সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪ ।। ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬


পানি নিয়ে ভারতের রাজনীতির শেষ কোথায়?

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

সৈয়দ ফয়জুল আল আমীন

স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের সাথে চুক্তি বা সমঝোতা ছাড়াই পরীক্ষামূলকভাবে গঙ্গার উপর ফারাক্কা ব্যারেজ চালু হয়। এর মধ্য দিয়ে ভারত বাংলাদেশকে পানির ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত করতে শুরু করে এবং যতই দিন যাচ্ছে তার প্রভাব ও বিস্তৃতি ততই বেড়েই চলেছে।

বলা যায়, একটি অসম পানিচুক্তি এবং চুক্তির যথাযথ বাস্তবায়নে ভারতের অনীহার কারণে বাংলাদেশের পদ্মার এখন মরণদশা।

গণমাধ্যমে প্রকাশ, গঙ্গার পানিবন্টন চুক্তি অনুযায়ী এবারও বাংলাদেশ পানি পাচ্ছে না।

পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সূত্রের বরাত দিয়ে পত্রিকান্তরে প্রকাশিত খবরে উল্লেখ করা হয়েছে, বছরের শুরুতে প্রথম চার কিস্তিতে মোট ৫৭ হাজার ৮১৩ কিউসেক পানি কম পেয়েছে বাংলাদেশ। চুক্তির ইন্ডিকেটিভ সিডিউল মোতাবেক বাংলাদেশ এই পরিমাণ পানি কম পেয়েছে।

এইভাবে চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ কম পানি পেলেও ভারত কিন্তু প্রতি কিস্তিতেই ৪০ হাজার কিউসেক পানি বুঝে নিয়েছে।

চুক্তি অনুসারে, ফারাক্কা পয়েন্টে প্রাপ্ত পানি ভাগাভাগির কথা। কিন্তু এই মওসুমে ফারাক্কা পয়েন্টে তুলনামূলকভাবে কম পানি পাওয়া যায়, যা প্রয়োজন পূরণের জন্য যথেষ্ট নয়। পানি কম পাওয়া গেলেও চুক্তিতে ভারতকে তার হিস্যা নিশ্চিত করা হয়েছে।

বাংলাদেশের হিস্যা প্রাপ্তির কোনো নিশ্চয়তা তাতে নেই। ফলে ভারত তার হিস্যাটি ঠিকই নিয়ে নিচ্ছে। আর বাংলাদেশ ইন্ডিকেটিভ সিডিউল থেকে প্রতি কিস্তিতে হাজার হাজার কিউসেক পানি কম পাচ্ছে।

প্রসঙ্গত, ১৯৯৬ সালে স্বাক্ষরিত গঙ্গার পানিবন্টন চুক্তি অনুসারে এ পর্যন্ত কখনই বাংলাদেশ পানির ন্যায্য হিস্যা পায়নি। প্রতি বছরই বাংলাদেশের তরফে বিষয়টি জানানো হলেও ভারত নানা অজুহাতে পাশ কাটিয়ে গেছে। চুক্তিটি সমতাভিত্তিক নয়, ত্রুটিপূর্ণ ও ভারতীয় স্বার্থের অনুকূলে, এ অভিমত বিশেষজ্ঞদের। আর এই সুযোগটিই ভারত বরাবর নিচ্ছে।

গত এক দশক ধরে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের সর্বোচ্চ অগ্রগতি হয়েছে বলে দুই দেশেরই শীর্ষ পর্যায় থেকে বিভিন্ন সময়ে উল্লেখ করা হয়েছে। বিশেষ করে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ভারতের প্রতি বন্ধুত্বের প্রমাণ দিতে নিজেদের অর্থনৈতিক ও কৌশলগত অনেক স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়েছে।

অথচ বাংলাদেশের জীবন-মরণের সমস্যা পানি সমস্যার কোনো সমাধান হয়নি। সমাধানের কোনো লক্ষণও দৃশ্যমান হয়ে ওঠেনি। তার মানে দাঁড়াচ্ছে, পানি নিয়ে কোনো ফলপ্রসূ আলোচনাই হচ্ছে না।

এদিকে, গঙ্গা ছাড়া আর কোনো নদীর ব্যাপারে কোনো চুক্তিই নেই। আর চুক্তিবিহীন নদীগুলোর পানি বাংলাদেশ কতটা পাচ্ছে তা উল্লেখের অপেক্ষা রাখে না।

যৌথনদীর পানি বন্টন কোনো দেশের একক ইচ্ছাধীন বিষয় নয়। আন্তজার্তিক নদী আইন ও কনভেনশন অনুসারে নদীর অববাহিকা ও ভাটির দেশকে পানি বঞ্চিত করার কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু ভারত বাংলাদেশকে পানির ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত করার কারণে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে ভয়াবহ পানি সংকট ও পরিবেশগত বিপর্যয় দেখা দিচ্ছে।

একদিকে ফারাক্কা অন্যদিকে গজলডোবায় ব্যারাজ দিয়ে দুই প্রধান নদীর পানি আটকেই ক্ষান্ত হয়নি ভারত, অভিন্ন প্রায় সকল নদীতে বাঁধ ও পানি প্রত্যাহারের জন্য সংযোগ খাল নির্মানের মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করে বাংলাদেশকে মরুভূমি হওয়ার পথে ঠেলে দিয়েছে।

যে কারণে নদীমাতৃক বাংলাদেশের প্রায় সব নদীর মূল প্রবাহে আজ নাব্য সংকট এবং অধিকাংশ শাখানদীর অস্তিত্ব বিলীন হওয়ার পথে। ইতিমধ্যেই বহু নদী পলিজমে শুকিয়ে অস্তিত্ব হারিয়েছে।

ভারত সবসময় একই অজুহাত দেখায় যে, ফারাক্কা পয়েন্টে পানি কম থাকার কারণে বাংলাদেশকে সিডিউল অনুযায়ী পানি দেওয়া সম্ভব হয় না। এক্ষেত্রে বলতে হচ্ছে, গঙ্গার মূল প্রবাহের ওপর ভিত্তি করে পানি ভাগাভাগির বিষয়টি যদি চুক্তিতে স্থিরিকৃত হতো তাহলে ভারত নিজেদের ইচ্ছেমতো পানি প্রত্যাহার করতে পারত না। কেননা তাতে প্রয়োজনীয় পানি ফারাক্কা পয়েন্টে আসত এবং বাংলাদেশও পানির ন্যায্য হিস্যা পেত।

আসলে ভারত পানি নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে রাজনীতির খেলা খেলছে। দু’দেশের মধ্যে প্রবাহিত সকল নদীতেই ভারত বাঁধ, গ্রোয়েন ইত্যাদি নির্মাণ করে শুকনো মওসুমে একতরফাভাবে পানি প্রত্যাহার করে নিচ্ছে।

এ কারণে বড় ছোট সকল নদীই তীব্র পানিসংকটের শিকার হচ্ছে। এ সময় পদ্মা শুকিয়ে মরা খালে পরিণত হয়। ব্রহ্মপুত্র, যমুনা, তিস্তার মতো নদী একই দশায় পতিত হয়। এদের শাখা-উপশাখা নদীগুলোর অবস্থা আরও শোচনীয় হয়ে পড়ে।

কথা এখানেই শেষ নয়। পানির অভাবে দেশের আবহাওয়া, আবাদ-উৎপাদন, পরিবেশ-প্রতিবেশ ও জীববৈচিত্র্য মারাত্মক হুমকির সম্মুখীন হলেও বর্ষা মওসুমে দেখা দেয় ভিন্ন পরিস্থিতি। বন্যায় ফসলহানি এখন প্রতিবছরের সাধারণ ঘটনায় পরিণত হয়েছে।

এই বন্যার প্রধান কারণ উজান থেকে নেমে আসা ঢল। প্রতিবছরই যখন উজানে পানি বাড়ে তখন অভিন্ন সব নদীর ওপর দেওয়া বাঁধ ভারত একযোগে খুলে দেয়। এতে বাড়িঘর, ফসলাদি পানির তোড়ে ভেসে যায়। একই সাথে বাংলাদেশের নদীতে দেখা দেয় ব্যাপক ভাঙন।

প্রশ্ন হচ্ছে, পানি নিয়ে ভারতের এ রাজনীতি ও আগ্রাসনের শেষ কোথায়?

এমন বাস্তবতায়, গঙ্গা-তিস্তাসহ সব যৌথনদীর পানির ন্যায্য হিস্যা এবং নদনদীর অববাহিকাভিত্তিক পানিব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা দরকার। কারণ, এছাড়া বাংলাদেশের পরিবেশগত, অর্থনৈতিক ও ভূ-রাজনৈতিক নিরাপত্তাসহ টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করারও যে কোনো উপায় নেই।

লেখক : কবি, গবেষক ও সাংবাদিক
[email protected]

১৩.০৩.২০১৮


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ