সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪ ।। ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬


দেশের ব্যাংক খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা হবে কি?

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

সৈয়দ ফয়জুল আল আমীন

আজকের লেখাটা প্রশ্ন দিয়েই শুরু করছি। কারণ প্রশ্নটা মনে ঘুরপাক খাচ্ছে দীর্ঘদিন ধরেই। প্রশ্নটা হচ্ছে-দেশে এত বেশি ব্যাংকের অনুমোদন কেন? তাতে কি ব্যাংক খাতের মান থাকছে? বেশি ব্যাংক হওয়ার ফলে সুশাসন নিয়েও প্রশ্ন ওঠছে।

দেশে এখন ৫৬টি ব্যাংক হয়েছে। কয়েক দিনের মধ্যে হয়ত দেখা যাবে কোটিপতি ব্যাংক দেওয়া হয়েছে! তারপর আস্তে আস্তে হয়ত পুলিশ অফিশিয়াল ব্যাংক, সাংবাদিক ব্যাংক, দরবার ব্যাংক, জননেতা ব্যাংক, বিসিএস ক্যাডার ব্যাংক, সরকারি চাকরিজীবী ব্যাংক-এভাবে একের পর এক ব্যাংকের অনুমতি দেওয়া হবে।

কিন্তু বাস্তবতা পর্যালোচনায় বলতে হয়, দেশে এখন ছোট ও দুর্বল ব্যাংক একীভূত করে দেওয়ার সময় এসেছে। বিশেষ করে সুশাসন নিশ্চিত করতেই কিছু ব্যাংক একীভূত করা দরকার।

অবশ্য ব্যাংক খাতে সুশাসন নিশ্চিত করতে হলে সব ধরনের নীতি অনুসরণেও ব্যাংকগুলোর সকল পর্যায়ে বাধ্য করতে হবে। বিশেষ করে পরিস্থিতি উন্নয়নে ব্যাংকগুলোকে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপমুক্ত রাখতে হবে। মনে রাখা চাই, ব্যাংক খাতের পরিবর্তন যদি রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত না হয়, তা হলে সেখান থেকে সুফল আসবে না।

প্রসঙ্গত, ২০১৫ সালে দেশের বড় বড় শিল্প গ্রুপসমূহ ১৫ হাজার কোটি টাকার ঋণ পুনর্গঠন করেছে, যার বেশিরভাগই আবার খেলাপী হয়েছে। বর্তমানে রাষ্ট্রায়াত্ত ব্যাংকগুলোতে বিতরণকৃত ঋণের প্রায় ২৫ শতাংশই খেলাপী আর বেসরকারি ব্যাংক খেলাপী ঋণের পরিমাণ প্রায় ১০ শতাংশ।

রিসিডিউল এবং পুনর্গঠন করা ঋণ হিসাবে আনলে এই খেলাপী ঋণের পরিমাণ আরও অনেক বেশি হবে। খেলাপী ঋণের কারণে ব্যাংকগুলোর স্বাভাবিক প্রবৃদ্ধি মুখ থুবড়ে পড়েছে এবং অর্থনীতির স্বাভাবিক প্রবৃদ্ধিও বাধাগ্রস্থ হয়েছে।

বর্তমানে রাষ্ট্রয়াত্ত ব্যাংকগুলো মূলধন ঘাটতিতে রয়েছে। হল-মার্ক, বিসমিল্লাহ গ্রপ কেলেংকারী, বেসিক ব্যাংক, ফারমার্স ব্যাংক কেলেংকারী আর সেন্ট্রাল ব্যাংকের রিজার্ভ চুরি এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে নিয়ম লংঘন করে অতিরিক্ত ঋণ প্রদানের ঘটনাসহ ব্যাংক সেক্টরের বিভিন্ন অপকর্ম জনগণের মাঝে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। ব্যাংক সেক্টরের প্রতি কিছুটা আস্থাহীনতা সৃষ্টি হয়েছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্যও ব্যাংক খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা জরুরি।

কথা আরও আছে, খেলাপী ঋণের কারণে ব্যাংকের ডিপোজিটররা তাদের ন্যায্য লভ্যাংশ থেকে বঞ্চিত হয়। অথচ এসব টাকা দেশের লাখো মানুষদের কষ্টার্জিত অর্থ। কিন্তু এসব টাকা আজ গুটি কয়েক মানুষের পকেটে ঢুকে আছে। বাংলাদেশে আজ যত টাকা খেলাপী ঋণ আছে, তা যদি খেলাপী না হতো, তাহলে শুধুমাত্র এই টাকা দিয়েই দেশে হাজারো স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, রাস্তা ঘাট, ব্রিজ, হাসপাতাল এবং বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা যেত।

এমন বাস্তবতায় বাংলাদেশ ব্যাংককে প্রয়োজনীয় আইন, গাইডলাইন এবং নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে। ব্যাংক সেক্টরের ওপর বাংলাদেশ ব্যাংকের সুপারভিশন, গাইডেন্স এবং মনিটরিং বাড়াতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকে দক্ষ জনবল নিয়োগ দিতে হবে এবং ব্যাংক সেক্টরের উন্নয়নের স্বার্থেই বাংলাদেশ ব্যাংককে শক্তিশালী করতে হবে।

এ খাতে আরও একটি গুরুতর অভিযোগ হচ্ছে, ব্যাংক সেবা পেতে গ্রাহকরা প্রতিনিয়তই নানা ধরনের হয়রানির শিকার হচ্ছেন। আর দিন দিন বাড়ছে এসব গ্রাহক হয়রানির অভিযোগ। গত এক বছরে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাস্টমার সার্ভিসেস বিভাগে (সিএসডি) ৫৭টি ব্যাংকের বিরুদ্ধে সাড়ে তিন হাজার অভিযোগ এসেছে।

বিশেষ করে চেক জালিয়াতি, অতিরিক্ত সার্ভিস চার্জ কর্তন, মিথ্যা তথ্য দিয়ে ব্যাংক থেকে অর্থ উত্তোলন, স্থায়ী আমানতের (এফডিআর) অর্থ ফেরত না দেওয়া, স্বীকৃত বিলের মূল্য পরিশোধ না হওয়া এবং ঋণ ও আমানত-সংক্রান্ত অভিযোগগুলো বেশি। এসব কি সুশাসনের অভাবে হচ্ছে বলে ধরে নেওয়া যায় না?

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, এফআইসিএসডি গৃহীত অভিযোগের সংখ্যাগত দিক থেকে শীর্ষে রয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংক। ব্যাংকটির অভিযোগ সংখা ৩৪৫টি। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে ব্র্যাক ব্যাংক। এরপরেই রয়েছে জনতা ব্যাংক, অগ্রণী, রূপালী, ডাচ-বাংলা, ইসলামী, দি সিটি ও ইস্টার্ন ব্যাংক। এ তালিকায় দশম স্থানে রয়েছে বিদেশি মালিকানার স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড।

জানা গেছে, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের গ্রাহকদের সর্বোচ্চ সেবা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ ব্যাংক ২০১১ সালের ১ এপ্রিল গ্রাহক স্বার্থসংরক্ষণ কেন্দ্র (সিআইপিসি) গঠন করে। পরিধি বাড়তে থাকায় পরে একে ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি অ্যান্ড কাস্টমার সার্ভিসেস (এফআইসিএসডি) নামে পূর্ণাঙ্গ বিভাগে রূপ দেওয়া হয়।

এ অবস্থায় ব্যাংক সেক্টরে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে এবং জনগণের আস্থা সৃষ্টি করতে হবে। আস্থাহীনতার কারণে জনগণ যদি ব্যাংকে টাকা জমা না রাখে, তাহলে কিন্তু ব্যাংকগুলো ডিপোজিট সমস্যায় পড়বে। ফলে ব্যাংকগুলো বিনিয়োগ করতে পারবে না এবং আয় করতে পারবে না।

বলতে চাচ্ছি, ব্যাংকের বিনিয়োগ বা ঋণ প্রবাহ কমে গেলে দেশের অর্থনীতিই সমস্যায় পড়বে। সুতরাং দেশের কল্যাণেই সুশাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ব্যাংক সেক্টরের উন্নতি ঘটাতে হবে। ব্যাংকগুলোতে পেশাদারিত্বের বিকাশ ঘটাতে হবে। জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। একই সাথে ব্যাংকগুলোতে সৎ এবং যোগ্য ব্যক্তিদেরকে নিয়োগ দিতে হবে।

লেখক : কবি, গবেষক ও সাংবাদিক
সহযোগী সম্পাদক, আওয়ার ইসলাম টোয়েন্টিফোর ডটকম

[email protected]
১৯.০৩.২০১৮


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ