সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪ ।। ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬


কোটা পদ্ধতি মেধা বিকাশের অন্তরায় নয় কি?

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

সৈয়দ ফয়জুল আল আমীন

সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি সংস্কারের দাবি অনেক দিনের। সম্প্রতি নতুন উদ্যমে আবারও শুরু হয়েছে ৫ দফা দাবিতে আন্দোলন। মূলত কোটা পদ্ধতি সংস্কার করে ৫৬ শতাংশ থেকে ১০ শতাংশে নিয়ে আসা, কোটায় যোগ্য প্রার্থী পাওয়া না গেলে শূন্য থাকা পদগুলোয় মেধায় নিয়োগ দেওয়া, কোটায় কোনো ধরনের বিশেষ নিয়োগ পরীক্ষা না নেওয়া, সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে সবার জন্য অভিন্ন বয়সসীমা এবং চাকরির নিয়োগ পরীক্ষায় কোটা সুবিধা একাধিকবার ব্যবহার না করার ইস্যুতে মাঠে নেমেছেন মেধাবী চাকরিপ্রার্থী আন্দোলনকারীরা।

কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনে নামা শিক্ষার্থীরা প্রধানত মুক্তিযোদ্ধা কোটার বিষয়টি সামনে নিয়ে আসে বলে এ নিয়ে বিরূপ প্রতিক্রিয়াও আছে। যারা আন্দোলনে নামছে, তাদের যুক্তি হলো, সিংহভাগ কোটায় নিয়োগ পেতে পারে না।

৫৬ শতাংশ কোটায় এবং ৪৪ শতাংশ সাধারণ পরীক্ষার্থী থেকে নিয়োগ-এই বিষয়টি মানতে চাইছে না তারা। এতে সরকারি প্রশাসনে অধিক যোগ্যতাসম্পন্ন প্রার্থীরা নিয়োগ পাচ্ছে না বলেই দাবি তাদের। ব্যক্তিগতভাবে তাদের দাবি আমি যৌক্তিক বলেই মনে করছি।

বাংলাদেশে ১৯৭২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে এক নির্বাহী আদেশে কোটা পদ্ধতি চালু হওয়ার পর বিভিন্ন সময়ে তা পরিবর্তন করা হয়েছে। কিন্তু সেসব পরিবর্তনে কোটা পদ্ধতিকে আরও নেতিবাচক করে তোলা হয়েছে। পিএসসিসহ অনেক বিশেষজ্ঞ মহল বিভিন্ন সময়ে সরকারের কাছে কোটা সংস্কারের সুপারিশ জানালেও এখন পর্যন্ত কোনো কার্যকর উদ্যোগ লক্ষ্য করা যায়নি।

বলা যায়, বৈষম্য দূর করার লক্ষ্যে কোটা চালু হলেও এখন এই কোটাই যেন প্রতিটি ক্ষেত্রে বৈষম্যের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে! বাংলাদেশে এখন মোট ৫৬ শতাংশ কোটা রয়েছে। এর মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা ৩০ শতাংশ, ১০ শতাংশ নারী, জেলা ১০ শতাংশ, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী পাঁচ শতাংশ ও প্রতিবন্ধীদের জন্য এক শতাংশ কোটা সংরক্ষিত।

এক গবেষণায় দেখা গেছে, সরকারি চাকরিতে প্রায় ২৫৮ ধরনের কোটা রয়েছে। কথা হচ্ছে, পৃথিবীর কোথাও স্থায়ীভাবে কোটা পদ্ধতি নেই বলেও ওই গবেষণায় প্রকাশ পেয়েছে। যেসব রাষ্ট্রে কোটা পদ্ধতি চালু রয়েছে, সেখানে নিয়মিতভাবে তা সংস্কারের মাধ্যমে যুগোপযোগী করে তোলা হয়। কিন্তু আমাদের দেশে তা হয় না কেন?

আর হয় না বলেই নাগরিকদের সুযোগের সমতা নিশ্চিত করার বিষয়ে সংবিধানের বিভিন্ন অনুচ্ছেদে স্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকলেও চাকরি ক্ষেত্রে বিদ্যমান কোটা পদ্ধতিতে সংবিধান লঙ্ঘনের মতো প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। বলা যায়, বাংলাদেশে সরকারি চাকরিতে যে কোটা অনুসরণ করা হয়, তা অনেক ক্ষেত্রেই সংবিধানের এই ধারণাগুলোর সঙ্গে সাংঘর্ষিক। কোটা পদ্ধতির কারণে নাগরিকের সাংবিধানিক এ অধিকার যথাযথভাবে সংরক্ষিত হচ্ছে না।

সরকারি চাকরিতে কোটার সংখ্যা কমাতে আন্দোলনকারীদের দাবিতে সরকার সাড়া না দিলেও সম্প্রতি সরকারের গৃহীত এক নতুন সিদ্ধান্তে কোটাধারীর তুলনায় সাধারণ পরীক্ষার্থীরাই বেশি নিয়োগ পাবেন বলে প্রচারের পাশাপাশি করা হচ্ছে। কারণ, নানা ধরনের মিলিয়ে ৫৬ শতাংশ কোটা থাকলেও সব পদে যোগ্য প্রার্থী পাওয়া যায় না। কিন্তু এতদিন সেই পদগুলো শূন্য থাকত।

তবে নতুন নীতিমালা অনুযায়ী যোগ্য প্রার্থী না থাকলে সাধারণ পরীক্ষার্থীদের মধ্য থেকেই নিয়োগ দেওয়া হবে। এতে কোটাধারীর চেয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের কিছুটা হলেও বেশি নিয়োগের সুযোগ তৈরি হয়েছে। তবে কোটার পরিমাণ ১০ শতাংশে নামিয়ে আনাসহ নানা দাবিতে আন্দোলনে নামা শিক্ষার্থীরা এই সিদ্ধান্তে পুরোপুরি সন্তুষ্ট নয়। তাদের দাবি, কোটা আরও কমাতে হবে।

প্রসঙ্গত, বাংলাদেশ তার সামর্থ্যানুযায়ী মুক্তিযোদ্ধা ও তার পরিবারকে আর্থিক প্রণোদনা প্রদান করছে। প্রয়োজনে এটা আরও বর্ধিত কলেবরে মুক্তিযোদ্ধাদের আমৃত্যু সর্বোচ্চ সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করার সর্বাত্মক প্রয়াস রাষ্ট্র গ্রহণ করতে পারে। কিন্তু কোটার ক্ষেত্রে সাধারণ শিক্ষার্থীদের আনুপাতিক হার দেখে মুক্তিযোদ্ধাদের উত্তরসূরীদের কোটা তাদের সন্তান পর্যন্ত বর্ধিত রাখলেই বোধ হয় রাষ্ট্রের সবার জন্য মঙ্গল হতো। চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধাদের কোটা নিয়ে যে আপত্তি ওঠছে তা বোধ হয় মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-নাতনীদের পর্যন্ত বর্ধিত না হলে উত্থাপিত হওয়ার যৌক্তিকতা থাকত না।

মনে রাখা চাই-কোটার বিরুদ্ধে যৌক্তিক কিছু বললেই কেউ রাজাকার হয়ে যায় না। বরং ‘নাতি কোটা’র মতো রাজনৈতিক কোটা বন্ধ করা উচিত।একই সাথে কোটাকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারও বন্ধ করতে হবে।

এ প্রসঙ্গে আরও বলা যায়, চাকরিতে জেলা কোটাও বর্তমান সময়ে বেশ হাস্যকর শোনায়। দেশের ৬৪ জেলার মানুষের মধ্যে কেউ কারও চেয়ে বেশি সুবিধা পাবে-এটা বোধ হয় এখন আর কাম্য নয়। বলতে চাচ্ছি, জেলা কোটা প্রবর্তনের শুরুর দিকটায় এটা প্রাসঙ্গিক থাকলেও বর্তমান সময়ে এ রীতির বহাল স্বাভাবিক দৃষ্টিতে বিবেচনা করার সুযোগ নেই। কারণ এখন পিছিয়ে পড়া জেলা বলতে কিছু নেই। এটা বাতিল হয়ে গেলেই কোটাধারীর সংখ্যা কমে ৪৬ হয়ে যাবে। আর সাধারণ শিক্ষার্থী বেড়ে হবে ৫৪।

তবে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের জন্য এবং পঙ্গু-বিকলাঙ্গদের জন্য কোটা সংরক্ষণ করা যৌক্তিক বলে মনে করি। কেননা, দেশের অন্যান্য মানুষ এবং গোষ্ঠীর তুলনায় এরা সত্যিই আজও পিছিয়ে।

নারী কোটার ক্ষেত্রে এখনও কিছু উচ্চারণ করার সময় আসেনি। কেননা আমাদের মা-বোনদের যারা উচ্চশিক্ষা অর্জনের সুযোগ পান তাদের নানাবিধ প্রতিকূলতা উৎরে তবেই পথ চলতে হয়। অবশ্য সমাজের কেউ কেউ উপহাস করে বলেন, নারীদের জন্য কি না চাকরিতে সুন্দরী কোটাও আছে! যদিও আমরা এমন বাজে মন্তব্য শুনতে চাই না।

সবশেষে বলছি, কোটা পদ্ধতি অবশ্যই মেধা বিকাশের অন্তরায়। কেননা, জন্ম থেকেই একটি সন্তান যখন জানতে পারে-তার জন্য একটি কোটা সংরক্ষিত আছে; তার জন্য বয়স দু’বছর বেশি থাকবে; কোনো রকম পাস করতে পারলেই চাকরি নিশ্চিত-এমতাবস্থায় একজন ছাত্রের মেধার স্বাভাবিক বিকাশ কখনোই ঘটতে পারে না বলেই ধরে নেওয়া যায়। আমরা প্রত্যেক শিক্ষার্থীর মেধার স্বাভাবিক বিকাশের উন্মুক্ত পথ চাই।

লেখক : কবি, গবেষক ও সাংবাদিক
১০.০৩.২০১৮


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ