আওয়ার ইসলাম
মনে হচ্ছিল সিরিয়ার সাত বছরের যুদ্ধ, যে যুদ্ধে চার লাখের বেশি লোক নিহত হয়েছে এবং সাম্প্রতিক ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়ংকর শরণার্থী সংকট তৈরি হয়েছে, প্রশমিত হচ্ছে। ২০১৭ সাল যত কাছে আসছিল ততই ইসলামিক স্টেটের (আইএস) তথাকথিত খেলাফত ভেঙে চুরমার হচ্ছিল। সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের বাহিনী এবং আসাদবিরোধীরা, যারা তাকে ক্ষমতাচ্যুতৎ করতে লড়াই করছিল, একে অপরকে হত্যা বন্ধ করল। আসাদের রক্ষক রাশিয়া বলল, তাদের মিশন ‘কার্যত শেষ’ হয়েছে এবং তাদের সেনাদের ফেরানোর প্রতিশ্রুতি দিলো।
কিন্তু তারপর পরিস্থিতি আবার ঘুরে গেল। আসাদ বাহিনী আবার বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করল। কুর্দি যোদ্ধাদের দমন করতে তুরস্ক তার সীমান্তে সেনা পাঠাল। আমেরিকা রাশিয়ানদের হত্যা করল। সেইসঙ্গে ইরান ও ইসরাইলের মধ্যকার দীর্ঘদিনের উত্তেজনার আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল। কিন্তু কেন সিরিয়ার যুদ্ধ আবার উত্তপ্ত হয়ে উঠল?
এর খানিকটা উত্তর রয়েছে আইএসের পতন এবং সীমান্ত নিয়ে যে টানাটানি তার মধ্যে। গত বছরের অক্টোবর মাসে আইএসের তথাকথিত খেলাফতের রাজধানী রাক্কার পতন ঘটে এসডিএফের (সিরিয়ান ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট) কাছে। এসডিএফ কুর্দি নেতৃত্বাধীন একটি মিলিশিয়া গোষ্ঠী, আইএসের বিরুদ্ধে যাদের ব্যবহার করছে যুক্তরাষ্ট্র। আসাদ সরকার তখন এসডিএফ বিদ্রোহীদের সঙ্গে যুদ্ধবিরতি চুক্তি করল, অথচ তারা (আসাদ বাহিনী) আইএসের দখলে থাকা এলাকা পুনরুদ্ধারে দৃঢ় সংকল্প।
ডিসেম্বর নাগাদ আইএস ইউফ্রেটিস নদীর পশ্চিমাঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করতো আর পূর্বাঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করতো এসডিএফ। কিন্তু এক পর্যায়ে আসাদ বাহিনী আবার বিদ্রোহীদের ওপর আগের চেয়েও জোরালো হামলা শুরু করল। জানুয়ারি মাসে সিরিয়ান সেনারা ইদলিব প্রদেশকে দুই ভাগ করে ফেলল। অর্থাৎ বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রণে থাকা একমাত্র এ প্রদেশের বড় অংশের নিয়ন্ত্রণ নিলো সেনারা। আর ফেব্রুয়ারি মাসে এসে আসাদের অনুগত সেনারা বিদ্রোহী অধ্যুষিত সেই অংশ অর্থাৎ পূর্ব ঘৌতায়, যা রাজধানী দামেস্ক থেকে মাত্র ১০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত, বোমা হামলা শুরু করল, যা ছিল সিরিয়া যুদ্ধের সবচেয়ে ভয়াবহ ঘটনা।
আইএসের পতন, সিরিয়ার ভবিষ্যৎ নিয়ে যাদের স্বার্থ আছে এমন বিদেশি শক্তিগুলোর ফাটলকে আরো প্রসারিত করল। জানুয়ারি মাসে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেক্স টিলারসন বললেন, আইএস যতক্ষণ পর্যন্ত হুমকি হিসেবে থাকবে ততক্ষণ পর্যন্ত মার্কিন সেনারা সিরিয়ার কুর্দি অধ্যুষিত অঞ্চলে অবস্থান করবে। সিরিয়া যুদ্ধের একটি রাজনৈতিক সমাধান পাওয়া গেছে বলেও জানালেন টিলারসন।
কিন্তু ওয়াশিংটনের এ সিদ্ধান্ত তুরস্ককে, ন্যাটোর সদস্য, বিক্ষুব্ধ করল। কারণ আঙ্কারা আমেরিকার কুর্দি মিত্রদের, যেমন ওয়াইপিজি, সন্ত্রাসী হিসেবে গণ্য করে। টিলারসনের ওই ঘোষণার কয়েকদিন পর তুর্কি সেনাবাহিনী সিরিয়ার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে ওয়াইপিজি নিয়ন্ত্রিত আফরিনে হামলা চালাল। আফরিনে কোনো মার্কিন সেনা ছিল না। কিন্তু তুর্কি প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান অন্য শহর মানবিজ, যেখানে মার্কিন সেনা আছে, পর্যন্ত অগ্রসর হওয়ার হুমকি দিলেন। এর ফলে ন্যাটোর দুই শক্তিশালী সদস্য ও তাদের সমর্থকদের মধ্যে সরাসরি সংঘর্ষের স্পষ্ট সম্ভাবনা দেখা দিলো।
অন্যদিকে, সিরিয়ায় মার্কিন সেনাদের অবস্থানের অঙ্গীকার রাশিয়াকেও, যারা আফরিনে তুর্কি অভিযানকে সমর্থন করে, ক্ষুব্ধ করে তুলল। আমেরিকার প্রতিশ্রুতির বিষয়টি যাচাই করতে ক্রেমলিন সম্ভবত পূর্বাঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত ঘাঁটিতে হামলার নির্দেশ দিলো। এই হামলায় বেশি কিছু রাশিয়ান সেনা নিহত হয়।
পরিস্থিতি সম্ভবত আরো খারাপের দিকে যাচ্ছিল। সিরিয়ায় ইরানের প্রভাব দিন দিন বাড়ছে, কারণ লেবাননের হিজবুল্লাহকে অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ করতে তারা সিরিয়ায় তাদের অবস্থান শক্ত করতে চায়। ইরান-সমর্থিত মিলিশিয়ারা ইসরাইল নিয়ন্ত্রিত গোলান মালভূমির দিকে অগ্রসর হতে থাকে। ফেব্রুয়ারি মাসে ইরানের একটি ড্রোন আকাশসীমা লঙ্ঘন করায় ভূপাতিত করে ইসরাইল। এরপর সিরিয়ায় ইরান নিয়ন্ত্রিত সেনাঘাঁটিতে বোমাবর্ষণ করে তেলআবিব।
অন্যদিকে, ইসরাইলের একটি যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করার প্রতিবাদে সিরিয়ার বিমানঘাঁটিতে হামলা চালায় তেলআবিব। সিরিয়ায় ইরানের প্রভাব নিয়ে আতঙ্কিত ইসরাইল। যদিও কোনো পক্ষই যুদ্ধ চায় না, কিন্তু অনেকেই মনে করেন, এই দুই পক্ষের মধ্যে বড় ধরনের সংঘর্ষ অনিবার্য।
গত ২৪ ফেব্রুয়ারি জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ সিরিয়ায় ৩০ দিনের যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়। কিন্তু কার্যত সেটি ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয় বলেই মনে হচ্ছে। কারণ তুরস্ক, ইরান ও আসাদ বাহিনী যুদ্ধ অব্যাহত রাখার ঘোষণা দেয়। বিদেশি শক্তিগুলোর মধ্যে যেহেতু উত্তেজনা বাড়ছে সেহেতু সিরিয়ার এই যুদ্ধ শান্তি প্রতিষ্ঠার পরিবর্তে নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে যাবে, আর এর দগদগে ক্ষত বয়ে বেড়াতে হবে দেশটির সাধারণ মানুষকে।