মাওলানা লাবীব আবদুল্লাহ
অতিথি কলামিস্ট
কওমী মাদরাসার শিশু বিভাগ বা মকতব, হিফজ বিভাগের তালেবে ইলমদের উপর নানা শারিরীক নির্যাতনের খরব পাওয়া যায়৷ বাস্তব অভিজ্ঞতাও রয়েছে আমার মাদরাসার শিক্ষক হিসেবে৷
শিক্ষাবিষয়ক দায়িত্বে আছি সেই দুই যুগ থেকে৷ এই দায়িত্ব ছেলেদের মাদরাসায়, মহিলা মাদরাসায় এবং কিন্ডার গার্টেনে৷ আমি অতীতের অভিজ্ঞতা না বলে গতকালের বাস্তব ঘটনা বলতে পারি৷
একজন শিক্ষক মহিলা মাদরাসার ছাত্রীকে প্রহার করেছে৷ বিস্তারিত বললাম না৷ এলাকাবাসী মাদরাসায় এসে যা করার তাই করেছে৷ বিস্তারিত বলতে মানা৷
ত্রিশালের ঘটনা দেশজুড়ে আলোচিত৷ শিশুকে হত্যা করেছে যে বর্বর সে কি শিক্ষক? সে কি মানুষ? সে অমানুষ৷ নাবালেগ তালেবে ইলমকে প্রহার করে যে হত্যা করে তাকে আমি মানুষ বলতে পারি না৷
মাদরাসা নববী আদর্শে পরিচালিত হবে৷ নবীজি মুআল্লিম ছিলেন৷ নবীজির শিক্ষার নানা মেথড নিয়ে পড়ালেখা করেছি কিন্তু প্রহারের কোনো নজির পাই নি এখনও৷
আদর সোহাগ, মমতা স্নেহ ছিলো নবীজির শিক্ষা পদ্ধতিতে৷ ছিলো নানা কৌশল৷ মাদরাসা শিক্ষায় প্রহার কেন কীভাবে প্রবেশ করলো তা গবেষণার বিষয়৷ তাও আবার শিশুদের উপর৷
একজন বাবা কি তাঁর সন্তানকে হত্যা করতে পারে? উস্তাজ কেন তালেবে ইলমকে সন্তান মনে করে না? কেন সন্তানের মতো সোহাগ করতে পারে না?
যদি না পারে সে আলু পটলের ব্যবসা করবে পড়াতে আসবে কেন? কেন শিক্ষকতা করবে?
মিডিয়ার এই যুগে একটি ছোট ঘটনা প্রচারিত হয় দেশজুড়ে৷ বিশ্বজুড়ে৷ এমনিতেই মাদরাসা শিক্ষা নিয়ে নানা সমালোচনা৷ নানা মিথ্যা অভিযোগ৷ দেশী বিদেশী নানা এজেন্ডা মাদরাসা নিয়ে৷
এই সময়ে শিশু হত্যা করে, মহিলা মাদরাসায় প্রহার করে কথিত শিক্ষকরা কী উপকার করছে মাদরাসার? স্কুলেও কথিত শিক্ষকরা প্রহার করে না এমন নয়৷ আমি সেই দিকে আজ যাচ্ছি না৷ স্কুলে প্রহার নিষিদ্ধ আইনত৷
কওমী মাদরাসায় প্রহার করে কোনো তালেবে ইলমকে ভালো আলেম বানাতে পেরেছেন তা আমার জানা নেই৷ অপরাধীকে আদর ও ভালোবাসা দিয়ে উস্তাজ ভালো আলেম বানিয়েছেন তার অনেক নজির রয়েছে৷
শরীয়ার সীমায় রেখে তারবিয়ার জন্য হালকা শাস্থির বিধানের কথা বলছি না আমি৷ অধিক প্রহার, শিশু নির্যাতন, মহিলা মাদরাসায় বালিকাদের প্রহারের কথা বলছি৷ এইসব সীমাহীন প্রহার আমাদের স্বার্থেই বন্ধ হওয়া প্রয়োজন৷
আমি এমন অনেকের কথা জানি, যারা মাদরাসায় প্রহৃত হয়ে পালায়ন করে স্কুলে ভর্তি হয়েছে৷ অনেকে প্রহৃত হয়ে মাদরসা ত্যাগ করে সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে তার পরিবারের কাউকে আর মাদরাসায় ভর্তি করাবে না৷
আমি একজন শিক্ষক হিসেবে ত্রিশালের শিশু হত্যার তীব্র প্রতিবাদ করি এবং সেই কথিত শিক্ষকের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হোক তা চাই৷ কিন্তু এই একজনের শাস্তিতে সকল মাদরাসায় প্রহার বন্ধ হবে না৷
অনেক মদারসায় এখনও নিউজ পেপার বা সংবাদপত্র পড়া নিষেধ৷ তবে ফেবুতে সয়লাব মাদরাসা৷ হাটহাজারীর মোবাইল পোড়ানোর ঘটনা প্রামাণ করে এই যুগে মিডিয়াবিমুখ করা সম্ভব নয় কাউকে৷
এই মোবাইল নিয়ে আমি কথা বলছি না৷ মোবাইল নিষিদ্ধ হোক সেটির পক্ষে তবে প্রয়োজনীয় ব্যবাহরেরও পক্ষে৷
ঘটনা আরেকটা বলি তাহলে, এক মহিলা মাদরাসায় আবাসিকে সিম পাওয়া গেছে যা গোপনে তারা ব্যবহার করতো! এই বিষয়ে না বলি৷ যারা মহিলা মাদরাসা চালান তাদের আরও সতর্ক হতে হবে৷
আজ আমি একটি মহিলা মাদরায় ওয়ায়েজ! আগামীতে হয়তো আমাদের আর মহিলা মাদরাসায় ওয়াজ করতে হবে না৷ মহিলা ওয়ায়েজ তৈয়ার হয়ে যাচ্ছে! ভয়াবহ দিন অপেক্ষায়৷
মেয়েদের মাঝে কথা বলার কথা থাকলেও আমি এড়িয়ে গিয়েছি৷ রাতে পুরুষদের জন্য ওয়াজ করতে রাজি হয়েছি৷ বেমৌসুমে ওয়াজ! শীতের ওয়াজ বসন্তে!
আমি বসন্তের ফুল দেখে দেখে যাবো৷ প্রতিটি শিশু ফুলের মতো৷ ফুলকে ভালোবাসতে হয় আঘাত নয়৷
মাদরাসার প্রতিটি তালেবে ইলম ফুল৷ মহিলা মাদরাসার ছাত্রীদের ‘রিফকান বিল কাওয়ারিরের’ কথা মনে রেখে তারবিয়া দিতে হবে৷ প্রহার নিষধ হোক মহিলা মাদরাসায়৷ প্রহার নিষেদ হোক মকতবে৷ হিফজ বিভাগে৷
এ বিষয়ে কিছু প্রস্তাবনা
১. বেফাক, ইত্তেফাক, ইত্তেহাদ, তানজিমসহ সবগুলো শিক্ষাবোর্ড দ্রুত প্রহার বিষয়ক শরীয়াহর বিধানসহ নির্দেশনা জারি করতে পারে৷
২. আর রাসুল আল মুআল্লিম ওয়া আসালিবুহু ফিত তালিম কিতাবটি এবং এই জাতীয় কিতাব উস্তাজদের তালিমের ব্যবস্থা নিতে হবে৷
৩. শিক্ষক প্রশিক্ষণের আয়োজন করে আদর্শ শিক্ষাকের গুনাবলীর উপর দরস দিতে হবে এবং প্রহার বিষয়ে শরীয়াহর বিধান জানাতে হবে৷
৪. আর্থিক টেনশন, মানসিক সমস্যার কারনে যারা তালেবে ইলমদের রাগে প্রহার করে তাদের শিক্ষকতার পদ থেকে বাদ দিতে ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে৷
৫. উস্তাজদের জন্য শিক্ষকনির্দেশিকা তৈরি করে প্রচার করা যেতে পারে দেশের সেরা শিক্ষাবিদগণ এ নির্দেশিকা তৈরি করবেন বোর্ডগুলো লোক নির্ধারণ করে দেবে৷
লেখক: পরিচালক, ইবনে খালদুন ইনস্টিটিউট
আরও পড়ুন: মাদরাসায় শিশুদের উপর অমানবিক শাস্তি; প্রতিকারে কী ভাবছেন আলেমরা?