খতিব তাজুল ইসলাম
লন্ডন থেকে
আলোচনা বেশ জমে উঠেছে। তবে বিষয়টা এখন এক প্রকার রেষারেষিতে চলে গেছে। কে কার মতকে উপরে উঠাবেন কারটা নামাবেন নিচে। কেউ বলছেন চমৎকার কেউ বলছেন বাজে কাজ। আমি বলছি স্মার্ট আইডিয়া না সেটা।
প্রথমে বলি বিষয়টার ক্ষেত্রে হাটহাজারী মাদরাসাকে মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলা উচিত। কারণ কর্তৃপক্ষ যা করেছে তাদের নিজস্ব আইনের প্রয়োগ ঘটিয়েছে মাত্র। আমরা যারা একমত নই বা ভাবছি বিষয়টা নিয়ে হাটহাজারী কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলা দরকার, সেখানে গিয়ে তাদের সাথে কথা বলতে পারেন।
তাদের দোষারোপটা এভাবে মিডিয়ায় ডাইরেক্ট যদি আমিও করি সেটা ইনসাফের খেলাপ হবে। অতএব কে কেন কিভাবে পুড়িয়েছেন সে কথা এখন এখানে নেই। আলোচনাটা হবে শুধু সামগ্রিক মোবাইল ব্যবহার ও জব্দ করা নিয়ে।
১.
অপ্রাপ্ত বয়স্ক ছেলে মেয়েদের হাতে মোবাইল থাকা গুরুতর বিষয়। একটি মোবাইলের সাথে কতটি বিষয় জড়িত? অর্থ সময় ও স্বাস্থ্য ঝুকি। পনের বছরের নিচের কিশোর কিশোরী মোবাইল ইউজ করতে চায় কেন?
বাবা মায়ের সাথে যোগাযোগ, বিনোদন, বন্ধুর সাথে কথোপকথন। না, এই বয়সে একক মোবাইলের মালিক হওয়া মানে নেশাগ্রস্ত হওয়া। জীবনকে ঝুকির দিকে ঠেলে নিয়ে যাওয়া। দশ বছরের নিচে তো বলবো মোবাইল টাচ করাই হারাম। সেখানে রেডিয়েশন আছে। চোখের সমস্যা শুরু হবে। বিদ্যুতের দুর্ঘটনাও হতে পারে। যা সে সামাল দিতে অক্ষম।
অল্প বয়সে সোশ্যাল মিডিয়ায় যোগাযোগ মানে নষ্টের সবক শুরু করা। বন্ধু বা আত্মীয় স্বজনের সাথে বাবা মার মোবাইল দিয়ে প্রয়োজনের কথা বলুক। দশ বছরের আগে একক মোবাইল সম্পূর্ণ রূপে নিষিদ্ধ করে রাখা উচিত।
হাই স্কুলের শিক্ষার্থীদের অনেকে এমন কিছু মোবাইল দেন যা দিয়ে কারো সাথে কন্টাক্ট করা যায় না। শুধু কল রিসিভ করা যায়। কল লিস্ট থাকে। তাই পরে দেখা যায়- সে কার সাথে কথা বলেছে কেন বলেছে?
মা বাবারা যাস্ট যোগাযোগের জন্য এই ব্যবস্থা রাখতে পারেন। কিন্তু বাংলাদেশের মত গরিব অনুন্নত দেশে এমন ব্যবস্থা তো এতটা সহজ নয়। তাই না দেয়া উত্তম।
মেট্টিকের আগ পর্যন্ত এভাবে টাইট করে রাখতে হবে। আমাদের ছেলে মেয়েদের স্কুল কলেজের স্টাডির প্রয়োজনে সোশাল মিডিয়ার দরকার পড়ে। অতএব ঘরের নেট ব্যবহার করে কিংবা স্কুল ও লাইব্রেরির নেট ব্যবহার করে কম্পিউটারের প্রয়োজন মেটায়।
বাংলাদেশের অবস্থা কেমন আমরা ভালো করেই জানি। তাই তাদের নেট ব্যবহারের সময় সামনে থেকে করাবেন। কলেজ ভার্সিটিতে গেলে তো সে অনেক বড় হয়ে গেল না? তবুও ভাল মন্দ নিয়ে সবসময় তাদের অবহিতে করে রাখতে হবে।
আমি তো এখনো আমার সন্তানদের ফেইসবুকের মত এমন কোন সোশাল মিডিয়ায় একাউন্ট লোলার পারমিশন দেইনি। অথচ তাদের একজন ভার্সিটি একজন কালেজের কাছাকাছি।
২.
দ্বায় শুধু কি শিক্ষার্থীদের বেলায়? না, মোবাইল বা ডিভাইস যাই হোক সবকিছুতে বড়দেরও দ্বায় আছে। অনবরত এসব ডিভাইস ব্যবহারের ফলে চোখ ও মস্তিষ্কের মারাত্মক ক্ষতি সাধন হয়। এমনকি অনেকের শ্রবণ শক্তিও হারিয়ে ফেলার ঘটনা আছে।
তাই বড়রাও এসব ব্যবহারে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করবেন। অনবরত মোবাইল ব্যবহার করবেন না। পারত পক্ষে কানের সাথে রেখে কথা বলবেন না। এয়ার ফোন বা লাউডস স্পিকার ব্যবহার করুন।
আমার পরিচিত কয়েক জনের কান ও ব্রেইন ইন্জুরির সমস্যা দেখা দিয়েছে মোবাইল ব্যবহারের কারণে। বর্তমানে বৃটেনের স্কুলগুলোতে মোবাইল নিষিদ্ধ করা হবে কিনা তা নিয়ে বিস্তর গবেষণা চলছে। কারণ মোবাইল এক ধরেনের আশক্তি। যা শিশু কিশোর যুবক বৃদ্ধ সবাইকে করে কুপোকাত।
অতএব মোবাইল বা অন্য ডিভাইসের ব্যবহার সবাই সীমিতভাবে করতে হবে। এমনকি প্রতিষ্ঠানের সম্মানিত শিক্ষকমন্ডলীও নিয়ম নীতির ভেতর থেকে মোবাইল ব্যবহার করবেন।
কেউই আইনের উর্ধে নন। অভিভাবকগণ যদি অধিক সচেতন না হন তাহলে প্রাতিষ্ঠানিক সকল উদ্যোগ বুমেরাং হয়ে দেখা দিবে। তাই বাবা মা বা বড়দের কর্তব্য ও সতর্কতা সাবধানতা অবলম্বন প্রথম কাজ।
মোবাইল পিসি লেপটপ বাস্ট হয়ে এ পর্যন্ত কত হাজার মানুষের জীবন নষ্ট হয়েছে তা কি আমরা জানি। ঘর পুড়েছে, সম্পদ বিনষ্ট হয়েছে। তাই জান ও মালের হেফাজতের জন্য চাই সুচিন্তিত ডিভাইস ব্যবহার ও তার অনুসরণ।
৩.
এবার আসি প্রাতিষ্ঠানিক বিষয়ে। প্রাইমারিতে প্রশ্নই আসে না মোবাইল ব্যবহারের। মাধ্যমিকে দেয়ার পক্ষপাতি নই। তবে ক্লাস এইট হলে যোগাযোগের প্রচণ্ড প্রয়োজন হলে একমুখি মোবাইল শুধু হাতে থাকবে। অভিভাবকের সাথে যোগাযোগের জন্য।
কলেজ পর্যায়ে তাদের কিছুটা স্বাধীনতার দরকার আছে। বিশ্ব সম্পর্কে জানা ও বোঝার প্রয়োজন আছে। তাই মোবাইল থাকবে সাথে যে প্রতিষ্ঠানে যে রুল আছে তা সে মেনে চলতে বাধ্য।
বড় ছাত্র ছাত্রীদের জন্য প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ নিশ্চয় মোবাইল ব্যবহারে নীতিমালা বলে দেন। যারা আবাসিক বা বোর্ডিংএ থাকে তাদের উপরই তো সব আইনের খড়গ।
অনুরোধ থাকবে যেন এমনভাবে বন্দী না করি যাতে তারা লুকিয়ে লুকিয়ে কিছু করার প্রয়োজন বোধ করে। শিশু কিশোরদের আইন যুবকদের উপর চাপিয়ে দেয়া অযৌক্তিক। সমস্যা হলো আমাদের দীনি মাদরাসায় শিশু কিশোর যুবক বৃদ্ধ সবাই এক কাতারে। তাই কর্তৃপক্ষ বয়সনুপাতে আইনের প্রয়োগ ঘটাবেন এটাই সময়ের দাবি।
আসলে ডিজিটাল মিডিয়ার সুবিধা সিকিভাগ বাংলাদেশ পাচ্ছে কিনা আমার সন্দেহ আছে। যাক যুগ থেকে যেমন কেউ আলাদা হয়ে গুহায় বসবাস করতে পারবে না, মাঠে ঘাটে ময়দানে যেতে হবে। দেশ বিদেশ সফর করতে হবে। তাই গর্তের ভিতর যেন নিজেকে আবিষ্কর না করি।
৪.
আইনের প্রয়োগ!
একটা কাহিনী দিয়ে কথাটা শুরু করি। মোল্লা ওমর যখন ক্ষমতায় ছিলেন তখন গোটা আফগানিস্তানে শয়ে শয়ে টিভি সেট ভাঙার হিড়িক পড়ে ছিলো। রাষ্ট্রীয়ভাবে তাদের বাধ্য করা হয়েছিলো।
এটা নিয়ে সাথে সাথে বিশ্বব্যাপী হৈচৈ শুরু! দেখেছো তালেবান কতটা জংগী? কতটা মুর্খ? কতটা বর্বর? কতটা ফানাটিক? কতটা চরমপন্থী? কতটা নিষ্টুর? তালেবান চায় বিশ্ব সমাজকে অন্ধকার যুগের দিকে ঠেলে নিয়ে যেতে?
মোটামুটি তখন তারা টিভি ভাঙ্গা দেখিয়ে ভালো মার্কেট জমিয়েছিলো। ঠিক তদ্রুপ আইএস বোকোহারামকে দিয়ে কুফর এমন কিছু কাজ করিয়ে ফলাও করে বিশ্বকে দেখিয়েছিলো যাতে মানুষের অন্তরে ইসলামের প্রতি অসম্মান বোধ জাগ্রত হতে থাকে।
বুঝতে হবে আমরা এ পৃথিবীতে একা নই। আমাদের দোস্ত দুশমন আছে প্রচুর। ঘরে বাইরে ক্যামেরা নিয়ে তৈরি হয়ে আছে ইসলামের খুঁত ধরতে। তাই তারা যখন কোন ইস্যু পাবে তখন হৈ হৈ রৈ রৈ শুরু করে দিবে।
আমাদের সরকারি স্কুলগুলো চরিত্র বিনষ্টের কারখানা যদি বলি তাহলে কম বলবো। এমন কি অমুসলিম দেশের চেয়েও পরিস্থিতি খারাপ। অমুসলিম দেশে তারা তাদের ফ্রি মিক্সিংকে জায়েজ মনে করে। কিন্তু অপ্রাপ্তদের সাথে কেউ প্রাপ্ত বয়স্কের আচরণ করলে মহা খবর আছে।
প্রাপ্ত বয়স্করাও আইনের ভেতর থেকে যা করার করবে। কিন্তু আমাদের স্কুলগুলো কি আজ নিরাপদ? যেমন ভালো শিক্ষা পাচ্ছে না তেমনি ভাল আচরণ টুকুও শিখছে না। শিশু কিশোর কিশোরীরা অহরহ যৌন হয়রনির শিকার। কোন বিচার নেই। সেখানে আইনের প্রয়োগ কতটুকু হচ্ছে বা শিক্ষার্থীরা নিরাপদ থাকছে বিরাট প্রশ্ন?
সরকারি স্কুল কলেজের চেয়ে প্রাইভেট স্কুল কলেজে অবশ্য কিছুটা কড়াকড়ি চলে। তবে মোবাইল নামক ঘাতক অস্ত্র থেকে স্কুল কলেজের শিশু কিশোররা কতটুকু মাহফুজ আছে তা আল্লাহ ই ভাল জানেন। কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা আর কিই বা বলি।
অপরদিকে আমাদের দীনি প্রতিষ্ঠানে অবশ্য কড়াকড়িটা মজবুত থাকে। ছাত্ররা অন্তত উসতাজদের সম্মান করে। এখানের বড় একটি সমস্যা হলো শিশু কিশোর যুবক বৃদ্ধ সবার অবস্থান একই জায়গায়। যে কারণে শিশু কিশোরদের উপর আরোপিত আইন বড়দের উপরও ধকল যায়। তাই আমাদের এখানে একটা সমন্বিত ও সুচিন্তিত আইন কানুনের দরকার।
বাইরের ছাত্র যারা তারা যে নেটের সুবিধা ভোগ করে সেটা বোর্ডিংয়ের ছাত্ররা পায় না বিধায় চলে লুকোচুরি খেলা। তারপরও বলবো, পরিষ্কার করে মোবাইল ব্যবহার বিধিমালা নোটিশ টানিয়ে দেয়া। আইনের যথাযথ প্রয়োগ ও বাস্তবায়ন হোক। আর তা যেন হয় যৌক্তিকভাবে।
৫.
আইন ভঙ্গ হলে করণীয় কী?
শিশু কিশোরদের হাতে মোবাইল থাকতেই পারে না। তাই সিজ তো হবেই। যতক্ষণ না তার অভিভাবকের সাথে মোলাকাত হয়েছে মোবাইল বা ডিভাইস জব্দ করে রাখা হবে। আইন বার বার ভাঙলে বহিষ্কার করে দিন। এমন কেন্সার রেখে কোনো লাভ নেই।
বড় বড় ছাত্র যারা পনের বছরের উপরে। যুবক এখন। তাদের মোবাইল বা ডিভাইস ব্যবহারের নীতিমালা বুঝিয়ে দিন। কোন কোন আইনের ভেতর সে তা বহন ও ব্যবহার করতে পারবে।
ছোট শিশু কিশোর আর যুবকের আইন সমান হতে পারে না। যারা নিয়ম ভাঙবে তাদের ৩য় সতর্কবাণীর সময় মোবাইল বা ডিভাইস সিজ করে নিন। সিজ করার পর দুটা শর্ত দিতে পারেন, সে বড় আকারের জরিমানা পরিশোধ করে পুনরায় মোবাইল পাবে।
তবে আবার একই কাজ করলে বহিষ্কার নিশ্চিত। কারণ একটা যুবক যখন কিছুতেই হার মানছে না তার মোবাইল আটকিয়ে লাভ নেই। সে অন্যভাবে মোবাইল আরেকটি ম্যানেজ করে নিবে। তাই নাম কেটে দেয়াই হলো উত্তম কাজ।
কর্তৃপক্ষের উদ্দেশ্য তো এইনা যে ওরা আইন ভাঙুক আর আমরা মোবাইল নিতে থাকবো। মোবাইল জব্দ হতে হতে লাওয়ারিস বস্তা যখন হয়ে উঠে তখন করণীয় হলো তার আগে যাদের মোবাইল জব্দ করা হবে তাদের স্বাক্ষর গ্রহণ এই মর্মে যে সে মোবাইল ও ডিভাইসের আইন ভঙ্গ করলে তা সিজ হবে এবং ফেরত দেয়া হবে না।
ফেরত নিতে হলে বড় আকারের জরিমানা পরিশোধ করতে হবে। তখন পরিত্যক্ত মোবাইলগুলো প্রতিষ্ঠানের জনকল্যাণমূলক কাজে ব্যবহার করার জন্য মোবাইল কোম্পানির কাছে বিক্রি করে দেয়া যেতে পারে।
মোবাইল সিজের আগে জানা দরকার একটা যুবকের তার কন্টাক্ট সিমসহ অনেক ডকুমেন্ট থাকতে পারে। তাই তাকে সেই সুযোগ দান যাতে সে তার জরুরি জিনিসগুলো উদ্ধার করে নিতে পারে। মোবাইল সিজের পর কতদিন স্টকে রাখা হবে তাও জানিয়ে দেয়া। এভাবে আরো কোন উত্তম পন্থায় বিষয়টি ডিল হতে পারে।
প্রশ্ন হলো মোবাইল পুড়িয়ে ফেলার বিষয় নিয়ে! মোবাইলের মাঝে কিছু দামী জিনিস থাকে। থাকে বডি কভারসহ কিছু পার্টস পুনর্ব্যবহারযোগ্য। বেটারিতে মারত্মাক এসিড আছে। উন্নত বিশ্বে যে কোনো ব্যাটারি ফেলার স্পেশাল জায়গা রাখা হয়। এমনকি সাধারণ বিনে তা ফেলা দন্ডনীয় অপরাধ।
কারণ ব্যাটারির বিষাক্ত রাসায়নিক তরল পদার্থ মাটির জন্য মানবস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি স্বরূপ। আর লোহা গলে কখনো মাটি হয়ে যায় না। তেমনি প্লাস্টিকও সমান কথা। কারণ একটি প্রতিষ্ঠান যখন শত শত মোবাইল জ্বালাবে তারপরে তা তো জ্বলে নিঃশেষ হয়ে যাবে না। সেই আবর্জনা ফেলেবেন কোথায়? বিশেষ করে দীনি প্রতিষ্ঠান তো আদর্শের আইকন। ছাত্রদের লেখাপড়ার জীবন রক্ষার্থে এখন তা জ্বালিয়ে ড্রেইনে ফেলে প্রতিবেশি ও জাতির জন্য আরেক মুশকিলাতের জন্ম দিবেন? তা সুস্থ মস্তিষ্ক কখনো মেনে নিতে পারে না।
সম্পদ ধংস করার ফতোয়া নাইবা দিলাম; পরিবেশ দূষণ মাটির উর্বরতা নষ্ট, কেন্সারের মত বিভিন্ন ভাইরাসের প্রসার, নালা নদীতে মাছ ও কিট পতঙ্গের জন্য সমস্যা সৃষ্টিসহ আরো অজানা যে সংকট সামনে তৈরি হচ্ছে সে কথা আমাদের জানা থাকা জরুরি নয় কি?
লেখক: চেয়ারম্যান, কওমি মাদরাসা শিক্ষা সংস্কার আন্দোলন
আরও পড়ুন: ‘যুগান্তকারী কাজ করলো হাটহাজারী মাদরাসা’