসলাম বিরোধি চক্রের এজেন্ট হয়ে কাজ করছে।

আল্লাহ পাক ওদের বুঝার তওফিক দিন। আমিন।

আরআর


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ